- বিচিত্র মানুষের বিচিত্র স্বভাব নিয়ে ব্যোমকেশের চিড়িয়াখানা - February 16, 2021
- রুলার অফ দ্য ওয়ার্ল্ড: মুঘল সাম্রাজ্যের স্বর্ণালী যুগের কারিগর সম্রাট আকবর - February 13, 2021
- ফ্রিডম অ্যাট মিডনাইট: দেশভাগের এক পূর্ণাঙ্গ আখ্যান - February 4, 2021
একটি ছেলে, গ্রামের ছেলে। দরিদ্র, কিন্তু sensitive। বাপ পুরুত, মারা গেলো। ছেলেটি শহরে এলো। সে পুরুতগিরি করবে না, পড়বে। Ambitious, পড়বে। শিক্ষার ভেতর দিয়ে, struggle এর ভিতর দিয়ে, আমি দেখতে পাচ্ছি, তার কুসংস্কার, গোঁড়ামি সমস্ত কেটে যাচ্ছে। বুদ্ধি দিয়ে ছাড়া সে কোনো কিছু মানতে চাইছে না। কিন্তু তার কল্পনাশক্তি আছে, তার অনুভুতি আছে। ছোটখাটো জিনিস তাকে মুগ্ধ করছে। তাকে আনন্দ দিচ্ছে। হয়তো তার ভেতরে মহৎ একটা কিছু করার ক্ষমতা আছে, সম্ভাবনা আছে। কিন্তু করছে না।
কিন্তু সেটি শেষ কথা নয়। সেটি tragedyও নয়। সে মহৎ কিছু করছে না, তার দারিদ্র যাচ্ছে না। তার অভাব মিটছে না। কিন্তু তা সত্ত্বেও সে জীবনবিমুখ হচ্ছে না। সে পালাচ্ছে না। Escape করছে না। সে বাঁচতে চাইছে। সে বলছে, বাঁচার মধ্যেই সার্থকতা, তার মধ্যেই আনন্দ। He wants to live.
জীবনবোধের এমন পাঠ কে কবে দিয়েছিল বাঙালিকে বড় পর্দায়? বেঁচে থাকাই এই পৃথিবীতে যে সবচেয়ে বড় অর্জন, বাঙালির সামনে বড় পর্দায় এই কথা প্রথম বলেছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। হোক সে প্রদোষ চন্দ্র মিত্র অথবা উদয়ন পণ্ডিত, অথবা হোক না সে কালজয়ী অপূর্ব কুমার রায় (ওরফে অপু); যত বহুমুখী সৃষ্টিই হোক না কেন, তারা তো আটকে ছিল বইয়ের নিশ্চল অক্ষরের মাঝে! বন্দি ছিল পাঠাগারের চার দেয়ালের মাঝে! কার গুণেই তারা বের হয়ে আসলো? বাঁধা পড়লো সেলুলয়েডের পর্দায়! সে যে চিরতরুণ, চির প্রাণোচ্ছল সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।
মোহিতকুমার চট্টোপাধ্যায় এবং আশালতা চট্টোপাধ্যায়ের ঘরে ১৯৩৫ সালের ১৯ জানুয়ারি কলকাতার শিয়ালদহ স্টেশনের কাছে মির্জাপুর স্ট্রিটে জন্মগ্রহণ করেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। তাঁর জন্মের কিছুদিন পরেই তাঁরা সপরিবারে কৃষ্ণনগরে স্থানান্তরিত হন। বিখ্যাত নাট্যকার দ্বিজেন্দ্রলাল রায় ছিলেন এই কৃষ্ণনগরেরই বাসিন্দা। সেই সূত্রে এই এলাকায় নাট্যচর্চার বেশ বড় একটা আবহ বিরাজ করতো প্রায় সবসময়ই।


সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের বাসার আশেপাশেই বেশ কিছু নাট্যচর্চার থিয়েটার ছিল। তাঁরা সারা বছরই নানাবিধ অনুষ্ঠানের আয়োজন করতো। তাঁর পিতামহ এমনই এক স্থানীয় নাট্যচর্চার থিয়েটারের সাথে যুক্ত ছিলেন সভাপতি হিসেবে। তাঁর সরকারি চাকুরিরত বাবাও নিজের চাকরির পাশাপাশি শখের বশে ঐ একই থিয়েটারে মাঝে মাঝে অভিনয় করতেন।
আশেপাশের এরূপ পরিবেশ এবং পরিবারের মাঝে সাংস্কৃতিক আবহ বজায় থাকার কারণে এটি অনুমিতই যে, ধীরে ধীরে সৌমিত্র নিজেও এই নাট্যচর্চার সাথে যুক্ত হয়ে যাবেন। স্কুলে থাকাকালীন বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তিনি অভিনয় করতেন এবং সাথে সাথে তিনি নিজেও বেশ কিছু থিয়েটারের সাথে যুক্ত হয়ে যান। স্কুল ত্যাগ করার পূর্বেই নাট্যচর্চা তাঁর জীবনের বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
নাট্যচর্চার পাশাপাশি তিনি নিজের পড়াশোনা চালিয়ে যেতে থাকেন। কিছুদিন পরে তাঁরা সপরিবারে কৃষ্ণনগর ছেড়ে চলে আসেন হাওড়াতে। সেখানে তিনি ভর্তি হন হাওড়া জেলা স্কুলে। এখান থেকে মাধ্যমিক সমাপ্ত করে তিনি ভর্তি হন কলকাতা সিটি কলেজে। কলেজে লেখাপড়ার পাশাপাশি তাঁর নাট্যচর্চাও জোর কদমে চলতে থাকে।
কলেজে থাকাকালীন তাঁর সামনে এক অসামান্য সুযোগ আসে। বাংলা থিয়েটার তৎকালীন বাঙালি সমাজে নাট্যচর্চার মূলকেন্দ্র ছিল। অহীন্দ্র চৌধুরী ছিলেন বাংলা থিয়েটারের একজন প্রখ্যাত নাট্যনির্দেশক। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় সরাসরি তাঁর অধীনেই কাজ শুরু করার সুযোগ পান। তাঁর অধীনে থেকে তিনি নাটক বিষয়ে অনেক কিছু জানার সুযোগ পান।


বাংলা সাহিত্যে স্নাতক সম্মান নিয়ে তিনি হাওড়া কলেজ থেকে ভর্তি হন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। এখান থেকে স্নাতকোত্তর সমাপ্ত করেন বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে। এই সময়ই তিনি শিশির ভাদুড়ির সংস্পর্শে আসেন। তাঁর অধীনে তিনি কাজ করতে শুরু করেন। শিশির ভাদুড়ির বেশ কিছু নাটকে তিনি অভিনয় করেন। শিশির ভাদুড়ির সাথে কাজের অনবদ্য অভিজ্ঞতার কারণেই তিনি আজীবন এই শিল্পের সাথে থাকার ব্যাপারে মনস্থির করে ফেলেন। এরই পাশাপাশি তিনি স্নাতকোত্তরও সমাপ্ত করে ফেলেন।


শিশির ভাদুড়ির সাথে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের দেখা হয় শিশির ভাদুড়ির জীবনের একদম শেষের দিকে। ততদিনে তিনি থিয়েটার জীবন থেকে নিজেকে প্রায় গুটিয়ে ফেলেছিলেন বলা চলে। কিন্তু তা সত্ত্বেও সৌমিত্রের কর্মস্পৃহা শিশির ভাদুড়িকে আকৃষ্ট করেছিল। তাই তিনি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে বেশ কিছু নাটকে অভিনয়ের সুযোগ করে দেন। ১৯৫৯ সালের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি সৌমিত্রের জীবনে একজন গুরু এবং পথনির্দেশক হিসেবে ছিলেন।
নাট্যচর্চার পাশাপাশি তিনি রোজগারের চেষ্টাও শুরু করেন। উদার, গম্ভীর এবং ভরাট আওয়াজের কারণে তিনি সহজেই অল ইন্ডিয়া রেডিওতে উপস্থাপকের চাকরি পেয়ে যান। এই চাকরি করার পাশাপাশি তিনি নাটক এবং চলচ্চিত্রে কাজের চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকেন।
এদিকে চুপিসারে অন্য ঘটনা ঘটতে শুরু করেছে। ১৯৫৫ সালের দিকের ঘটনা। কলেজ পড়ুয়া ২০ বছরের সদ্য তরুণ সৌমিত্র গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। প্রায়শই বন্ধু বান্ধবদের সাথে নিয়ে চলে যান নাট্যমঞ্চে অথবা কোনো চলচ্চিত্রের শুটিংয়ে। সেই সূত্রে তাঁর একদিন সাক্ষাৎ হয় সত্যজিৎ রায়ের সাথে। সত্যজিৎ রায় তাঁর ‘অপরাজিত’ চলচ্চিত্রের জন্য সম্পূর্ণ নতুন কোনো মুখ খুঁজছিলেন। সৌমিত্রকে দেখে সত্যজিৎ রায়ের মনে ধরলো। কিন্তু ‘অপরাজিত’ চলচ্চিত্রে কিশোর অপূর্বের চরিত্রে অভিনয়ের জন্য সৌমিত্রের বয়স ছিল বেশি। তাই ‘অপরাজিত’ চলচ্চিত্রে তাঁকে নেওয়া সম্ভব হয়নি।
কিন্তু সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কথা সত্যজিৎ রায়ের মাথায় ছিল।
আরো পড়ুন: প্রণব মুখার্জি: এক বর্ণাঢ্য জীবনের পরিসমাপ্তি


১৯৫৮ সালে একদিন তিনি গিয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়ের ‘জলসাগর’ চলচ্চিত্রের শুটিং সেটে। বের হবেন, এমন সময় তাঁকে ধরে সত্যজিৎ রায় নিয়ে গেলেন অভিনেত্রী ছবি বিশ্বাসের কাছে। বললেন,
এ হলো সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। আমার পরবর্তী চলচ্চিত্র ‘অপুর সংসার’ এ অপুর ভূমিকায় অভিনয় করবে সৌমিত্র।’
এক মুহূর্ত আগেও তিনি জানতেন না এই খবর। হঠাৎ করেই পরিচালকের মুখে এই কথা শুনে তিনি স্তম্ভিত হয়ে যান। নাটকে নিয়মিত অভিনয় করলেও কখনো চলচ্চিত্রে অভিনয়ের সুযোগ হয়নি তাঁর। তাও একেবারে বড় পর্দায়! সৌমিত্র ভাবছিলেন, কেনই বা তাঁকে এত বড় চরিত্রে বাছাই করা হলো। কারণ, তিনি জানতেন, আর যাই হোক না কেন, তাঁর চেহারা ঠিক সেই অর্থে নায়কোচিত না।
কিন্তু বিধাতা হয়তো ভাগ্যে রেখছিলেন অন্য কিছু। তাই তিনি সৌমিত্রের ভাবনার মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন খুব দ্রুতই। ১৯৫৮ সালের ৯ আগস্ট, ‘অপুর সংসার’ চলচ্চিত্রের শুভ মহরত অনুষ্ঠান। এক শটেই তিনি তার প্রথম দৃশ্য ঠিকঠাক করতে পেরেছিলেন। চলচ্চিত্রে নবাগত এই সদ্য তরুণ তাঁর প্রথম ঝলকেই পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের মন জিতে নিয়েছিলেন। হঠাৎ করেই তিনি বুঝতে পারলেন, এই চলচ্চিত্রই তাঁর আসল ঠিকানা। তাঁর মেধার পরিপূর্ণ স্ফুরণ কেবলমাত্র এখানেই সম্ভব।
জমিয়ে চললো ‘অপুর সংসার’ চলচ্চিত্রের শুটিং। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর জান-প্রাণ উজাড় করে দিয়েছিলেন। তাঁর বয়স কিছুটা কম ছিল গল্পের অপুর তুলনায়। তাই চেহারায় ভারিক্কি ভাব আনতে এবং কিছুটা বেশি বয়সী দেখাতে সত্যজিৎ রায় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে দাঁড়ি সহ উপস্থাপন করেন।


পরবর্তীতে এক সাক্ষাৎকারের সময় সত্যজিৎ রায় উল্লেখ করেছিলেন,
দাঁড়িসহ সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে দেখে আমার সবসময় তরুণ বয়সের রবীন্দ্রনাথের কথা মনে পড়তো।১


১৯৫৯ সালের পহেলা মে ‘অপুর সংসার’ মুক্তি পায়। মুক্তির পরপরই সকলের মন জয় করে নেয় ‘অপুর সংসার’।


সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এবং শর্মিলা ঠাকুরের সহজ সরল কিন্তু জীবনঘনিষ্ঠ অনবদ্য অভিনয় সকলের হৃদয় ছুঁয়ে যায়।


পাশাপাশি সমালোচকেরা চলচ্চিত্রের সকল কলাকুশলীর প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে যান। ১৯৫৯ এবং ১৯৬০ সাল, এই দুই বছর জুড়ে ‘অপুর সংসার’ বেশ কিছু জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পুরষ্কার লাভ করে। পাশাপাশি স্বভাবজাত অভিনেতা হিসেবে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের নাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে।
তথ্যসূত্র:
গ্রন্থসূত্র:
- ১ রায়, সত্যজিৎ (২০০৭)। সত্যজিৎ রায়: ইন্টারভিউজ। মিসিসিপি বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশনী। ISBN – 978-1-57806-937-8
দ্বিতীয় পর্ব পড়ুন: সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়: বাংলা চলচ্চিত্রের মুকুটহীন মহারাজ (দ্বিতীয় পর্ব)
প্রচ্ছদ চিত্রসূত্র – উইকিমিডিয়া কমন্স