- বিচিত্র মানুষের বিচিত্র স্বভাব নিয়ে ব্যোমকেশের চিড়িয়াখানা - February 16, 2021
- রুলার অফ দ্য ওয়ার্ল্ড: মুঘল সাম্রাজ্যের স্বর্ণালী যুগের কারিগর সম্রাট আকবর - February 13, 2021
- ফ্রিডম অ্যাট মিডনাইট: দেশভাগের এক পূর্ণাঙ্গ আখ্যান - February 4, 2021
- প্রামাণ্যচিত্রের নাম: দ্য স্পাই ইন ইয়োর ফোন
- নির্মাতা: আল জাজিরা
- মুক্তির তারিখ: ৬ জানুয়ারি, ২০২১
- ভাষা: ইংরেজি
স্বাভাবিকভাবে আমাদের ফোনে আসা নানা রকমের বেনামী মেসেজ এবং তাদের মধ্যে থাকা লিঙ্কে ক্লিক করতে সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞগণ নিষেধ করে থাকেন। কেননা, সেই লিঙ্কে ক্লিক করা হলে ব্যবহারকারীকে সাথে সাথে অন্য একটি কৃত্রিম ওয়েবসাইটে রিডাইরেক্ট করা হয়, যেখান থেকে হ্যাকার ব্যবহারকারীর ডিভাইসের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। তো, এই হলো হ্যাকিংয়ের স্বাভাবিক পদ্ধতি। কিন্তু আমি যদি আপনাকে বলি যে, বর্তমান প্রযুক্তি ব্যবহার করে ব্যবহারকারীর কোনো ক্লিক করা ছাড়াই ব্যবহারকারীর ডিভাইসের নিয়ন্ত্রণ নেওয়া সম্ভব! আপনি কী বিশ্বাস করবেন? অবিশ্বাস্য মনে হলেও ২০২০ সালের মাঝামাঝি সময়ে আল জাজিরা অ্যারাবিক এর ত্রিশের অধিক সাংবাদিক এবং অনুসন্ধানকারী দলের মোবাইল ফোনের নিয়ন্ত্রণ নেয় হ্যাকার। সেই সূত্রে অনুসন্ধান করতে গিয়ে বের হয়ে আসে ইসরাইলি সংস্থা এনএসও সংক্রান্ত ভয়ংকর সব তথ্য।


২০২০ সালের জুন মাসে আল জাজিরার অনুসন্ধানী সাংবাদিক তামের আল মিশাল একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। যেখানে একজন ভারতীয় বিজনেস টাইকুনের সন্দেহজনক ঘনঘন সংযুক্ত আরব আমিরাতে ভ্রমণ এবং জনসাধারণের মেটাডাটার যথেচ্ছ ব্যবহারের নানা রকম তথ্যাদি প্রকাশিত হয়। তার কিছুদিন পরেই তামের আল মিশাল এবং তাঁর দলের অন্যান্য সাংবাদিকের মোবাইল ফোনে নানারকম অস্বাভাবিক বেনামী বার্তা আসতে থাকে। প্রথমে তেমন গা না করলেও পরবর্তীতে তামের আল মিশাল সিটিজেন ল্যাবের সহযোগিতা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ২০২০ সালের ১৯ জুলাই সিটিজেন ল্যাব রিপোর্ট দেয় যে, তামের আল মিশালের মোবাইল ফোন ‘প্যাগাসাস’ নামের স্পাইওয়ারের হ্যাকিংয়ের শিকার। এই প্যাগাসাসের ঠিকুজি বের করতে গিয়ে তাঁরা সম্মুখীন হন ভয়ংকর নানা ঘটনার।


ইউনিভার্সিটি অফ টরেন্টো’র একটি সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে ২০০১ সালে ‘সিটিজেন ল্যাব’ প্রতিষ্ঠিত হয়। মূলত তথ্যের গোপনীয়তা সংক্রান্ত নানা কাজে ব্যক্তিগত এবং প্রাতিষ্ঠানিক সেবা তারা প্রদান করে থাকেন। তাদের সেবাগ্রহীতাদের মধ্যে ছিলেন মুখ্যত সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ এবং মানবাধিকারকর্মী।


একটু পিছনে ঘুরে আসি। ২০১১ সালে সংযুক্ত আরব আমিরাত তাদের বেশ কিছু নাগরিককে রাষ্ট্রে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির জন্য গ্রেফতার করা হয়। মূলত তারা আমিরাতি রাজতন্ত্রের সমালোচনা করতেন এবং আরব আমিরাতে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করে যাচ্ছিলেন। তাঁদের মধ্যে আহমেদ মনসুর অন্যতম। ২০১৩ সালে আমিরাতি সরকার তাঁকে মুক্তি দেয়। তাঁকে সরকার মুক্তি দিলেও তাঁর উপরে গোপন নজরদারি চলতে থাকে।
২০১৬ সালের মাঝামাঝি থেকে আহমেদ আল মনসুর তাঁর মোবাইল ফোনে নানা অস্বাভাবিক কার্যক্রম লক্ষ করেন। প্রথমত তিনি একে কোনো হ্যাকিং ভাবতে চাননি, কেননা তাঁর কাছে এমন কোনো অস্বাভাবিক বার্তা বা লিঙ্ক আসেনি, যাতে অসাবধানতাবশত ক্লিক করার কারণে তাঁর ডিভাইসের নিয়ন্ত্রণ হ্যাকারের কাছে গিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে তিনি আগস্ট মাসের ১০ তারিখ সিটিজেন ল্যাবের কাছে কারিগরি সাহায্যের আবেদন করেন যাতে তাঁর মোবাইলটি হ্যাক হয়েছে কী না জানা যায়।


আহমেদ মনসুরের সন্দেহ সত্যি প্রমাণিত হয়। ২৫ আগস্ট সিটিজেন ল্যাব প্রকাশ করে যে আহমেদ মনসুরের ফোনে প্যাগাসাস নামের একটি স্পাইওয়ার দ্বারা হ্যাকড এবং এটি তৈরি করছে ইসরাইলের এনএসও গ্রুপ টেকনোলজিস নামের একটি প্রতিষ্ঠান। ২০১৯ সালে সংযুক্ত আরব আমিরাত সরকার আহমেদ আল মনসুরকে গ্রেপ্তার করে এবং আদালত তাঁকে ১০ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন।
তদন্তে বের হয়ে আসে, ইসরাইলি প্রযুক্তি সংস্থা এনএসও এর সাথে যুক্ত। ২০১০ সালে এনএসও গ্রুপ টেকনোলজিস প্রতিষ্ঠিত হয়। এর প্রতিষ্ঠাতা সকলে ইসরাইলি ইন্টেলিজেন্স ইউনিট ৮২০০ এর প্রাক্তন সদস্য। এই ইউনিটের মূল কাজ হলো সিগন্যাল ইন্টেলিজেন্স এবং তথ্য বিশ্লেষণ। আদতে এরূপ কাজের আড়ালে এটি জনসাধারণের যাবতীয় তথ্যে আড়ি পাতে।


প্যাগাসাস নামের স্পাইওয়ারটি ২০১১ সালে তৈরি করে তারা এবং এর মূল বৈশিষ্ট্য হলো, এটি কোনো রিডাইরেক্ট লিঙ্ক ছাড়াই ব্যবহারকারীর ডিভাইসের নিয়ন্ত্রণ নিতে পারে এবং ডিভাইসের মধ্যে আসা যাওয়া সকল তথ্য রিড করতে পারে।


আরো পড়ুন: কৃত্রিম মাংস: ভবিষ্যৎ পৃথিবীর সম্ভাব্য আমিষ উৎস (পর্ব ১)
এনএসও এর ওয়েবসাইটে প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী তারা কেবল সরকারি নিরাপত্তা সংস্থার কাছেই চড়া মূল্যে ‘প্যাগাসাস’ বিক্রি করছে। আহমেদ মনসুরের মোবাইল ফোন বিশ্লেষণ করে প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায়, ঐ ডিভাইসের হ্যাকিং করা হয়েছিল সংযুক্ত আরব আমিরাতের কোনো সার্ভার থেকে। পরবর্তীতে সৌদি আরবের অনেক নাগরিকের মোবাইল ফোন এবং অন্যান্য ডিভাইসের নজরদারির জন্য ব্যবহারকারী কর্তৃক অনুরোধের প্রেক্ষিতে তারা দেখেন, প্যাগাসাস সৌদি আরবের সার্ভার থেকে। এ থেকে আশঙ্কা করা হচ্ছে যে, ইতোমধ্যে বেশ কিছু দেশ ইসরাইলের প্যাগাসাস স্পাইওয়ার ক্রয় করেছে। যদিও এনএসও গ্রুপ কোনো ব্যক্তিমালিকানাধীন সংস্থার কাছে প্যাগাসাস বিক্রয় করবে না বলে ঘোষণা দিয়েছে, কিন্তু সিগন্যাল ইন্টেলিজেন্সের কাজের জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামোর প্রাথমিক ব্যয় যে পরিমাণে উচ্চ, তাতে কে প্রকৃতপক্ষে এনএসও এর অর্থায়ন করছে, তা ধোঁয়াশার সৃষ্টি করেছে।
২০২০ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর সংযুক্ত আরব আমিরাত আনুষ্ঠানিকভাবে ইসরাইলের সাথে বাণিজ্যিক এবং আন্তর্জাতিক চুক্তি স্বাক্ষর করে। এর পূর্ব থেকেই গোপনে তাদের মধ্যে কারিগরি এবং প্রযুক্তিগত সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল। চুক্তি পরবর্তী পরিস্থিতিতে তাদের এই সম্পর্ক আরো জোরালো হবে। কে জানে, এনএসও গ্রুপ হয়তোবা আরব আমিরাতেই তাদের কার্যালয় প্রতিষ্ঠার সুযোগ পাবে।


মধ্যপ্রাচ্যের অধিকাংশ দেশে বিদ্যমান রাজতন্ত্রের প্রতি মানুষের নাভিশ্বাস উঠে গেছে। সাংবাদিক, রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ এবং মানবাধিকার কর্মীগণ তাদের কার্যক্রমের কারণে নিজ নিজ দেশের সরকারের চক্ষুশূল হয়ে উঠেছেন। এই অবস্থায় মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে এই স্পাইওয়ারের ব্যবহার জনসাধারণের মতামত প্রকাশের অধিকারকে পুনরায় বাধাগ্রস্থ করবে। এছাড়াও মেক্সিকোতে সাম্প্রতিক সময়ে প্রশাসন কর্তৃক নির্দিষ্ট কিছু ব্যক্তিকে নজরদারি করার জন্য প্যাগাসাস ব্যবহারের অভিযোগ উঠেছে।
এক আজব বিশ্বে বাস করছি আমরা। প্রযুক্তি ছাড়া এক মুহূর্ত যেমন বাস করা সম্ভব না, ঠিক তেমনই ভাবে প্রযুক্তি আমাদের নিত্যদিনের ব্যক্তিগত গোপনীয়তাকে ধ্বংস করে ফেলেছে। তথ্যপ্রযুক্তি বিপ্লবের মূল উদ্দেশ্য ছিল যেখানে মানুষের পরিশ্রম কমিয়ে মানুষের জীবনকে সুরক্ষিত করা, সেখানে মানুষের ব্যক্তিগত তথ্য আজ বিভিন্ন টেক জায়ান্টদের কাছে ব্যবসার উপকরণ। ভবিষ্যতের পৃথিবীতে আমাদের জন্য কী অপেক্ষা করছে, তা কেবল ভবিষ্যতেই জানা যাবে।