- বিচিত্র মানুষের বিচিত্র স্বভাব নিয়ে ব্যোমকেশের চিড়িয়াখানা - February 16, 2021
- রুলার অফ দ্য ওয়ার্ল্ড: মুঘল সাম্রাজ্যের স্বর্ণালী যুগের কারিগর সম্রাট আকবর - February 13, 2021
- ফ্রিডম অ্যাট মিডনাইট: দেশভাগের এক পূর্ণাঙ্গ আখ্যান - February 4, 2021
হযরত মুহাম্মদ (স.) এর পরিপূর্ণ জীবনই মানুষের চলার পথের পাথেয়স্বরূপ। তাঁর বলা প্রতিটি শব্দ, তাঁর করা প্রতিটি কাজই একজন মানুষের জন্য আদর্শ। মহানবি (স.) এর মৃত্যুর পরে তাঁর সাহাবিগণ এবং সাহাবিগণের মৃত্যুর পরে তাবেয়িগণ মানুষের কাছে মহানবি (স.) এর কথা এবং কাজ পৌঁছে দিয়েছেন। কিন্তু বৃহত্তর সময়ের কথা বিবেচনা করে পুরো প্রক্রিয়াটিকে একটি কাঠামোবদ্ধ করার প্রয়োজন ছিল। সেই কাঠামোবদ্ধকরণের পথে প্রথম ধাপ ছিল ইমাম বুখারি কর্তৃক সংকলিত সহিহ বুখারি। ইমাম বুখারির সংকলিত এই প্রামাণ্য গ্রন্থ বুখারি শরিফ সর্বদাই ইসলামি ইতিহাসের এক উজ্জ্বল স্তম্ভ হয়ে থাকবে।
হাদিসের গুরুত্ব
বলুন, আল্লাহ ও রাসুলের আনুগত্য প্রকাশ করো। বস্তুত যদি তারা বিমুখতা অবলম্বন করে, তাহলে আল্লাহ অবিশ্বাসকারীদেরকে ভালবাসেন না।
(সুরা আল ইমরান, আয়াত ৩২)
রাসুল যা কিছু তোমাদের দেন তা তোমরা গ্রহণ করো, আর যা কিছু তিনি নিষেধ করেন তা থেকে তোমরা বিরত থাকো। আর আল্লাহ্কে ভয় করো, নিঃসন্দেহ আল্লাহ্ প্রতিফল দানে কঠোর।
(সুরা আল হাশর, আয়াত ৭)
এই আয়াত থেকে সহজেই অনুধাবনযোগ্য যে, একজন পরিপূর্ণ মুসলিমের জন্য কুরআনের পাশাপাশি রাসুলের আদর্শ পালন করা কতটা গুরুত্বপূর্ণ! আর রাসুলের প্রতিটি কথা, কাজ এবং মৌনসম্মতিকে একত্রে হাদিস বলে। তাই হাদিসের যথাযথ সংরক্ষণ, সংকলন এবং তা মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া একজন মুসলিমের ধর্মীয় দায়িত্ব।
হাদিসের প্রাথমিক প্রচার
মহানবি (স.) এর জীবিত থাকাকালীন যেসকল সাহাবি লিখতে জানতেন, তাঁরা প্রায় সকলেই মহানবি (স.) এর বাণী লিখে সংরক্ষণ করতেন। উদাহরণস্বরূপ, হযরত আবু হুরায়রা (রা.) প্রায় ৫ সহস্রাধিক হাদিস বর্ণনা করেন এবং তিনি সাহাবিদের মধ্যে সর্বাধিক সংখ্যক হাদিস বর্ণনাকারী। হযরত আনাস ইবনে মালিক ২২৮৬টি হাদিস বর্ণনা করেন। উম্মুল মুমিনিন হযরত আয়েশা (রা.) মোট ২২১০টি হাদিস বর্ণনা করেন।
মসজিদে নববিতে সাহাবিরা সেসকল হাদিস নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতেন।


তাছাড়া সময়ে সময়ে মহানবি (স.) তাঁর দূতদের বিভিন্ন দেশে পাঠাতেন। তাঁরা সেখানে ইসলামের বাণী প্রচারের পাশাপাশি মহানবি (স.) এর আদর্শ, চিন্তা-চেতনা, কর্মপন্থা প্রচার করতেন। এভাবেই হাদিসের আলো চারদিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। কিন্তু হিজরি তৃতীয় শতকের প্রথম চতুর্থাংশ পর্যন্ত এই প্রক্রিয়ার কোনোরূপ আনুষ্ঠানিক ভিত্তি ছিল না। প্রত্যেক মুহাদ্দিস নিজেদের মতন করে বা তাঁদের শিক্ষকদের শেখানো পথে হাদিসের চর্চা করতেন এবং তা পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিতেন।
ইমাম বুখারির পরিচয়
ইমাম বুখারি (র.) ১৯৪ হিজরির ১৩ শাওয়াল বর্তমান উজবেকিস্তানের অন্তর্গত বুখারা শহরে জন্মগ্রহণ করেন।


তাঁর পিতা উক্ত অঞ্চলের একজন বিখ্যাত মুহাদ্দিস ছিলেন এবং সৌভাগ্যবশত ইমাম মালিকের স্নেহধন্য ছিলেন।
খুব ছোট বয়সেই তিনি তাঁর দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেন। এই ঘটনায় তাঁর মাতা অত্যন্ত দুঃখিত হন। তিনি আল্লাহর কাছে ছেলের দৃষ্টিশক্তির জন্য দুআ করতে থাকেন। এক রাতে তাঁর মা হযরত ইব্রাহিম (আ.) কে স্বপ্নে দেখেন। স্বপ্নে হযরত ইব্রাহিম (আ.) তাঁর মাকে জানান যে, আল্লাহ এই মায়ের দুআ কবুল করেছেন এবং তাঁর ছেলের দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দিয়েছেন। সকালে উঠে তিনি দেখতে পান যে, সত্যিই এরূপভাবে আল্লাহ তার দুআ কবুল করেছেন।
ছোটকালেই তাঁর পিতা মৃত্যুবরণ করেন। তিনি ১১ বছর বয়স থেকেই হাদিস অধ্যয়ন শুরু করেন। তাঁর স্মৃতিশক্তি সম্পর্কে তাঁর শিক্ষকেরা উচ্চমত পোষণ করেছেন। প্রায়শই এমন ঘটনা ঘটতো যে, হাদিস বর্ণনায় তিনি তাঁর শিক্ষকদের ভুল প্রমাণিত করতেন। কিন্তু তাঁর কোনো শিক্ষকই তাঁর উপরে মনঃক্ষুণ্ণ হননি। কারণ অহংকার শব্দ কখনোই তাঁর জীবনাচরণের অন্তর্ভুক্ত ছিলনা। তাই তাঁর সকল শিক্ষকই তাঁকে স্নেহ করতেন এবং তাঁর এই জ্ঞানতৃষ্ণার প্রশংসা করতেন। ১৬ বছরে ভ্রমণ শুরু করার পূর্বেই তিনি প্রায় ২,০০০ হাদিস অধ্যয়ন সমাপ্ত করেন।
১৬ বছর বয়সে তিনি তাঁর মা এবং বড় ভাইয়ের সাথে মক্কায় যান হজ পালনের জন্য। হজ পালন শেষে তিনি মকায় থেকে যান এবং তাঁর মা ও ভাইয়ের থেকে বিদায় নেন।


জ্ঞান অর্জনে ইমাম বুখারি
নিজের পিতার পথ অনুসরণ করে তিনিও হাদিস সংগ্রহের ব্রত নেন। ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত তিনি মক্কায় অবস্থান করেন। সেখানে তিনি অনেক বিখ্যাত মুহাদ্দিসের সংস্পর্শে আসেন। সকলেই তাঁর মেধার পরিচয় পেয়ে তাঁকে ইসলামের খেদমতে নিজেকে সঁপে দেওয়ার পরামর্শ দেন। তিনি নিজেকে ইসলামের খেদমতে নিয়োজিত করার ব্যাপারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হন।
তাই তিনি ইসলামের প্রাণকেন্দ্রসমূহে ভ্রমণ করে নিজের জ্ঞান বৃদ্ধির চিন্তা করেন এবং কিছুদিন পরেই ভ্রমণে বেরিয়ে পরেন।
ইসলামিক জ্ঞানচর্চার সূচনা হয়েছিল মদিনা থেকে। মক্কা বিজয়ের পর ইসলামের আলো মক্কায়ও ছড়িয়ে পড়ে। তারপরে মহানবি (স.) এর ইন্তেকালের পর খুলাফায়ে রাশেদিনের যুগে ইসলাম দূরদূরান্তে ছড়িয়ে পড়ে। বাগদাদ, দামেস্ক, বসরা, কুফা প্রভৃতি স্থান হয়ে উঠে মক্কা মদিনার পরপরই ইসলামিক জ্ঞানের তীর্থস্থান। মানুষ দূরদূরান্ত থেকে এসব স্থানে ইসলাম সম্পর্কে জানতে আসতেন। তাই ইমাম বুখারি সিদ্ধান্ত নেন, তিনি এই সমস্ত স্থানেই ভ্রমণ করবেন।


ইমাম বুখারির হাদিস সংগ্রহ
ইমাম বুখারির যাত্রা শুরু হয় মক্কা ত্যাগ করে মদিনার পথে যাত্রার মাধ্যমে। মদিনায় তিনি ১ বছর অবস্থান করেন। সেখানেও অনেক বিখ্যাত মুহাদ্দিসের সংস্পর্শে আসেন এবং তাঁদের থেকে শিক্ষালাভের সুযোগ পান তিনি। এখানে থাকা অবস্থায়ই তাঁর জীবনের নতুন মোড় আসে, তবে তা একটু ভিন্নভাবে।
তিনি বহুসংখ্যক হাদিস বর্ণনাকারী সাহাবিগণকে নিয়ে একটি জীবনীমূলক গ্রন্থ রচনা করেন। গ্রন্থের নাম ছিল আল তারিখ আল কাবির।


এই গ্রন্থের বিশেষত্ব এইটিই যে, তিনি এখানে অত্যন্ত সতর্কতার সাথে দুর্বল এবং শক্তিশালী হাদিসসমূহকে আলাদা করে চিহ্নিত করেন। এমনকি যেসকল হাদিসের ব্যাপারে তিনি দুর্বল না শক্তিশালী, এরূপ নিশ্চিত না; সেগুলোকেও আলাদা করে চিহ্নিত করেন। এই বই মদিনা এবং তদসংশ্লিষ্ট এলাকার মুহাদ্দিসগণের মাঝে ব্যাপক প্রশংসা অর্জন করে। তখন অনেকেই তাঁকে হাদিস সংকলনের পরামর্শ দেন। এই পরামর্শ তিনি বিবেচনা করেন এবং একেই নিজ জীবনের মূলমন্ত্র জ্ঞান করে সামনে এগিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করেন। এসময় তাঁর বয়স ছিল ১৯ বছর।
সেখান থেকে তিনি চলে আসেন বর্তমান ইরাকের অন্তর্গত বসরা শহরে। দীর্ঘ ছয় বছর সেখানে অতিবাহিত করেন।


তবে এর মাঝেও প্রতি হজ মৌসুমে তিনি হজ পালনের জন্য মক্কায় আসতেন। হজ পালনের পাশাপাশি মদিনায় মহানবি (স.) এর রওজা জিয়ারত করতেন। ফিরে এসে পুনরায় তিনি আবার হাদিস সংগ্রহে নিজেকে আত্মনিয়োগ করতেন।
এর পাশাপাশি তিনি মোট দুইবার সিরিয়া এবং মিশর ভ্রমণ করেন। পাশাপাশি তিনি কুফায়ও ভ্রমণ করেন। তৎকালীন সময়ে বাগদাদ ছিল ইসলামিক জ্ঞানের পীঠস্থান। বহুবার তিনি বাগদাদ এবং কুফায় যাতায়াত করেন। যেখানেই তিনি জ্ঞানী মুহাদ্দিসের সাক্ষাত পেয়েছেন, সেখানেই তিনি ভ্রমণ করেছেন।


তিনি কত পথ ভ্রমণ করেছেন, সেই বিষয়ে একটি ধারণা পাওয়া যাবে ছোট একটি তথ্য থেকে। আর তা হলো, তিনি সরাসরি ১০৮০ জন মুহাদ্দিসের সাথে নিজে সাক্ষাৎ করেন এবং সরাসরি তাঁদের সংগৃহীত হাদিস তাঁদের থেকেই সংগ্রহ করেন। এই তথ্য একই সাথে হাদিস সংগ্রহের প্রতি তাঁর আত্মনিবেদন এবং ত্যাগকেও প্রকাশ করে।
বুখারি শরিফ সংকলনের সিদ্ধান্ত
ছাত্রাবস্থায় ইমাম বুখারি বহু মুহাদ্দিসের সংকলিত হাদিসগ্রন্থ অধ্যয়ন করেন। তবে, যে জিনিসটি তাঁকে পীড়া দিত, তা হলো, সেখানে সহিহ (শুদ্ধ) ও জইফ (দুর্বল) হাদিসসমূহ আলাদা করে চিহ্নিত করা ছিলনা। বরং কোনো একজন মুহাদ্দিস যখন সংকলন করতেন, তিনি নিজের সংগৃহীত সকল হাদিসই সংকলনে অন্তর্ভুক্ত করতেন। ফলে সাধারণ মানুষের জন্য বেশ সমস্যা সৃষ্টি হতো। তাই তিনি এরূপ একটি হাদিস সংকলন তৈরির সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।
… … …
পরবর্তী পর্বের জন্য চোখ রাখুন অসামান্যতে মো. রেদোয়ান হোসেনের লেখায়।
তথ্যসূত্র:
প্রচ্ছদ ছবিসূত্র – Wikipedia