- বৃত্তাকার শহর বাগদাদ: উত্থান থেকে পতন - April 1, 2021
- গুরাবা – অপরিচিতদের কথা - February 21, 2021
- ক্রুসেড যুদ্ধের ইতিহাস: ইতিহাসের পাতায় পাতায় যুদ্ধের ধারাবিবরণী - February 1, 2021
রকেট বৃত্তান্ত ধারাবাহিকের প্রথম পর্বে আমরা দেখেছিলাম কীভাবে ধীরে ধীরে রকেটের বিকাশ হয়। আতশবাজি থেকে কীভাবে রকেট হয় একটি যানবাহন। কিন্তু আমরা বিজ্ঞানে তখনও রকেটের আগমন তথা রকেটকে বিজ্ঞানের বিষয় হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হতে দেখি না। এরপর সপ্তদশ শতাব্দীতে ইংরেজ বিজ্ঞানী স্যার আইজ্যাক নিউটনের (Sir Isaac Newton) গতির তিনটি সূত্র দ্বারা রকেট কীভাবে কাজ করে তার ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। এই পর্বের আলোচ্য বিষয় হচ্ছে বিজ্ঞানের অংশ হিসেবে রকেটের যাত্রা এবং যুদ্ধক্ষেত্রে রকেটের ব্যাপক ব্যবহার।
যাদের “রকেট বৃত্তান্ত” ধারাবাহিকের আগের পর্ব এখনও পড়া হয় নি, তাদের জন্য: রকেট বৃত্তান্ত: ইতিহাসে রকেট (পর্ব-০১)
বিজ্ঞানী আইজ্যাক নিউটনকে চেনে না অথচ বিজ্ঞান নিয়ে কাজ করে এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। নিউটনের আপেল পড়ার ঘটনা জগদ্বিখ্যাত, যদিও সেই ঘটনা আদৌ সত্যি কিনা তা নিয়ে রয়েছে সংশয়। কিন্তু তিনি যে বিশ্বের অন্যতম সেরা একজন বিজ্ঞানী এ ব্যাপারে কারো সংশয় থাকার কথা নয়। মহাকর্ষ, অভিকর্ষ ও গতি ছাড়াও ক্লাসিক্যাল ফিজিক্সের এমন খুব কম জায়গাই হয়তো আছে যেখানে তাঁর পদচারণা পাওয়া যায় না! রকেটের আধুনিকায়নেও বিজ্ঞানী নিউটনের অবদান চোখে পড়ার মতো।
১৭ শতাব্দীর শেষের দিকে বিজ্ঞানী আইজ্যাক নিউটন আধুনিক রকেটের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা উপস্থাপন করেন। তিনি ভৌত গতিকে তিনটি সূত্রের সাহায্যে উপস্থাপন করেন। এই সূত্রের সাহায্যে ব্যাখ্যা পাওয়া যায় কীভাবে রকেট কাজ করে। নিউটনের সূত্র রকেটের ডিজাইনের ক্ষেত্রে এরপর প্রভাব ফেলে। আর এর সাথেই বিজ্ঞানে রকেটের প্রবেশ ঘটে, অর্থাৎ রকেটবিদ্যাকে বিজ্ঞানের একটি অংশ হিসেবে ভাবা হয়।


১৭২০ সালের দিকে একজন ডাচ গণিতবিদ যিনি লিডেন বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত, জ্যোতির্বিজ্ঞান এবং দর্শনের অধ্যাপক উইলেম গ্রাভেসানডে (Willem Gravesande) বাষ্পের জেট ব্যবহার করে গাড়ি তৈরি করেন।


ঐ সময়েরই আশেপাশে জার্মানি ও রাশিয়াতে পয়তাল্লিশ কেজির চেয়ে বেশি ভরের রকেট নিয়ে কাজ শুরু হয়। এগুলোর মধ্যে কিছু রকেট আছে যেগুলো থেকে বের হওয়া অগ্নিশিখা মাটিতে গভীর গর্তের সৃষ্টি করে এমনকি রকেটের লিফট-অফের পূর্বেই।
অষ্টদশ শতাব্দীর শেষের দিকে এবং উনবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে রকেটকে যুদ্ধক্ষেত্রের অস্ত্র হিসেবে পুণর্জাগরণ শুরু হয়।
ফরাসি এবং ব্রিটিশ উভয়ই অষ্টাদশ শতাব্দীর দিকে ভারতের ঐশ্বর্য নিয়ন্ত্রণের দিকে নজর দেয়। তারা একে অপরের সাথে লড়াই করার পাশাপাশি মোঘলের টিপু সুলতানের বাহিনীর বিরুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। সেরিঙ্গাপতামের ১৭৯২ এবং ১৭৯৯ সালে যুদ্ধে, ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে রকেটকে ব্যবহার করা হয়। টিপু সুলতানের সময়ের একটি রকেট এখনও প্রদর্শিত আছে লন্ডনের কাছাকাছি আর্সেনালের উলউইচের Royal Ordnance জাদুঘরে।
টিপু সুলতানের বাবা হায়দার আলী ১৭৮৮ সালে প্রায় বারোশত রকেটারকে তার বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করেন। টিপু সুলতান এর পরিমাণ বাড়িয়ে প্রায় পাঁচ হাজার এ পরিণত করেন। যা ছিল তার সেনাবাহিনীর মোট শক্তির প্রায় সাত ভাগের এক ভাগ।
১৭৯২ সালে এবং ১৭৯৯ সালে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ভারতীয় রকেট ব্যারেজের যে সাফল্য, তা কর্নেল উইলিয়াম কংরিভ (Colonel William Congreve) নামের একজন আর্টিলারি বিশেষজ্ঞের নজরে ভালোভাবে আসে। এরপর কংরিভ ব্রিটিশদের জন্য রকেট ডিজাইন করার সিদ্ধান্ত নেয়।
আট কেজি থেকে ১৩৬ কেজির রকেটের বিকাশ শুরু হয়। কংরিভ এর তৈরি রকেটগুলো নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হয়।
অবাক করার মত বিষয় হচ্ছে, নেপোলিয়ন ফরাসি সেনাবাহিনীতে রকেটের কোনো ব্যবহার করেন নি। তিনি একজন আর্টিলারি অফিসার ছিলেন, তিনি সম্ভবত ঐতিহ্যকেই বেশি প্রাধান্য দিয়েছিলেন, তাই রকেটের চেয়ে কামানকেই তিনি বেশি উপযুক্ত মনে করেছিলেন।


কংরিভ এর রকেটগুলো যুদ্ধক্ষেত্রে বেশ সফল ছিল। ১৮১২ সালের যুদ্ধে ব্রিটিশরা এসব রকেট ব্যবহার করে। তারা ফ্রান্সিস স্কট কি (Francis Scott Key) কে তার কবিতা “The rockets’ red glare” লিখতে অনুপ্রাণিত করে। যা পরবর্তীতে The Star-Spangled Banner এ পরিচিতি পায়, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে বিদ্যমান।


১৮১৪ সালের ২৪ আগস্ট, ব্লাদেন্সবার্গের যুদ্ধের সময় ব্রিটিশ ৮৫তম লাইট ইনফ্যান্ট্রি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাটর্নি জেনারেল উইলিয়াম পিকনির নেতৃত্বে থাকা আমেরিকান রাইফেল ব্যাটালিয়নের বিরুদ্ধে রকেট ব্যবহার করেছিল। ব্রিটিশ লেফটেন্যান্ট জর্জ আর. গ্লেইগ নতুন হুমকির প্রতি আমেরিকানদের প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করেছিলেন। তিনি লিখেছিলেন,
Never did men with arms in their hands make better use of their legs.
যা বাংলায়, হাতে অস্ত্রযুক্ত মানুষরা এর আগে কখনও তাদের পায়ের উত্তম ব্যবহার করতে পারেন নি।
১৮১৮ সালে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে অফিশিয়ালভাবে একটি রকেট ব্রিগেড তৈরি করা হয়।
কংরিভ এর রকেটগুলো কিছুটা আধুনিক হলেও এগুলোর সঠিকতা (Accuracy) তখনও খুব বেশি ছিল না। রকেটের সঠিকতার (Accuracy) চেয়ে এর সংখ্যাই যুদ্ধক্ষেত্রে এর ধ্বংসাত্মক প্রকৃতির জন্য বেশি দায়ী ছিল। শত্রুপক্ষের উদ্দেশ্যে হাজার হাজার রকেট প্রেরণের দরুন এগুলো ধ্বংসাত্মকভাবে কার্যকর ছিল ঠিকই কিন্তু দরকার ছিল সঠিকতার (Accuracy)। এতে হয়তো অল্প খরচ তথা অল্প রকেট প্রেরণেই বেশ কার্যকর হবে।
পৃথিবীর বিভিন্ন রকেট বিজ্ঞানীরা নেমে পড়ল রকেটের সঠিকতা (Accuracy) আরও ভালো করার কাজে, যাতে আরও নিখুঁতভাবে রকেটকে ব্যবহার করা যায়।
১৮৪৪ সালের দিকে উইলিয়াম হেইল (William Hale) নামে একজন ইংরেজ, স্পিন স্টেবিলাইজেশন বা স্পিনের স্থিতিশীলতা নামে একটি টেকনিক জানান। তাঁর নীতির বিভিন্ন পরিবর্তন হলেও, আজও ব্যবহৃত হয় এই নীতির পরিবর্তিত নানা রূপ। এই নীতিতে রকেটকে অনেকটা বুলেটের মতো করে কাজ করানোর চিন্তা করা হয়।


ইউরোপীয় মহাদেশে যুদ্ধক্ষেত্রে সাফল্যের সাথে রকেটের ব্যবহার দেখা গেল।
চৌঠা ডিসেম্বর ১৮৪৬ সাল, মেক্সিকোতে অভিযানের জন্য মার্কিন মেজর জেনারেল উইনফিল্ড স্কটের সাথে রকেটারদের একটি ব্রিগেডকে অনুমতি প্রদান করা হয়।


সেনাবাহিনীর রকেটারগুলোর প্রথম ব্যাটালিয়ন ছিল প্রায় ১৫০ জন রকেটারের সমন্বয় এবং যাতে ছিল প্রায় ৫০টি রকেট, এটির নেতৃত্বে ছিল জর্জ হেনরি ট্যালকট। ২৪ মার্চ ১৮৪৭ সাল, ভেরাক্রুজ অবরোধের সময় মেক্সিকান বাহিনীর বিরুদ্ধে রকেট ব্যবহার করা হয়। এই ভেরাক্রুজ অবরোধ ছিল মেক্সিকো-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধের অন্যতম অংশ!


৮ই এপ্রিলের দিকে ক্যাপ্টেন রবার্ট এডওয়ার্ড লি এর নির্দেশে রকেটাররা ভেতরের দিকে চলে যায় এবং টেলিগ্রাফ হিলের যুদ্ধের সময় ৩০টি রকেট নিক্ষেপ করা হয়। এরপর চেপুলটেপেকের দুর্গ দখলে রকেট ব্যবহার করা হয়, যা মেক্সিকোকে আত্মসমর্পণের দিকে ধাবিত করে। মেক্সিকো যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর পরই ব্যাটালিয়নটি ভেঙে দেয়া হয়েছিল এবং বাকি রকেটগুলো স্টোরেজে রেখে দেয়া হয়।
রকেটগুলো ১৮৬১ সাল পর্যন্ত অর্থাৎ প্রায় ১৩ বছর অব্যবহৃত রয়ে গিয়েছিল। ১৮৬১ সালে আমেরিকায় গৃহযুদ্ধের সময় আবার ব্যবহারের জন্য অনুমতি দেয়া হয়। জানা যায়, রকেটগুলো ব্যবহারের ক্ষেত্রে অবনতি দেখা গিয়েছিল, তবে পুনরায় আবার নতুন করে রকেট তৈরি করা হয়। ৩ জুলাই ১৮৬২ সালে, এই গৃহযুদ্ধে রকেটের প্রথম ব্যবহার হয় বলে জানা যায়।
তখনও কিন্তু মহাকাশ গবেষণার কাজে রকেটের ব্যবহারের কথা জানা যায় না! এর একটি কারণ মানুষ ভাবতো মহাকাশে রকেট চলাচল সম্ভব না! কারণ, নিউটনের গতির তৃতীয় শর্ত অনুসারে, প্রতিটি ক্রিয়ারই একটি প্রতিক্রিয়া আছে। কিন্তু আমরা জানি মহাকাশে বায়ু নেই, তাহলে ধরলাম রকেট পৃথিবীর বায়ুস্তর থাকা পর্যন্ত চলতে পারল কিন্তু রকেট কীভাবে চলবে মহাকাশে যেখানে বায়ুশুন্য? অথচ ভেবে দেখুন আজকের পৃথিবীতে মহাকাশ গবেষণার অন্যতম প্রধান হাতিয়ার হচ্ছে রকেট। রকেট দিয়েই পাঠানো হয়েছে কত কত স্যাটেলাইট ও মহাকাশচারীকে! কিন্তু কীভাবে মানুষ বুঝতে পারল মহাকাশে রকেট এর চলাচল সম্ভব এবং কে ই বা সেই নায়ক, যে এটি বের করে মহাকাশ গবেষণার দ্বার উন্মুক্ত করতে সহায়তা করেছে? জানতে হলে অপেক্ষা করুন রকেট বৃত্তান্ত ধারাবাহিকের পরবর্তী পর্বের জন্য।
তথ্যসূত্র:
ফিচার ছবিসূত্র: Space coast launches