- সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়: বাংলা চলচ্চিত্রের মুকুটহীন মহারাজ (তৃতীয় পর্ব) - December 27, 2020
- প্রজেক্ট ম্যানহাটন: রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে শক্তির বিধ্বংসী ব্যবহার (পর্ব ১) - December 5, 2020
- সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়: বাংলা চলচ্চিত্রের মুকুটহীন মহারাজ (দ্বিতীয় পর্ব) - November 19, 2020
‘দা ফার্স্ট সিটি অফ লাইটস‘ এই একটি শব্দবন্ধই যথেষ্ট প্যারিস শহরের শানদার অবস্থা বোঝানোর জন্য। এরূপ একটি শহরকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য ফ্রেঞ্চ সরকার নিয়েছিল এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ যা শুনলেই মাথা চক্কর দিয়ে উঠবে! কেবল কোনো একটি এলাকা বা নির্দিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ভবন নয়, বরং পুরো শহরের একটি রেপ্লিকা তৈরি করেছিলেন তারা জার্মান বিমানের আচমকা বোমাবর্ষণের হাত থেকে এই সৌন্দর্যমন্ডিত শহরকে বাঁচাতে। তাহলে চলুন একটু পিছন থেকেই ঘুরে আসি না হয়!
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পটভূমি
১৯১৪ সালের ২৮ জুনের রৌদ্রোজ্জ্বল সকাল। অস্ট্রো হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকারী ডিউক ফার্নান্দ সস্ত্রীক বর্তমান সার্বিয়ার সারাজিভো রেল স্টেশনে অপেক্ষা করছিলেন। এমন অবস্থায়ই যুগোস্লাভিক জাতীয়তাবাদী চেতনার উগ্র এক কর্মী গাভ্রিলো প্রিন্সিপ তাকে হত্যা করেন। অতি সত্বরই অস্ট্রো হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্যের পক্ষ থেকে সার্বিয়ার উদ্দেশ্যে চরমপত্র জারি করা হয়। ঘটনা ধীরে ধীরে জটিল থেকে জটিলতর হতে থাকে। পানি গড়াতে থাকে বহুদূর।
শুরু মাত্র দুই দেশের মধ্যে হলেও জাতীয়তাবাদী চেতনার স্ফুরণ ঘটিয়ে উভয় পক্ষে এসে যোগ দেয় বহু রাষ্ট্র এবং সাম্রাজ্য। ঘটনার ধারাবাহিকতায় পুরো বিশ্ব দুই শিবিরে বিভক্তি হয়ে যায়। অক্ষ শক্তির অন্তর্ভূক্ত হয় অস্ট্রো হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্য, জার্মানী এবং অটোমান সাম্রাজ্য। আর বিপরীতে আছে মিত্র শক্তি যার অন্তর্ভুক্ত হলো ফ্রান্স, ব্রিটেন, রাশিয়া, সার্বিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্র।
কেনই প্যারিস
মিত্র শক্তির অন্যতম শক্তির উৎস ছিল ফ্রান্স, কারণ ঔপনিবেশিক যুগে ফ্রান্সের এক বিশাল প্রভাব ছিল আফ্রিকা, ভারত মহাসাগর এবং পূর্ব এশিয়ায়। তাই অর্থনৈতিক এবং কূটনৈতিক উভয় দিক দিয়েই তারা সমান গুরুত্ববহ ছিল। সাথে সাথে প্যারিস ছিল সারা পৃথিবীতে শিল্প সাহিত্য চর্চার অন্যতম প্রাণকেন্দ্র। আর তাই অক্ষ শক্তির চক্ষুশূল ছিল এই প্যারিস, কারণ প্যারিস এর বড় ধরনের কোনো ক্ষতি ফ্রান্সকে এবং তাদের জনগণকে মানসিকভাবে পর্যুদস্ত করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। ফ্রান্স কর্তৃপক্ষ নিজেও এই সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিল।
‘কিন্তু এটা তো একটা শহর!! হাজার হাজার মানুষ! কোনো ভবন তো না যে ঢেকে রাখবো!! এমনই ছিল কর্তৃপক্ষের ভাবনা।‘
কিন্তু আক্রমণের তীব্রতা বাড়ার সাথে সাথে তারা বুঝতে পারলেন যে, শহরকে হয়তো কোনো চাদর দিয়ে ঢেকে দেওয়া সম্ভব না, কিন্তু শত্রু সেনার চোখ তো ফাঁকি দেওয়া সম্ভব। সেই থেকেই এই পরিকল্পনা গ্রহণ করে কর্তৃপক্ষ। প্রশ্ন আসতেই পারে যে, এত সহজেই কী বোমারু বিমান কে ফাঁকি দেওয়া যায়? এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে যে, তখন পর্যন্ত কোনোরূপ বিমানেই রাডার এর ব্যবহার ছিল না! এই ব্যবহারই শুরু হয়েছিলো ১৯৩০ এর দশকে। বর্তমানের হিসেবে অবিশ্বাস্য মনে হলেও তখন যুদ্ধ বিমানগুলো নির্ভর করতো বৈমানিকদের দৃষ্টিক্ষমতার উপরে!!! আর এই কারণেই মূলত তাদের চোখকে ফাঁকি দেওয়ার জন্য এই পন্থা অবলম্বন করা হয়।
প্রথম ১৯১৪ সালের ৩০ আগস্ট জার্মান বিমান থেকে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিস এর উপরে বোমাবর্ষণ করা হয়। এক্ষেত্রে মূল কারণ ছিল দুইটি।
প্রথমত, প্যারিস এর ভৌগোলিক অবস্থান যা মানচিত্র দেখলে খুব সহজেই বুঝা যাবে।
মাত্র ৩০ কিলোমিটারের দূরত্বে থাকা প্যারিস ছিল জার্মান বোমারু বিমানের সবচেয়ে পছন্দের লক্ষ্যবস্তু।
দ্বিতীয়ত, ফ্রান্সের সম্পূর্ণ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ছিল প্যারিসকেন্দ্রিক। মানে প্যারিসকে নিজের কব্জা করতে পারার অর্থই ছিল ফ্রান্সকে নিজের করায়ত্ত করা। এই দুই কারণেই জার্মানি সর্বপ্রথম প্যারিসে বোমাহামলা শুরু করে। যদিও, তা প্রথমে ছিল আকস্মিক, কিন্তু ধীরে ধীরে এর মাত্রা বাড়তে থাকে, এবং শেষের দিকে এটি দৈনন্দিন ঘটনায় রপান্তরিত হয়ে যায়।
বোমাবর্ষণের ঘটনা বাড়ার সাথে সাথে তাদের চোখে পড়তে থাকে মিত্রশক্তির অন্যান্য বড় বড় শহর। এরকমই এক ঘটনা ঘটে ১৯১৭ সালের ১৩ জুন, মিত্রশক্তির অন্যতম শরিক গ্রেট ব্রিটেনের রাজধানী লন্ডনে। সেদিন প্রথমবারের মত দিনের আলোতে কোনো শহরে বোমাবর্ষণ করা হয় এবং তার মারাত্মক ক্ষয়ক্ষতি সবাইকে বিমর্ষ করে ফেলে। খুবই অল্প সময়ের মধ্যে শতাধিক বোমা নিক্ষেপ করা হয় এবং ১৮ জন স্কুল শিক্ষার্থীসহ মোট ১৬২ জন বেসামরিক ব্যক্তি নিহত হন। ইতিহাসে এই ঘটনা “The first Blitz” নামে পরিচিত।
নকল প্যারিস এর পরিকল্পনা
এই ঘটনার পরে নড়েচড়ে বসে ফ্রান্সের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা সংস্থা DCA (Defence Against Aircraft), তারা হন্যে হয়ে উপায় খুঁজতে থাকে। বিশেষজ্ঞদের থেকে মতামত চাওয়া হয় কী করা যেতে পারে এই অবস্থায়! অধিকাংশ বিশেষজ্ঞের মতামত অনুযায়ী ঠিক করা হয়, প্যারিস এর একটি রেপ্লিকা তৈরি করা হবে যা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে নকল প্যারিস নামে পরিচিত হবে । এমনকি পুরো ব্যাপারটিকে নিখুঁত করতে ডাকা হলো ফ্রেঞ্চ পাইলটদের। তাদের প্রশ্ন করা হলো, গভীর রাতে আক্রমণের ক্ষেত্রে তারা কোনো স্থানের ব্যাপারে কী করে নিশ্চিন্ত হয়ে থাকেন। উত্তর ছিল, এক্ষেত্রে তাদের মূল নজর থাকে গুরুত্বপূর্ণ ল্যান্ডমার্ক এর বিষয়ে যেমন ধরুন কোনো বিশেষ ভাস্কর্য বা স্থাপনা, কোনো বিশেষ বহুতল বিল্ডিং, নদী, প্রশস্ত রাজপথ বা রেললাইন। তাই, এই সমস্ত বিষয়ের পুঙ্খানপুঙ্খ রেপ্লিকা তৈরি করার নির্দেশ দেওয়া হয় যাতে নকল প্যারিস থেকে কোনোভাবেই শত্রুপক্ষের কারো সন্দেহের উদ্রেক না হয়।
নকল প্যারিস এর নির্মাণকাজ
১৯১৮ সালের একদম প্রথমাংশে কাজ শুরু হয়ে যায় নকল প্যারিস এর নির্মাণকাজ যার কোড নেম ছিল ‘প্রজেক্ট পারিস ২.০’। মোট তিন ভাগে এই নকল প্যারিস এর নির্মাণকাজ ভাগ করে নেওয়া হয়।
শহরের উত্তর – পূর্বাংশে একটি বৃহৎ রেল স্টেশনের রেপ্লিকা তৈরি করা হয়। শহরের উত্তর – পশ্চিমে প্যারিস এর সিটি সেন্টারের একটি রেপ্লিকা তৈরি করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়। শহরের পূর্বাংশে নেওয়া হয় সবচেয়ে দুঃসাহসী পদক্ষেপ। একটি ইন্ডাস্ট্রিয়াল জোন এর রেপ্লিকা তৈরি করার পরিকল্পনা করা হয়। তাছাড়া, শহরের ‘ কথিত প্রাণকেন্দ্র ‘ হিসেবে একে উপস্থাপন করতে আরো কিছু কৌশলের আশ্রয় নেওয়া হয়েছিল। লোকজনের আবাস আছে বুঝাতে নকল প্যারিস এর এই অংশের চারপাশে নকল (কাঠের তৈরি) রেললাইন তৈরি করা হয়। প্রচুর পরিমাণে বাতি লাগানো হয়। আবাসস্থল এবং শিল্পাঞ্চল; দুই জায়গাতেই এই পরিকল্পনা নেওয়া হয়।
এই কাজের তথা আলোকসজ্জার মূল দায়িত্ব দেওয়া হয়, মিত্রশক্তির আরেক শরিক ইতালির নাগরিক ফার্নান্দ জ্যাকোপজ্জি নামের একজন তড়িৎ প্রকৌশলীকে (এই কাজের সফলতা এবং কৃতিত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি পরবর্তীতে আইফেল টাওয়ারের আলোকসজ্জার দায়িত্ব পান)।
ফার্নান্দ জ্যাকোপজ্জি একটি অসাধারণ বুদ্ধিদীপ্ত আইডিয়া বের করেন এই নকল প্যারিস কে জার্মান সেনাদের কাছে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলার জন্য। তার প্রস্তাবনা ছিল এরূপ যে , ‘ নকল প্যারিস সম্পূর্ণরূপে আলোকিত করা হলেও তাতে এমন একটা ছাপ রাখতে হবে যাতে এরূপ প্রতীয়মান হয় যে, সরকার চেষ্টা করেছিল একটি সম্পূর্ণ ব্ল্যাক আউট এর জন্য, কিন্তু তাতে সফল হতে পারে নি। অন্যদিকে প্রকৃত প্যারিস শহর সম্পূর্ণরূপে ব্ল্যাক আউট পালন করবে সরকারি নির্দেশ অনুযায়ী।’ এই পরামর্শ অক্ষরে অক্ষরে পালন করা হয় এবং আলোকসজ্জার কিছু কিছু জায়গায় ইচ্ছাকৃভাবেই ফোঁকর রাখা হয়। তাছাড়া, শত্রুপক্ষের চোখকে ফাঁকি দিতে নকল প্যারিস এর উত্তর – পূর্বাংশের রেল স্টেশনে বেশ কিছু রেপ্লিকা ট্রেন রাখা হয়।
একটি সর্বোচ্চ লেভেলের গোপনীয় সামরিক প্রজেক্ট এবং একইসাথে দেশে যুদ্ধাবস্থা চলছিলো, তাই সাধারণ মানুষের কানে যাতে এই কথা না যায়, তার সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা নেওয়া হয়েছিল। সরকারের নীতিনির্ধারক বাদে কেউই এই পরিকল্পনার সম্পূর্ণ অংশ সম্পর্কে অবগত ছিলেন না। এই কারণেই খুব গোপনে কাজ চলেছিল।
পরিণতি
তবে এই শহরের আয়ু বেশিদিন ছিল না। এমনকি সম্পূর্ণ রূপে নির্মাণ কাজ শেষ করা সম্ভব হয়েছিল কীনা, তাইই আজ পর্যন্ত নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। ১৯১৮ সালের নভেম্বর মাসের ১১ তারিখ জার্মান সেনা আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করে। তারপরেই এই শহর তার উপযোগিতা হারিয়ে ফেলে। প্রকৃতপক্ষে ফরাসি সরকার এই শহর নির্মাণ করেছিল দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধের কথা মাথায় রেখে। তাই, দ্রুত সমাপ্তি কখনো কখনো এই যুদ্ধ সম্পর্কে ফরাসি সরকারের দূরদর্শিতা কে প্রকট করে তুলতে পারে। তবে যুদ্ধ শেষের সাথে সাথেই এই শহরকে Disassemble করার জন্য লেগে পড়ে সরকার যাতে তাদের এই যুদ্ধ কৌশল জার্মান বাহিনীর কানে না পৌঁছায়।
উপযোগিতা বিশ্লেষণের চিন্তা যদি করি, তবে এই শহরকে তার উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের বেলায় সফল ই বলা যায়। কারণ, সামরিক প্রতিবেদন না পাওয়া গেলেও এই বিষয়টি পরিষ্কার ছিল যে, এই শহর নির্মাণকাজ শুরু হওয়ার পর থেকে প্রকৃত প্যারিস শহরের উপরে বোমাবর্ষণ অনেকটাই কমে গিয়েছিল। হয়তো, একেবারে শুন্য হয়ে যায়নি; তবে পূর্বে লোকালয়ের উপরে বোমাবর্ষণ যেরূপ নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার ছিল, পরিস্থিতি তার থেকে বহুগুণে ভালো হয়ে যায়।
তবে এই প্রজেক্টের সাফল্য প্রশ্নবিদ্ধ হলেও ফার্নান্দ জ্যাকোপজ্জি এর সাফল্য কিন্তু কোনোভাবেই প্রশ্নবিদ্ধ নয়। এই প্রজেক্টে তার অবদানের স্বীকৃতস্বরূপ ফরাসি সরকার তাকে সর্বোচ্চ সম্মাননা ‘Legion d’Honneur’ এ ভূষিত করে। এর পাশাপাশি তিনি আইফেল টাওয়ার এবং আর্ক দো থ্রিয়োম্ফ এর আলোকসজ্জার ও দায়িত্ত্ব পান যা তাকে এই বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রভাবশালী একজন স্থাপত্যবিদের মর্যাদা দেয়।
ফিচার ইমেজ : culturetrip
আকর্ষণীয় একটি ব্যাপার নিয়ে মাশাআল্লাহ এত সুন্দর করে লেখার জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ। 😍
ভাই, তোমাকেও অনেক ধন্যবাদ।
মাশাল্লাহ, অনেক তথ্যবহুল লেখা। আর্টিকেলটি আমার বেশ মনে ধরেছে।সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো এটা না দেখলে আমি নকল প্যারিস সম্পর্কে জানতেই পারতাম না। অনেক ধন্যবাদ, ভাই।
ভাই, তোমাকেও অনেক ধন্যবাদ!!
[…] আরও পড়ুন: প্রথম বিশ্বযুদ্ধ এবং নকল প্যারিস […]