- গুরাবা – অপরিচিতদের কথা - February 21, 2021
- ক্রুসেড যুদ্ধের ইতিহাস: ইতিহাসের পাতায় পাতায় যুদ্ধের ধারাবিবরণী - February 1, 2021
- রহস্যময় ডার্ক ম্যাটার ও ডার্ক এনার্জি (১ম পর্ব) - December 21, 2020
অনেকে মনে করেন, গুরাবা বলতে বোঝানো হয় শুধু আল্লাহ্র পথে লড়াইকারী মুজাহিদকে – এটা সঠিক নয়।
শায়খ আবদুল্লাহ আল মাসউদ
গুরাবা বলতে কি বুঝায় তা নিয়ে অনেক সাধারণ মুসলিমের মাঝেই হয়ত রয়েছে সংশয়! কিন্তু সময়ের অভাব বলি আর আলস্য বলি, কোন এক কারণে হয়ত অনেকের পক্ষেই এ বিষয় নিয়ে জানার আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও এটি নিয়ে ঘাটাঘাটি করার সুযোগ হয়ে উঠে না।
বইটি মূলত আবু বকর মুহাম্মদ ইবনুল হুসাইন আল-আজুররী রহিমাহুল্লাহ এর লেখা “কিতাবুল গুরাবা” এর অনুবাদ। গ্রন্থটি গুরাবা বিষয়ে রচিত সর্বপ্রথম স্বতন্ত্র কোন বই। সালাফদের বিভিন্ন বইয়ের মত এই বইটিতে রয়েছে অসংখ্য কবিতা!


কাব্য সাহিত্যের মিশ্রনে লিখিত এই বইটি পড়ে যে কেউই ইনশাআল্লাহ মুগ্ধ হবেন। বইয়ের সম্পাদকের প্রশংসা না করলেই নয়। বইয়ের শুরুর দিকেই তিনি কবিতার জন্য ইসলামের বিধান উল্লেখ করেছেন। তিনি সাথে গুরাবার সংজ্ঞাও দিয়েছেন এইভাবে,
দ্বীনের রজ্জুকে শক্তভাবে আঁকড়ে ধরার দরুন নিজের পরিবার-পরিজন, সমাজ-রাষ্ট্রসহ সবার কাছে অপাংক্তেয় হয় যারা, ইসলামের পরিভাষায় তাদেরকেই বলা হয় গুরাবা।
শায়খ আবদুল্লাহ আল মাসউদ
বইটিতে আসলে কেবল আবু বকর আল-আজুররী রহিমাহুল্লাহ এর লেখা আছে বললে ভুল হবে। কেননা বইটির শেষের দিকে ইবনুল কাইয়িম রহিমাহুল্লাহ এর বিখ্যাত গ্রন্থ “মাদারিজুস সালিকীন” থেকে গুরাবা বিষয়ক আলোচনা রয়েছে।


গুরাবা সম্পর্কিত হাদিস
গুরাবা বিষয়ক আল্লাহ্র নবির (ﷺ) কিছু হাদিস হচ্ছে,
নিশ্চয়ই ইসলাম নিঃসঙ্গ ও অপরিচিত অবস্থায় শুরু হয়েছিল, আবার অচিরেই তা নিঃসঙ্গ ও অপরিচিত হয়ে যাবে। সুতরাং গুরাবাদের (তথা নিঃসঙ্গ ও অপরিচিতদের) জন্য সুসংবাদ।
সাহাবীরা জিজ্ঞেস করল,
হে আল্লাহ্র রাসূল, গুরাবা কারা?
উত্তরে আল্লাহ্র রাসূল(ﷺ) বললেন,
গুরাবা হলো ঐ সমস্ত লোক, মানুষেরা গোমরাহ হলে যারা তাদের সংশোধন করবে।
মুসনাদে আহমাদ ইবনু হাম্বলঃ ৩৭৭৫, ৮৮১২
এছাড়াও আরেকটি হাদিস রয়েছে, আল্লাহ্র নবি (ﷺ) বলেছেন,
ইসলাম নিঃসঙ্গ ও অপরিচিত অবস্থায় শুরু হয়েছিল, আবার অচিরেই তা নিঃসঙ্গ ও অপরিচিত হয়ে যাবে। সুতরাং গুরাবাদের (তথা নিঃসঙ্গ ও অপরিচিতদের) জন্য সুসংবাদ।
জিজ্ঞেস করা হলো
হে আল্লাহ্র রাসূল, গুরাবা কারা?
উত্তরে আল্লাহ্র রাসূল(ﷺ) বললেন,
গুরাবা হলো ঐ সমস্ত লোক, যারা আমার সুন্নাহকে জীবিত করে এবং তা মানুষকে শিক্ষা দেয়।
মুসনাদুস শিহাবঃ ১০৫২
আরও বেশ কিছু হাদিস নিয়ে বইটি সাজানো। বইটি বলা যায় গুরাবা সম্পর্কে জানার জন্য একটি অমূল্য সম্পদ। বইটিতে গুরাবাদের প্রকারভেদ সম্পর্কেও আলোচিত হয়েছে, সাথে বৈশিষ্ট্যও উল্লেখিত হয়েছে।
খলিফা হারুনের পুত্র
এছাড়াও বইটিতে রয়েছে বেশ কিছু অবাক করা ঘটনা। বইটির অন্যতম আকর্ষণীয় জায়গা ছিল খলিফা হারুনের পুত্রের ঘটনা। যিনি খলিফার পুত্র হওয়া সত্ত্বেও খলিফার পুত্র হিসেবে তাঁকে দেখে চেনার মত কোন উপায়ই ছিল না। খুবই সাধারণভাবে জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিলেন এই যুবক।


আবদুল্লাহ ইবনু আবুল ফারাজ একবার তাঁর বাড়ির ধসে পড়া দেয়ালটি মেরামত করতে লোক খুঁজতে গিয়ে দেখেন, এক যুবক বাজারের শেষ প্রান্তে বসে আছে। তখন তিনি যুবকটিকে তাঁর ভাঙ্গা দেয়াল ঠিক করে দেয়ার জন্য বলেন। যুবকটি সম্মতি প্রকাশ করে জানায় যে দুটি শর্ত আছে-
- আপনি আমার কাজের বিনিময়ে আমাকে এক দিরহাম এবং আরেক দিরহামের ছয় ভাগের এক ভাগ দিবেন।
- নামাজের সময় হলে আমি আর কাজ করব না। নামাজ আদায় করতে চলে যাব। আপনার কাজ না করে আমি মালিকের সাথে নীরবে-নিভৃতে ইবাদাত করব।


এই যুবকটিই ছিলেন খলিফা হারুনের পুত্র, যাকে আবদুল্লাহ ইবনু আবুল ফারাজ কেবল ঐ যুবকের মৃত্যুর পরেই চিনতে পেরেছিলেন।
আবদুল্লাহ ইবনু আবুল ফারাজ যখন ঐ যুবকের মৃত্যুর পরে জানতে পারেন যে এই যুবক ছিল খলিফার পুত্র, তখন তিনি খলিফার কাছে জানতে চান তাঁর (খলিফার পুত্র) এরূপ অবস্থা হলো কী করে? তখন বাদশা উত্তরে বলেন,
এই দুনিয়ার প্রতি তাঁর কোন লোভ-লালসা ছিল না। এই ধূসর মরীচিকা নামক দুনিয়াতে অপরিচিত হয়ে চলতে সে পছন্দ করত। তাঁর খরচাদির জন্য তাঁর মায়ের কাছে অনেক টাকা দিয়েছি, কিন্তু সে তাঁর মায়ের থেকে অতিরিক্ত কোন টাকা-পয়সা গ্রহণ করত না। তাঁর মাও এখন দুনিয়াতে বেঁচে নেই। তুমি আজ যা জানালে, এর বাইরে আমিও পুত্র সম্পর্কে কিছুই জানতাম না।
খলীফা হারুন
কাব্যসাহিত্যে সমৃদ্ধ বই
এছাড়াও বইটিতে অসংখ্য যুগশ্রেষ্ঠ আলেমদের নানা উক্তি ও কবিতা উল্লেখ আছে। মুহাম্মাদ ইবনু জাফর রহিমাহুল্লাহ আবৃত্তি করেছেন,
গুরাবারা নত থাকে অপরাধীর মতো
ঋণগ্রস্ত হলে লোকে লুকিয়ে থাকে যত,
গুরাবারা জগত জুড়ে যে-এলাকায় থাকে,
দয়ার প্রভু সেইখানেতে রিযিক দিয়ে রাখে।
মুহাম্মাদ ইবনু জাফর রহিমাহুল্লাহ
ধৈর্যধারণ করা অত্যন্ত মহৎ গুণ। মুহাম্মাদ ইবনুল হুসাইন রহিমাহুল্লাহ বলেন,
যে ব্যক্তি সত্যিকার গুরাবাদের স্তরে পৌঁছুতে চায়, সে যেন তার পিতা-মাতা, ভাই-বোন, স্ত্রী বা অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনের রুঢ় আচরণের সম্মুখীন হলেও ধৈর্যধারণ করে।
মুহাম্মাদ ইবনুল হুসাইন রহিমাহুল্লাহ


বইটি যদিও খুব বড় পরিসরের নয় তবে এতে থাকা জ্ঞান আসলেও খুব বড় মাপের। বইটির অনুবাদকের প্রসংশা করতেই হয়, সহজ ও সাবলীলভাবে বইটি পাঠকদের কাছে উপস্থাপনের জন্য।
আরও পড়ুন: ক্রুসেড যুদ্ধের ইতিহাস
গুরাবা বইয়ের মূল লেখক সম্পর্কে
বইটির লেখক আবু বকর মুহাম্মদ ইবনুল হুসাইন ইবনু আবদুল্লাহ আল-আজুররী রহিমাহুল্লাহ বাল্যকাল থেকেই বাগদাদে ইলম শিক্ষা করতে মনযোগ দেন। ৩৩০ হিজরীতে তিনি পবিত্র ভূমি মক্কায় চলে আসেন এবং সেখানেই বসবাস করেন।
ইমাম ইবনু কাছির রহিমাহুল্লাহ বলেন,
দ্বীনের ব্যাপারে তিনি একজন সত্যবাদী আলেম ছিলেন।
ইমাম ইবনু কাছির রহিমাহুল্লাহ
আবু বকর আল-আজুররী রহিমাহুল্লাহ অনেকগুলো কিতাব রচনা করেন। যার মধ্যে আশ-শারীয়াহ, কিতাবুন নাসীহা, কিতাবুত তাওবা উল্লেখযোগ্য। ৩৬০ হিজরীর মুহাররাম মাসে তিনি পবিত্র ভূমি মক্কাতুল মুকাররামায় ইন্তেকাল করেন।
গুরাবা বই সম্পর্কে
- গ্রন্থের নাম: গুরাবা
- ভাষা: বাংলা
- মূল গ্রন্থের নাম: কিতাবুল গুরাবা
- মূল গ্রন্থের ভাষা: আরবি
- লেখক: আবু বকর আল-আজুররী (রহ.)
- অনুবাদক: সাইফুল্লাহ আল মাহমুদ
- সম্পাদক: আবদুল্লাহ আল মাসউদ
- প্রকাশনা: মাকতাবাতুল আসলাফ
- প্রথম প্রকাশ: মে ২০১৯
- মুদ্রিত মূল্য: ১৪৭ টাকা
- পৃষ্ঠাসংখ্যা: ১০০
প্রচ্ছদ চিত্রসূত্র: Wafilife