- পাইন গ্যাপ: রহস্যাবৃত এলাকা যেখানে প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত - March 19, 2021
- দ্য টাওয়ার অফ লন্ডন : ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্য - March 3, 2021
- মঙ্গল অভিযাত্রা : মঙ্গলে মানববসতি গড়ার এক অকল্পনীয় মিশন - December 19, 2020
সন্দেহ নেই ‘দ্য টাওয়ার অফ লন্ডন’ ইংল্যান্ড ইতিহাসের অন্যতম স্বীকৃতিপ্রাপ্ত এবং আইকনিক ল্যান্ডমার্ক। দীর্ঘ এক হাজার বছরের রক্তাক্ত পুরনো ইতিহাসের পাতায় ঘেরা এই ‘দ্য টাওয়ার অফ লন্ডন’। বলা হয় আপনি যদি কখনো ইংল্যান্ড ভ্রমনে যান এবং সেখানের কোনো ট্যুর গার্ডের সহায়তা যদি আপনি নেন তবে তিনি রাজধানীর সর্বাধিক বিখ্যাত দর্শনীয় স্থান এবং আইকনিক ল্যান্ডমার্কটিকে জীবন্ত করে তুলবেন।
তবে পর্যটক হিসেবে আপনি যদি বিখ্যাত টিভি সিরিজ Game of Thrones এর বড় ভক্ত হয়ে থাকেন তাহলে নিঃসন্দেহেই এই Castle কিংবা দুর্গটি আপনার নজর কারতে বাধ্য। কারণ Game of Thrones এ যে ধরনের Castle এর চিত্র দেখানো হয়েছে তার সাথে হুবহু মিলে যাবে টাওয়ার অফ লন্ডন। পার্থক্য শুধু এতটুকুই যে একটি বাস্তব চিত্র আরেকটি ভিএফএক্স এর কারসাজি।
১৯৮৮ সালে ইউনেস্কো স্থানটিকে World Heritage List-এর আওতাভুক্ত করে। তবে কি ইতিহাস আছে এই স্থাপনাকে নিয়ে? কেনোই বা এটি নির্মাণ করা হয়েছিলো এবং এই দুর্গটি নিয়ে কাদের ইতিহাস? তবে এটি শুধু দুর্গ নয় এটি একটি Haunted Site হিসেবেও বিশ্বে পরিচিত। তো অসামান্য বাসিন্দা, এসব কিছুর সংক্ষিপ্ত ইতিহাস নিয়ে সাজানো আজকের এই পর্ব।
অবস্থান
নাম থেকেই বোঝা যায়, টাওয়ার অফ লন্ডন যুক্তরাজ্যের ব্রিটিশ রাজধানী লন্ডনে অবস্থিত। আরও কিছুটা যথার্থ হল এটি শহরের পূর্ব দিকে সামান্য বামে থামেস নদীর তীরে দাঁড়িয়ে আছে টাওয়ারটি। এটি বিখ্যাত লন্ডন ব্রিজের ঠিক পাশেই অবস্থিত।
টাওয়ার অফ লন্ডন রাজা William the Conqueror হেস্টিংগসে ( Battle of Hastings) তার বিখ্যাত জয়ের পর ১০৬৬ সালে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।


রাজা উইলিয়াম, টাওয়ার অফ লন্ডন এর প্রতিষ্ঠাতা
উইলিয়াম প্রথম বা William, জন্ম ১০২৮ সালে ফ্রান্সের নরম্যান্ডিতে। ১০৩৫ সাল থেকে নরম্যান্ডের নৃপতি (দ্বিতীয় উইলিয়াম হিসেবে) এবং ইংল্যান্ডের রাজা (প্রথম উইলিয়াম হিসেবে) মধ্যযুগের অন্যতম সেরা সৈন্য ও শাসক তিনি।


তিনি একই সাথে William the Conqueror বা William the Bastard বা William of Normandy নামেও পরিচিত ছিলেন। এছাড়া তিনি নিজেকে ফ্রান্সের সবচেয়ে শক্তিশালী অভিজাত্য লাভ করেছিলেন এবং তার দেশ জয় করে ইংল্যান্ড ইতিহাসের ধারায় পরিবর্তন এনেছিলেন। ইংলিশ সিংহাসনে তাঁর অধিকার দাবি করে নরমান্ডির ডিউক উইলিয়াম ব্রিটেনের দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলের পেভেনসে ইংল্যান্ড আক্রমণ করেছিলেন। হেস্টিংসের যুদ্ধে দ্বিতীয় রাজা হ্যারল্ডের পরাজয়ের পরে ব্রিটিশ ইতিহাসে একটি নতুন যুগের সূচনা হয়েছিল তাঁর হাত ধরে।
কেন এই টাওয়ার অফ লন্ডন?
‘লন্ডন ওয়াল’ নামে পরিচিত বিশাল প্রতিরক্ষামূলক রোমান প্রাচীরের কিছু অংশ ব্যবহার করে উইলিয়ামের লোকেরা লন্ডনের বাসিন্দাদের পরাজিত করার জন্য একটি শক্তিশালী দুর্গ নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়ে যাত্রা শুরু হয় এই ঐতিহাসিক স্থাপনার। প্রথমে এটি একটি কাঠের দুর্গ হিসেবে তৈরি হলেও ১০৭৫-১০৭৯ সালের দিকে বিশালাকার ‘গ্রেট টাওয়ার’ (যা পরবর্তীতে হোয়াইট টাওয়ার নামে পরিচিত) নিয়ে কাজ শুরু করা হয়েছিলো, যা দ্বাদশ শতাব্দীর সময় থেকে টাওয়ার অফ টাউন নামে পরিচিত লাভ করে।


যদিও এটি শুধুমাত্র প্রতিরক্ষামূলক দুর্গ হিসেবে নয়, বিজয়ের পর রাজকীয় আবাসকে মাথায় রেখেও তৈরি করা হয়। ইংল্যান্ডের জনগণের উপর আধিপত্যের প্রতীক হিসেবে এবং জনগণের বিশ্বস্ততা তৈরির জন্য উইলিয়াম এ বিশাল ব্যবস্থা গ্রহণ করে বলে ধারণা করা।
নির্মাণশৈলী
১৯৯০ সালের জানুয়ারিতে ভূতাত্ত্বিক এবং প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষকদের একটি দল টাওয়ারটি পরিদর্শনে যান এবং কতৃপক্ষের সহায়তায় পরীক্ষা চালান। হোয়াইট টাওয়ার হলো দ্য টাওয়ার অফ লন্ডনের মধ্যমনি। ধারণা করা হয় এই স্থাপনা এতোদিন পর্যন্ত অক্ষত থাকার পেছনে এর উপাদান এবং রাজমিস্ত্রীর কাজের নৈপূন্যতাকেই স্বীকৃতি দেয়া হয়।
আরো পড়ুন: আলফ্রেড দ্য গ্রেট: ভাইকিং আক্রমণের বিরুদ্ধে একজন সফল রক্ষক, পর্ব ১


হোয়াইট টাওয়ারের অভ্যন্তরে বেশ কিছু সুন্দর কাজ দেখা যাবে। তার মধ্যে বোধহয় St John এর ব্যাতিক্রম সূক্ষ্ম চ্যাপেলটিই সেরা।


এর মূল উপাদান হলো নরম্যান্ডি থেকে আনা কেইন পাথর (Caen Stone) যা সে সময় অর্থাৎ একাদশ শতকে প্রথম ইংল্যান্ডে আনা হয় এ স্থাপনা কাজের জন্য। Caen Stone অবশ্য একমাত্র উপাদান নয়। আরেকটু লক্ষ্য করলে দেখা যাবে কিছুটা গাড় ধরনের পাথর। এটি Quarr Stone যা Isle of Wight এর উত্তর-পূর্ব কোণ থেকে আনা। কিন্তু তার বেশকিছুদিন পরই দুর্লভ হতে শুরু করে। এসময়ের পর আর ইংল্যান্ডে পাওয়া যায় নি।
যদিও পরবর্তী শতাব্দী অর্থাৎ দ্বাদশ শতাব্দীর দিকে Isle of Wight এর অনুরূপ একটি পাথর টাউনে আনা হয়েছিলো বলে গবেষকরা ধারণা করেন। হোয়াইট টাওয়ারের উত্তর-পূর্বাংশে কিছু Reigate Stone দেখা যায়, তবে এ পাথরের ব্লকগুলো প্রায় মধ্যযুগে মেরামত করা হতো। নথিপত্র থেকে জানা যায় ১২৪৮ সালে Henry III এর আদেশে টাওয়ারের উপর থেকে বৃষ্টির পানি যাতে নিচে মাটিতে পরে যে ব্যবস্থা করার। হয়তো এই বৃষ্টির পানি নিয়ে দেয়াল বেয়ে পরার কারনে এর রং সাদা বর্ণ ধারণ করেছে। এই সাদা বর্ণের কারনেই এর নাম White Tower হয়।


আক্রমণকারীদের বাইরে রাখার জন্যে ১৫ ফুট পুরু পাথরের দেয়াল এবং সামনের দরজা মাটি থেকে ২০ ফুট উঁচুতে তৈরী করা হয়। দুর্গের বেইজমেন্ট সাত হাজার স্কয়ার ফিট যেখানে আনুমানিক দুই মাসের খাবার সংগ্রহ করে রাখা যাবে। এবং এর উপরের তলায়ই রয়েছে উচ্চ পদস্থ সৈন্যদের থাকার জায়গা। দ্বিতীয় তল ছিলো প্রার্থনাগৃহ।
টাওয়ারের রক্ষণ কৌশলে শক্তিশালী পরিবর্তন
তখন অবধি উইলিয়াম এর হোয়াইট টাওয়ার থামেস নদীর ধারে উন্মুক্ত দাঁড়িয়ে ছিলো। কিন্তু যখন তৃতীয় রাজা হেনরি বা Henry the third দায়িত্ব গ্রহণ করেন তিনি বুদ্ধিমত্তার সহিত বেশ কিছু পরিবর্তন আনেন। তার আদেশে ১২৩৮ এর দিকে দুর্গের চারিদিকে ৩০ ফুট দেয়াল উঠানো হয় সুরক্ষা মজবুত করতে এবং আটটি টাওয়ার তৈরীরও নির্দেশ দেয়া হয় যাতে তীরন্দাজরা টাওয়ারে অবস্থান করে দুর্গ রক্ষা করতে পারে। এতটুকুতেই থেমে থাকে নি। পরবর্তীতে তাঁর পুত্র এডওয়ার্ড প্রথম (Edward the first) দ্বিতীয় আরেকটি দেয়াল প্রতিষ্ঠার নির্দেশ দেন এবং সাথে ১৫০ ফুট প্রশস্ত একটি চ্যানেল খনন করা হয় দেয়ালের চারিদিকে যা ছিলো পানি দিয়ে পরিপূর্ণ।


যাতে শত্রুরা গেট থেকে যথেষ্ট পরিমাণ দূরত্বে থাকতে পারে। এতো কঠোর প্রতিরক্ষা থেকেই আন্দাজ করা যায় তাদের উপর আক্রমণের পরিমাণ ছিলো অনেক। যার জন্য হেনরি এবং এডওয়ার্ড এতো পরিমাণ অর্থ খরচ করেছিলো দুর্গের সংস্করণের জন্যে।
প্রায় দুশো বছর পর নিখোঁজ রাজপুত্রের খোঁজ
এ টাওয়ারকে ঘিরে রয়েছে নানা ইতিহাস। সর্বাধিক কুখ্যাত পর্বগুলোর মধ্যে বহুল পরিচিত একটি ঘটনা হলো রাজা চতুর্থ এডওয়ার্ড (Edward IV)-এর দুই সন্তানের নিখোঁজ। ১৪৮৩ সালে এডওয়ার্ডের মৃত্যুর পর মাত্র ১২ বছর বয়সে সিংহাসনে বসেন পুত্র এডওয়ার্ড। তাই সে তার ভাই ভাই রিচার্ডকে লর্ড প্রজেক্টরের দায়িত্ব দেন।


রাজ্য পরিচালনার জন্য খুব ছোটো হলেও এডওয়ার্ড তার সন্তানদের সব রকম কৌশল শিখিয়েই বড় করছিলেন। তবে এতো ছোট বয়সে রাজ্য পরিচালনার দায়িত্ব সহ্য করতে পারেননি তার চাচা তৃতীয় রিচার্ড। যিনি রাজ্য দখলের পিপাসায় কাতরাচ্ছিলেন প্রতিনিয়ত। এবং তার কারণেই নতুন রাজার রাজ্যাভিষেক অনুষ্ঠান বারংবার পেছাতে লাগলো। রহস্যজনক ভাবে হঠাৎ চতুর্থ এডওয়ার্ডের দুই পুত্র নিখোঁজ বলে দাবি করা হয়। ঠিক সেই নিখোঁজের অজুহাত ধরে কৌশলগত ভাবে রাজ্যের ভার বহন করেন তার চাচা।
১৬৭৪ সাল। একটি নতুন নিঃসৃংশ ইতিহাসের সাক্ষী হয় পুরো বিশ্ব। তৎকালীন রাজা চার্লস হোয়াইট টাওয়ারের দক্ষিণে রাজপ্রাসাদের অংশটি মেরামত এর আদেশ দেন। সেই সময় একটি বারান্দা যা St John Chapel এর দিকে যাওয়ার একটু গুপ্ত সিড়ি ছিলো। সিড়ির ভিত্তির নিচে কাজ করার সময় দুটো কঙ্কালযুক্ত কাঠের বাক্স পেয়ে অবাক। এগুলো স্পষ্টতই শিশুদের হাড় ছিলো। তাদের উচ্চতা দুই রাজকুমারের সাথে মিলে যায়। আবিষ্কার হয় Edward V এবং Richard এর নিখোঁজ হওয়ার রহস্য।
কার দ্বারা এটি হয়েছিলো জানা যায় নি। তবে প্রধান সন্দেহভাজন এর তালিকায় ছিলো দীর্ঘকাল রাজত্বে থাকা তৃতীয় রিচার্ড। শুধু তিনিই না অন্যরাও ছিলেন রাজকুমারদের পথ থেকে সরিয়ে দেয়ার জন্য স্বার্থন্বেস আগ্রহী।
আরো পড়ুন: রুলার অফ দ্য ওয়ার্ল্ড: মুঘল সাম্রাজ্যের স্বর্ণালী যুগের কারিগর সম্রাট আকবর
প্যারানরমাল ঘটনা
লন্ডনের টাওয়ারটি কেবল শহরের অন্যতম আকর্ষণ নয় এটি সর্বাধিক ভুতুরে জায়গা হিসেবেও বিবেচিত। আপনি যদি Google করেন Most Haunted places in the world– তাহলে সেই লিস্টে একটি নাম The tower of london এরও থাকবে। ঐতিহাসিক দুর্গটি হাজার বছরের ইতিহাস নির্যাতন, মৃত্যুদন্ড, শিরশ্ছেদ, কেলেঙ্কারি এবং রাজনৈতিক উত্তেজনার পটভূমি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
টাওয়ারে বেশ কিছু কয়েকটি প্যারানরমাল ঘটনার পরিসংখ্যানের মধ্যে লেডি অ্যান বোলেন (Lady Anne Boleyn) অন্যতম।


যিনি একটি স্বজাতীয় পুত্র সন্তান জন্ম দেয়ার পর তার স্বামী হেনরি অষ্টম (Henry VIII) এর আদেশে ১৫৩৬ সালে Tower Green এ শিরশ্ছেদ করেছিলেন। এবং প্রত্যক্ষদর্শীরা একটি আত্মা নাকি প্রায়ই কাঁটা মাথা নিয়ে টাওয়ারের ভেতরে ঘুরে বেড়াতে দেখছে বলে দাবি জানান।
আরো একটি ঘটনা উল্লেখিত। রানী প্রথম এলিজাবেথ এর কাজিন Arbella Stuart এর আত্মাকে ঘুরে বেড়াতে দেখা যায় বলে শুনা যায়। যিনি সকলের অসম্মতিতে বিয়ে করার জন্য কারাবন্দী হন।


পঞ্চম রাজা এডওয়ার্ডের আত্মাও নাকি দর্শনীয় যা একটি রিপোর্টে বলা হয়। বলা হয় মৃত্যুর পর যেসকল আত্মার শান্তি হয়নি তারা ঘুরে বেড়ায়।
তবে এগুলো আদৌ সত্য নাকি মনগড়া প্যারানরমাল ঘটনা তা বুঝে ওঠা কঠিন। তবে যত ভুতুড়ে কিংবা প্যারানরমাল হোক না কেনো ইংল্যান্ড কিংবা পুরো বিশ্বে থামেস নদীর তীরে এ নিদর্শনটি এক অনন্য ইতিহাসের সাক্ষী বহন করে যাচ্ছে হাজারো বছর ধরে। যাকে নিয়ে মানুষের জল্পনা কল্পনার কমতি নেই।
গুরত্বপূর্ণ অনেক তথ্য সম্পর্কে জানতে পেরেছি ধন্যবাদ ❣️
আশা করি সামনে আরও ভালো ভালো লেখা পাবো