- দ্য স্পাই ইন ইয়োর ফোন: এনএসও কর্তৃক তথ্যের বিপজ্জনক ব্যবহার - January 22, 2021
- এক পৃথিবী, এক রাষ্ট্র: বাস্তব নাকি কেবলই ধূসর কল্পনা - January 18, 2021
- সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়: বাংলা চলচ্চিত্রের মুকুটহীন মহারাজ (তৃতীয় পর্ব) - December 27, 2020
যেকোনো দুর্ঘটনাই আমাদের কাছে অপ্রত্যাশিত, সেটা ছোট হোক বা বড়। যেকোনো দুর্ঘটনাই কোনো না কোনো ক্ষতি করে যায় আমাদের। সেটা অঙ্গহানি, সাময়িক বা দীর্ঘস্থায়ী স্মৃতিভ্রম বা শরীরের কোনো স্থায়ী ক্ষতি। কিন্তু সার্ফ এক্সেল এর একটা বিজ্ঞাপনের কথা নিশ্চয়ই সবার মনে আছে , “দাগ থেকে যদি দারুণ কিছু হয়, তবে দাগই ভালো।” আবার আমরা প্রায়শই একটা কথা বলি, ‘সৃষ্টিকর্তা আমাদের কোনো একদিকের অভাব ঠিকই অন্যদিক দিয়ে পুষিয়ে দেন।’ সাভান্ট সিনড্রোম এর সাথে এই দুইটি কথাই যেনো সবচেয়ে বেশি যুক্তিযুক্তভাবে যায়। প্রায় সোয়া শত বছর ধরে সাভান্ট সিনড্রোম আমাদের সামনে তার রহস্যের ডালি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান এখন পর্যন্ত এর কোনো কারণ বা সমাধান আবিষ্কার করতে পারেনি।
সাভান্ট সিনড্রোম কি আশীর্বাদ নাকি অভিশাপ ?
প্রায়শই একটি বিতর্ক চলমান যে, সাভান্ট সিনড্রোম কী কোনো রোগের অন্তর্ভুক্ত নাকি? তবে সব মিলিয়ে চিকিৎসক এবং মনোবিশেষজ্ঞরা এই বিষয়ে একমত হয়েছেন যে, এটি কোনো রোগ নয়। বরং এটি এক ধরনের অস্বাভাবিকতা যা যেকোনোরূপ নিউরোডেভেলপমেন্টাল সংক্রান্ত সমস্যার কারণে পরিদৃষ্ট হয়।
এখন চলুন জানা যাক, কেন কিছু ক্ষেত্রে সাভান্ট সিনড্রোমকে আশীর্বাদ বলছি আমরা সবাই। এর মূল কারণ হলো, সাভান্ট সিনড্রোমের শিকার প্রায় সকলেই কোনো একটি নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে অসম্ভব দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, তাদের মধ্যে কেউ কেউ গণিতে অভাবনীয় দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন, কেউবা নিজেকে চলন্ত ক্যালেন্ডার হিসেবেও প্রমাণিত করেছেন, কেউ আবার চিত্রাঙ্কন এর ক্ষেত্রে অসামান্য সাফল্য লাভ করেছেন। এরকম নানাবিধ উদাহরণের কারণেই এটি সাধারণ মানুষের মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে স্থান দখল করেছে।


এক্ষেত্রে, একটি বিষয় পরিষ্কার করে নেওয়া প্রয়োজন। এই সাভান্ট সিনড্রোম কোনোভাবেই অটিজম স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডার এর সাথে সম্পৃক্ত না। অনেকেই এই অস্বাভাবিকতাকে ঠিকভাবে বুঝতে না পারার কারণে একে অটিজম স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডার এর সমকক্ষ বলে ধরে নেন। তাছাড়া আমাদের সমাজ এখনও পর্যন্ত কারো এরূপ অভাবনীয় দক্ষতাকে ভালোভাবে গ্রহণ করতে প্রস্তুত নয়। এই কারণেই প্রায়শই এরূপ দক্ষতার অধিকারী ব্যক্তি সামাজিক হেনস্তার শিকার হয়ে থাকেন বা সমাজের মানুষের কুরুচিপূর্ণ বাক্যবাণে জর্জরিত হন। তবে সাম্প্রতিক এক সমীক্ষার তথ্য অনুযায়ী, গড়ে প্রতি ১০০ জন সাভান্ট এর মধ্যে ১ জন অ্যাসপার্জার্স সিনড্রোমের শিকার। তাই কোনোভাবেই সাভান্ট সিনড্রোম এবং অ্যাসপার্জার্স সিনড্রোমকে মিলানো উচিত না।
শব্দবন্ধের উৎপত্তি ও ইতিহাস
সাভান্ট শব্দের উৎপত্তি ফরাসি শব্দ ‘savoir’ থেকে যার অর্থ হলো ‘জানা’ প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, সর্বপ্রথম ১৮৮৭ সালে ব্রিটিশ চিকিৎসক জন ল্যাংডন ডাউন ( যিনি ডাউন সিনড্রোম এর তত্ত্বের প্রবর্তক) একে চিহ্নিত করেন। তিনি একে ‘ইডিয়ট সাভান্ট’ নামে চিহ্নিত করেন। কিন্তু পরবর্তীতে এই বিবেচনায় এই নামটি বাদ দেওয়া হয় যে, সাভান্টদের মধ্যে অনেকেই সমাজে স্বাভাবিকভাবে বসবাস করছেন এবং তাদের এই বিশেষ ক্ষমতা এর কারণে অনেকেরই অন্যকোনো ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য হারে কোনোরূপ অতিরিক্ত প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হননি। তাই পরবর্তীতে এই শব্দটিকে সংশোধন করে ‘সাভান্ট সিনড্রোম’ করা হয়।
সাভান্ট সিনড্রোম এর কারণ
আবিষ্কারের প্রায় সোয়া শত বছর হয়ে গেলেও আমরা এখন পর্যন্ত সাভান্ট সিনড্রোম এর প্রকৃত কারণ সম্পর্কে জানতে পারিনি। সাভান্ট সিনড্রোম কি কোনোভাবে জিনগত নাকি, এই জিজ্ঞাসা মানুষের বহুদিনের। এই জিজ্ঞাসার জবাব খোঁজার জন্য ২০০৩ সালে ডক্টর এরিকা নুরমি এবং ভ্যান্ডারবিট বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর সহকর্মীরা মিলে গবেষণা আরম্ভ করেন।


তাঁদের কাজের মূল উদ্দেশ্য ছিল কত শতাংশ অ্যাসপার্জার্স সিনড্রোমে আক্রান্ত মানুষের মধ্যে সাভান্ট সিনড্রোম এর লক্ষণ খুঁজে পাওয়া যায়। তাঁদের এই গবেষণাপত্র ‘জার্নাল অফ দা অ্যামেরিকান অ্যাকাডেমি অফ চাইল্ড এডোলেসেন্ট সাইকিয়াট্রি‘ নামের জার্নালে প্রকাশিত হয়। গবেষণাপত্রের শিরোনাম ছিল ‘Journal of the American Academy of Child Adolescent Psychiatry.’
তারা এই গবেষণাপত্রে প্রকাশ করেন যে, সাভান্ট সিনড্রোম এর পেছনে বেশ কিছু জিন দায়ী থাকতে পারে। তারা তাদের গবেষণার কাজে মোট ৯৪টি মাল্টিপ্লেক্স পরিবার (যে পরিবারে একাধিক সদস্য অ্যাসপার্জার্স সিনড্রোমের শিকার) তাদেরকে নিয়ে পর্যালোচনা করেন। তাদের গবেষণা থেকে প্রাপ্ত ফল অনুসারে এই ৯৪টি পরিবারের মধ্যে মাত্র ২১টি পরিবারের মধ্যে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে সাভান্ট সিনড্রোম এর লক্ষণ দেখা গেছে। বাকি ৭৩টি পরিবারের মধ্যে তেমন কোনো সাভান্ট সিনড্রোম এর লক্ষণ দেখা যায়নি।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছিল এই গবেষণাপত্রে, তা হলো এই ২১টি পরিবারের সদস্যদের মধ্যে ১৫তম ক্রোমোজোমের 15q11-q13 প্রোটিনটি তুলনামূলক অধিক সক্রিয় এবং এই সক্রিয় হওয়ার প্রবণতা বাকি ৭৩টি পরিবারের মাঝে অনেক কম। তবে এখন পর্যন্ত এই প্রোটিনের সাথে সাভান্ট সিনড্রোম এর সম্পর্কের ব্যাপারে নিশ্চিত না হওয়া গেলেও এই উপাত্ত পরবর্তীতে এই সংক্রান্ত অন্যান্য গবেষণাকে উদ্বুদ্ধ করেছে।
তবে যাদের পরিবারে এখন পর্যন্ত কোনোরূপ অ্যাসপার্জার্স সিনড্রোমের শিকার কেউ নেই, তাদের ক্ষেত্রে কীভাবে এই সাভান্ট সিনড্রোম কী করে উদ্ভূত হয়, এই গবেষণাপত্র তা ব্যাখ্যা করতে পারে না। এই ধরনের উদাহরণগুলোকে চিকিৎসাবিজ্ঞানে ‘এ্যাকুয়ার্ড সাভান্ট’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। এইসব উদাহরণের ক্ষেত্রে যা দেখা যায়, তা হলো, এমন কোনো বড় ধরনের আঘাত যার দ্বারা মস্তিষ্কের মৌলিক গঠনগত পরিবর্তন আসতে পারে, এরূপ দুর্ঘটনার দ্বারাই এ্যাকুয়ার্ড সাভান্ট ঘটতে পারে।


এক পক্ষের মতামত হলো, মূলত আমাদের সবার মধ্যেই এরূপ লুকায়িত সাভান্ট সিনড্রোম থাকে। যা বড় ধরনের আঘাতের দ্বারাই অ্যাক্টিভেটেড হতে পারে। আরেক পক্ষের মতামত হলো, সাভান্ট সিনড্রোম সংক্রান্ত গুণাবলিসমূহ এক্টিভেটেড হওয়ার জন্য যে সবসময়ই বাহ্যিক আঘাতের প্রয়োজন হয়, তা নয়। বরং মস্তিষ্কের অভ্যন্তরীণ পরিবর্তনের জন্যও কখনো কখনো এরূপ হতে পারে। এ ক্ষেত্রে একটি উদাহরণ ছিল ৬৮ বছর বয়সী এক বৃদ্ধ, যিনি ডিমনেশিয়া আক্রান্ত হওয়ার পরে হঠাৎ করেই তার মাঝে চিত্রাঙ্কনের অভ্যাস গড়ে উঠে। অথচ সারা জীবনে তার এতদিন মাঝে চিত্রাঙ্কনের কোনোই বাতিক ছিল না।
আসলে সব মিলিয়ে এখন পর্যন্ত আমাদের কাছে এই সিনড্রোম এক বড় ধরনের রহস্য হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে। হয়তো ভবিষ্যতে সেই রহস্যের সমাধান হতে পারে। কে জানে আবার, না হলেও হতে পারে! কেননা মাঝে মাঝে প্রকৃতি নিজের মাঝে রহস্য লুকায়িত রাখতেই পছন্দ করে।
আমার এই ধারাবাহিকের মূল লক্ষ্য হলো এমন কিছু মানুষের সম্পর্কে আলোচনা করা যারা সাভান্ট সিনড্রোম এর শিকার। তাহলে চলুন চলে যাই মূল অংশে।
আরও পড়ুন:
সাভান্ট এর উদাহরণ : আলোন্জো ক্লেমনস


আলোন্জো ক্লেমনস ১৯৫৮ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কলোরাডো অঙ্গরাজ্যের বোল্ডার শহরে জন্মগ্রহণ করেন। শিশুকালে এক ভয়ংকর দুর্ঘটনার কারণে তিনি মস্তিষ্কের বৃদ্ধি এবং বেড়ে উঠা সংক্রান্ত তীব্র সমস্যার সম্মুখীন হন। এটি এমনই প্রকট ছিল যে, তার আইকিউ লেভেল ৪০ বা ৫০ এর কাছাকাছি চলে যায়। যেখানে সাধারণ মানুষের আইকিউ লেভেল থাকে ৯০ থেকে ১১০। কিন্তু এর সাথে সাথেই তার মাঝে আরেকটি পরিবর্তন আসে। এই পরিবর্তন চোখে পড়তে বেশ খানিকটা সময় লেগে যায়। যাকে আলোন্জো ক্লেমনস এভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন –
‘ঈশ্বর আমাকে একটি উপহার দিয়েছেন ‘
আর সেই উপহার হলো, তিনি ভাস্কর্য তৈরি এবং বিভিন্ন ধাতু দ্বারা মডেল তৈরিতে অভাবনীয় রকমের দক্ষতা অর্জন করেন।
সাভান্ট প্রতিভা
টেলিভিশন বা কোনো ছবিতে অপরিচিত কোনো বস্তু বা প্রাণিকে মাত্র ২০ মিনিট দেখেই তিনি সেই প্রাণি বা বস্তুর অবিকল ভাস্কর্য তৈরি করতে পারতেন।


এভাবে তিনি সমাজের অন্যান্য সব ভাস্করের মতই বসবাস করে আসছিলেন প্রায় ৩০ বছর পর্যন্ত। কিন্তু ৮০ এর দশকের শেষের দিকে ঘটে যায় এক চমকপ্রদ ঘটনা। এসময় মুক্তি পায় বেরি লেভিনসন পরিচালিত রেইন ম্যান নামের একটি চলচ্চিত্র। যাতে মুখ্য ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন ডাস্টিন হফম্যান।


তিনি এই চলচ্চিত্রে একজন সাভান্ট সিনড্রোম এর শিকার মানুষের চরিত্রে অভিনয় করেন। এই চলচ্চিত্র এর মাধ্যমে পৃথিবীর সাধারণ মানুষ এই সাভান্ট সিনড্রোম সম্পর্কে জানতে পারে। এর আগ পর্যন্ত সাভান্ট সিনড্রোম ছিল কেবল চিকিৎসক সমাজ এবং মনোবিশেষজ্ঞদের আলোচনার বিষয়। তখন তার আশেপাশের মানুষজন বুঝতে পারেন যে, আলোন্জো ক্লেমনস নিজেও এরূপ একজন সাভান্ট। … … …
আগামী পর্বের জন্য চোখ রাখুন অসামান্যতে মোঃ রেদোয়ান হোসেন এর লেখায়!
ফিচার চিত্রছাঁচ কৃতজ্ঞতা স্বীকার: Designed by studiogstock
[…] […]