- বিচিত্র মানুষের বিচিত্র স্বভাব নিয়ে ব্যোমকেশের চিড়িয়াখানা - February 16, 2021
- রুলার অফ দ্য ওয়ার্ল্ড: মুঘল সাম্রাজ্যের স্বর্ণালী যুগের কারিগর সম্রাট আকবর - February 13, 2021
- ফ্রিডম অ্যাট মিডনাইট: দেশভাগের এক পূর্ণাঙ্গ আখ্যান - February 4, 2021
- উপন্যাসের নাম: চিড়িয়াখানা
- মূল আলোকপাতকৃত চরিত্র: ব্যোমকেশ
- লেখক: শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়
- ভাষা: বাংলা
- প্রকাশের সন: ১৯৫৩
- আইএসবিএন: ৯৭৮-০-১৪৩০৬১-৯৬-০
বাংলা কথাসাহিত্যে যে কয়জন পরিপক্ক, সাংসারিক এবং স্থিতধী গোয়েন্দা চরিত্রের দেখা পাওয়া গেছে, তাঁদের মধ্যে ব্যোমকেশ বক্সী সর্বাগ্রে আসবেন এটা নিশ্চিত। যদিও ব্যোমকেশ নিজে ‘গোয়েন্দা’ শব্দটি অপছন্দ করতেন, নিজেকে পরিচয় দিতেন ‘সত্যান্বেষী’ হিসেবে। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের সৃষ্ট এই গোয়েন্দা চরিত্র ‘সত্যান্বেষী ব্যোমকেশ বক্সী’ বাংলা ভাষার এক অমূল্য সম্পদ। মোট ৩২টি পরিপূর্ণ এবং একটি অসমাপ্ত উপন্যাস রয়েছে ব্যোমকেশকে নিয়ে। আজ আলোচনায় থাকছে শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যোমকেশকে নিয়ে লেখা চিড়িয়াখানা উপন্যাসটি।
স্বভাবগতভাবে মানুষ বড়ই বিচিত্র। একই পরিবারের দুই সন্তান যেখানে এক রকম হয় না, সেখানে পুরো মানবজাতির বৈশিষ্ট্য নিয়ে প্রশ্ন তোলা আসলেই বাতুলতা। সাধারণ মানুষের থেকে একজন অপরাধীর মন মানসিকতা আরো বেশি জটিল। আর তা যদি হয় দলগত বা সংঘবদ্ধ অপরাধ, তাহলে তো কথাই নেই।


আর একজন গোয়েন্দা যেহেতু এদের নিয়েই কাজ করেন, তাই তাঁকে রহস্যের জট খোলার জন্য আরো গভীরভাবে, একদম মূল থেকে কাজ করে আসতে হয়।
লেখক পরিচিতি
শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় ১৮৯৯ সালের ৩০ মার্চ ব্রিটিশশাসিত ভারতবর্ষের উত্তর প্রদেশের জৌনপুরে জন্মগ্রহণ করেন। কলকাতার বিদ্যাসাগর কলেজ থেকে তিনি স্নাতক সমাপ্ত করেন। ‘ব্যোমকেশ’ নিয়ে লেখা শুরু করার পূর্বে তিনি ‘বড়দা’ এবং ‘সদাশিব’ নিয়েও গল্প লিখেছেন।


উপন্যাসের পাশাপাশি তিনি প্রচুর ছোটগল্পও লিখেছেন। তার উল্লেখযোগ্য কিছু ছোটগল্প হলো জাতিস্মর, বিষকন্যা, শঙ্খকঙ্কণ প্রভৃতি।
তিনি জীবদ্দশাতেই ব্যোমকেশকে রঙিন পর্দায় দেখে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছেন। ১৯৬৭ সালে প্রখ্যাত সাহিত্যিক এবং নির্মাতা সত্যজিৎ রায় তাঁর লেখা ‘চিড়িয়াখানা’ গল্প অবলম্বনে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন।


এই চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যে ছিলেন লেখক শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেই।
প্রথিতযশা এই সাহিত্যিক ১৯৭০ সালের ২২ সেপ্টেম্বর ৭১ বছর বয়সে মহারাষ্ট্রের পুনে শহরে মৃত্যুবরণ করেন।
আরো পড়ুন: একটা দেশ যেভাবে দাঁড়ায়: লাখো তরুণের স্বপ্নজয়ের শক্তি
লেখনীর প্রকৃতি
‘অজিতবাবু, Blackmail শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ কি?’
‘আমি আমতা আমতা করিয়া বলিলাম, … Blackmail, গুপ্তকথা ফাঁস করে দেবার ভয় দেখিয়ে টাকা আদায় করা। যতদূর জানি এক কথায় এর বাংলা প্রতিশব্দ নেই।
কথোপকথন থেকে সহজেই অনুমেয় যে, এটি একটি গোয়েন্দা উপন্যাস। ১৯৫৩ সালে প্রকাশিত চিড়িয়াখানা গ্রন্থটি ব্যোমকেশ বক্সীর দীর্ঘদিনের বন্ধু অজিত বন্দ্যোপাধ্যায়ের জবানিতে। অধিকাংশ কথোপকথন প্রমিত চলিত ভাষায় সংঘটিত হলেও অজিত বন্দ্যোপাধ্যায়ের বর্ণনা ছিল সাধু ভাষায়। এই মিশ্র রীতির মূল কারণ হলো, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় যখন কিশোর বা সদ্য তরুণ, তখন বাংলা ভাষা ধীরে ধীরে সাধু থেকে চলিত রীতির দিকে যাত্রা করছিল। তাই উভয় রীতিরই রেশ লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
স্থান এবং কাল
উপন্যাসের স্থান ভারতের পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতা, এটা একদম দিনের আলোর মতন পরিষ্কার। তবে সময়কাল নিয়ে কিছু সংশয় আছে।


ব্যোমকেশ নিয়ে শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরবর্তী উপন্যাস ‘আদিম রিপু’ এর পর্দা নামে ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট মধ্যরাতে, যেসময় ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়। তাহলে মোটামুটিভাবে ধারণা করা যায় যে, এই উপন্যাস দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং ভারতের স্বাধীনতাপ্রাপ্তি অর্থাৎ ১৯৪৫ থেকে ১৯৪৭ এর মাঝামাঝি সময়ের।
চরিত্র বিশ্লেষণ
চিড়িয়াখানা উপন্যাসের সূচনায় দেখা পাওয়া যায় নিশানাথ সেনের। ভদ্রলোক ছিলেন বিচারক, কিন্তু মানসিক ভার বিবেচনা করে দ্রুত অবসর গ্রহণ করেন। তারপরে শহরের থেকে খানিকটা দূরে গিয়ে নিজের একটি খামার গড়ে তুলেন। সেই খামারে এসে জড়ো হয় সমাজের নানা শ্রেণির লোক। তাদের সম্পর্কে বলতে গিয়ে নিশানাথ সেন বলেছেন –
আমার গোলাপ কলোনিতে যারা আমার অধীনে কাজ করে, মালিদের বাদ দিলে তারা সকলেই ভদ্রশ্রেণির মানুষ, কিন্ত সকলেই বিচিত্র ধরনের লোক।
ঘটনাচক্রে নিশানাথ সেন খুন হন এবং সেই রহস্য সমাধানের দায়িত্ব পান ব্যোমকেশ বক্সী।
আরো পড়ুন: ফ্রিডম অ্যাট মিডনাইট: দেশভাগের এক পূর্ণাঙ্গ আখ্যান
দময়ন্তী সেন, নিশানাথের স্ত্রী। তার একটি ধোঁয়াশাপূর্ণ অতীত আছে। এই অতীতকে কাজে লাগিয়েই কেউ নিশানাথ সেনকে Blackmail করছিলেন। প্রাথমিক পর্যায়ে এই Blackmail এর রহস্য সমাধান করতেই ব্যোমকেশ বক্সীকে ডেকে আনা হয়েছিল। যদিও পরে নিশানাথ সেনের মৃত্যুতে রহস্যের মোড় ঘুরে যায়।
বিজয় এই উপন্যাসের আরেক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। নিশানাথ সেনের ভাইয়ের ছেলে বিজয়। নিশানাথের অনুপস্থিতিতে তার সম্পদের অধিকাংশের মালিকানা বিজয়ের হাতে যাবে।
নিশানাথ সেনের বন্ধু নেপাল গুপ্ত চিড়িয়াখানা উপন্যাসের আরেক চরিত্র। নিশানাথ সেনের জীবনের অতীত সম্পর্কে তিনি অবগত। রসায়নের অধ্যাপক ছিলেন, তাই নিশানাথের খামারের অধিকাংশ গাছপালার উপরে তিনি নিজের বৈজ্ঞানিক নিরীক্ষণ চালিয়ে থাকেন।
নেপাল গুপ্তের কন্যা মুকুল আরেক চরিত্র। নিশানাথ সেনের ভাইয়ের ছেলে বিজয়ের সাথে তার প্রণয়ের সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল। কিন্তু উপন্যাসের সমকালীন সময়ে সেই সম্পর্কের অবনতি ঘটে। নিজের বাবার মত হঠকারী নয়, বরং যথেষ্ট সতর্ক এবং সাবধান সে।
গোলাপ কলোনির চিকিৎসক ভুজঙ্গধর দাস। ইংল্যান্ডে প্র্যাকটিস চলাকালীন কোনো এক কেলেঙ্কারির কারণে তার লাইসেন্স কেড়ে নেয়া হয়। পরবর্তীতে দেশে ফিরে আসেন এবং গোলাপ কলোনিতে আশ্রয় নেন। কিছুটা ফুর্তিবাজ ধরনের হলেও যথেষ্ট সাবধানী।
বনলক্ষ্মী এই উপন্যাসের এক সন্দেহজনক চরিত্র। নিশানাথ সেনের ভাইয়ের ছেলে বিজয় তাকে গোলাপ কলোনিতে নিয়ে আসে। তার অতীত সম্পর্কেও তেমন বিস্তারিত জানা যায় না। ঘটনা চলাকালীন সময়ে বিজয়ের সাথে তার হৃদয়ঘটিত সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল।
আরো পড়ুন: চেনা সমাজের অন্তরালের কিছু কালরূপ নিয়ে – “ওরা কেউ না”
চলচ্চিত্র রূপান্তর
এই উপন্যাসকে এখন পর্যন্ত দুইবার চিত্ররূপ দেয়া হয়েছে। প্রথমবার ১৯৬৭ সালে নির্মাতা সত্যজিৎ রায় ‘চিড়িয়াখানা’ নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন যেখানে ব্যোমকেশ বক্সীর চরিত্রে উত্তম কুমার অভিনয় করেছেন।


পরবর্তীতে ২০১৬ সালে নির্মাতা অঞ্জন দত্ত পুনরায় চিড়িয়াখানা উপন্যাস অবলম্বনে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। এই চলচ্চিত্র ব্যোমকেশের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন অভিনেতা যীশু সেনগুপ্ত।


কোনো ধরনের স্পয়লার না দিয়ে গোয়েন্দা উপন্যাস সম্পর্কে আলোচনা করা সত্যিকার অর্থে খুবই কঠিন। তাই উপন্যাসের প্রকৃত স্বাদ নিতে চাইলে ধোঁয়া উঠা এক কাপ গরম চা সাথে নিয়ে বসে পড়ুন উপন্যাসটি পড়তে।