- রহস্যময় ডার্ক ম্যাটার ও ডার্ক এনার্জি (১ম পর্ব) - December 21, 2020
- মিশিও কাকু : বর্তমান বিশ্বের জনপ্রিয় এক পদার্থবিজ্ঞানী - October 22, 2020
- রকেট বৃত্তান্ত: রকেট যখন বিজ্ঞান ও যুদ্ধক্ষেত্রে (পর্ব-০২) - September 28, 2020
মহাকাশপ্রেমীদের কাছে রকেট এক অন্যরকম আবেগের নাম। কারণ এটিই তো আমাদের কাছে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত যান যার মাধ্যমে নিল আর্মস্ট্রং পা রেখেছিলেন চাঁদে।
এই তো সেই রকেট যাকে নিয়ে মানুষের মঙ্গল জয়ের স্বপ্ন। কিন্তু আজকে আমরা যেই রকেট দেখে থাকি তা কিন্তু পূর্বে মোটেও এমন ছিল না। এর ইতিহাস জানতে আমাদের যেতে হবে বহু পূর্বের কাঠের তৈরি এক পাখির দিকে।
রোমান আউলুস জেলিয়াসের লেখা থেকে আরকিটাস নামের এক গ্রিক দার্শনিকের গল্প জানা যায়। যে কিনা টারেনটাম শহরে বাস করত (বর্তমান দক্ষিন ইটালির একটি অংশ)।
খ্রিষ্টপূর্ব চারশত বছরের আশেপাশে আরকিটাস কাঠের একটি পাখি উড়ানোর মাধ্যমে টারেনটাম শহরের মানুষের মনে বিস্ময়ের সৃষ্টি করেছিলেন।
আরকিটাস বাষ্পচালিত পদ্ধতিতে তার এই কাঠের উড়ন্ত পাখি তৈরি করেন। ঐ পাখিটির পিছনের দিকে একটি খোলা অংশ ছিল যা উত্তপ্ত বয়লারের সাথে সংযুক্ত ছিল। উত্তপ্ত পানি থেকে উৎপন্ন বাষ্প চাপ বৃদ্ধি করে আর এতে করে পাখিটি উড়তে পারে, যা কয়েক শতাধিক মিটার উড়ে যাওয়ার খবর পাওয়া যায়। কাঠের পাখি উড়ার এই বিষয়টি ছিল ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া নীতির একটি ব্যবহারিক ফল, যা সপ্তদশ শতাব্দীর পূর্বে বৈজ্ঞানিক আইন তথা Scientific Law হিসেবে বিবেচিত হয় নি। পাখিটির আকৃতির সাথে কবুতরের মিল পাওয়া গিয়েছিল বিধায় একে উড়ন্ত কাঠের কবুতরও বলা হয়।
কবুতরের ঐ ঘটনার প্রায় ৩০০০ বছর পর আরেকজন গ্রীক, আলেকজান্দ্রিয়ার হিরো “আয়ওলিপাইল(Aeolipile)” নামে রকেট সদৃশ একটি যন্ত্র আবিষ্কার করেন। এটিতেও চালক গ্যাস হিসেবে বাষ্পকে ব্যবহার করা হত। একে হিরো ইঞ্জিন (Hero Engine) নামেও অভিহিত করা হয়ে থাকে।
তো দেখে নেয়া যাক এই হিরো ইঞ্জিন (Hero Engine) কীভাবে কাজ করত। প্রথমে একটি পানির গামলা নেয়া হয়। এর পর তার উপর একটি ফাঁপা গোলক স্থাপন করা হয় পানির সাথে এটি পাইপ দিয়ে সংযুক্ত ছিল। পানির গামলার নিচে আগুন দিয়ে তাপ দেয়া হয়। আর এতে করে জলীয় বাষ্প উৎপন্ন হচ্ছিল। তাই ঐ সংযুক্ত পাইপ দিয়ে জলীয় বাষ্প গোলকের দিকে যাচ্ছিল। গোলকের বিপরীত দিকে ২ টি এল আকৃতির (L-shaped) টিউব থাকে যার ফলে ঐ টিউব ২টি দিয়ে বাষ্প বের হয়, আর এতে করে গোলকটি ঘুরতে শুরু করে।
চীনাদের রকেট
প্রথম কবে সত্যিকারের রকেট তৈরি হয়েছিল তা নিয়ে পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যায় না। বিভিন্ন সংস্কৃতির নানা ইতিহাস থেকে প্রাপ্ত তথ্য তাই এখানে তুলে ধরা হল পাঠকদের সুবিধার্থে। চীনা ইতিহাস থেকে যে ধারণা পাওয়া যায় রকেটের, তা প্রায় সব জায়গায়ই তুলে ধরা হয়।
প্রথম রকেট তৈরির ঘটনা ছিল সম্ভবত একটি দুর্ঘটনা। কথিত আছে খ্রিষ্টাব্দ প্রথম শতাব্দীতে চীনাদের এক ধর্মীয় উৎসবে তারা আতশবাজি বা বিস্ফোরক তৈরির জন্য বাঁশের ভেতরের ফাঁপা জায়গায় বিস্ফোরক পদার্থ ( গানপাউডার বা ব্ল্যাক পাউডার যা সল্টপিটার, সালফার ও চারকোল দিয়ে তৈরি ছিল ) ভরে তা আগুনে নিক্ষেপ করে।
বন্দুক আবিষ্কারের আগে পর্যন্ত এই গানপাউডার ব্ল্যাক পাউডার নামেই পরিচিত ছিল।
সম্ভবত সেই বাঁশের তৈরি টিউবগুলোর কিছু বিস্ফোরণে ব্যর্থ হয়েছিল এবং সেগুলো এর পরিবর্তে সেগুলো জ্বলন্ত গানপাউডার ব্যবহার করে উড়তে শুরু করল। আর এতে করে চীনারা গানপাউডার নিয়ে পরীক্ষা-নিরিক্ষা শুরু করে। এক পর্যায়ে তারা বাঁশের টিউবগুলোকে ধনুকের তীরের সাথে সংযুক্ত করে। অচিরেই তারা বুঝতে পারল এই টিউবগুলো আসলে গানপাউডার থেকে উৎপন্ন যে মুক্ত গ্যাস তা থেকে প্রাপ্ত শক্তি নিয়ে উড়তে পারে। আর সেখান থেকেই মূলত আসল রকেটের জন্ম।
ফ্রাঙ্ক উইন্টার নামের স্মিথসোনিয়ানের জাতীয় বিমান ও মহাকাশ জাদুঘরের এক সাবেক কিউরেটর (যিনি বর্তমানে একজন স্বাধীন স্কলার), ঐ একই যাদুঘরের মাইকেল নিউফেল্ড এবং অস্ট্রেলিয়ার পাওয়ার হাউজ জাদুঘরের কেরি ডঘার্টি রকেটের এই সত্যিকার ইতিহাস জানাকে একটি চ্যালেঞ্জ হিসেবে মনে করেছেন। উইন্টার এবং তার সহকর্মীরা বিশ্বাস করেন যে তাওবাদী আলকেমিস্টরা অমরত্বের ফর্মুলা খোঁজে কাজ করার সময় গানপাউডার আবিষ্কার করেন।
মূলত পূর্ববর্তী পণ্ডিতগণ সুং (Sung) রাজবংশের সময়কে রকেটের উৎপত্তিকাল হিসেবে চিহ্নিত করেন। এই রকেটের প্রথম ব্যবহার দেখা যায় ১২৩২ সালে যখন চীনাদের সাথে মঙ্গোলদের যুদ্ধ চলছিল। কাই-কেং(Kai-Keng) এর যুদ্ধের সময় চীনারা তাদের তীরের সাথে এই রকেট ব্যবহার করে মঙ্গোলদের আক্রমণ করে।
উড়ে যাওয়া এই জ্বলন্ত তীরসমূহ আক্রমণের ক্ষেত্রে কতটা কার্যকর ছিল তা নিয়ে সংশয় থাকলেও এটি মঙ্গোলদের মানসিকভাবে দুর্বল করে দিতে বেশ কার্যকর ছিল।


কাই-কেং (Kai-Keng) এর এই যুদ্ধের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে মঙ্গোলরাও তাদের নিজস্ব রকেট তৈরি করে এবং এটি খুব সম্ভবত ইউরোপে এই রকেটের ব্যবহার ছড়িয়ে দিতে ভূমিকা রেখেছিল।
রকেটের উন্নয়ন
১৩ থেকে ১৫ শতকের দিকে রকেট নিয়ে পরীক্ষার অনেক খবর পাওয়া যায়।
১৩৭৯ সালে, মুরাতরি নামের একজন ইতালীয় মধ্যযুগীয় সময়ে ব্যবহৃত গানপাউডার চালিত আগুনের তীরগুলির বর্ণনা দেয়ার সময় “Rochetta” শব্দতি ব্যবহার করেছিলেন। এটিকে পরবর্তীতে ইংরেজিতে অনুবাদ করে “Rocket” করা হয় এবং ধারণা করা হয় এটিই প্রথম এই শব্দের ব্যবহার ছিল।
ইংল্যান্ডে রজার বেকন (Roger Bacon) নামের এক দার্শনিক গানপাউডারের গুণগত মান আরও বৃদ্ধি করেন। আর এতে করে রকেটের পরিসর (Range) আরও বৃদ্ধি পায়।
অপরদিকে ফ্রান্সে জিন ফ্রয়েসার্ট (Jean Froissart) আবিষ্কার করেন যে, রকেটগুলো টিউবের মাধ্যমে আরও সঠিকভাবে চালনা করা সম্ভব। তার ধারণাটি আধুনিত বাজুকা তৈরির অগ্রদুত হিসেবে কাজ করেছিল। ১৪১০ সালে তার লেখা “Chronicles” নামের রচনায় এ সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।
আর ইটালির জোয়ানস ডি ফন্টানা (Joanes de Fontana) শত্রুপক্ষের জাহাজে আগুন লাগানোর জন্য রকেট চলিত টর্পেডো ডিজাইন করেছিলেন। ১৪২০ সালে তার রচিত সামরিক রকেটের একটি স্কেচবুক “Bellicorum Instrumentorum Liber” ( Book of War Instruments বা যুদ্ধের সরঞ্জামের বই) রকেট নিয়ে তার ধারণা পাওয়া যায়।
১৬ শতাব্দীর দিকে যুদ্ধে রকেটের অপব্যবহার লক্ষণীয় ছিল। যদিও রকেট তখনও আতশবাজি তৈরির কাজে আসত।
স্টেজ রকেট
জোহান শ্মিডলাপ (Johann Schmidlap) নামের একজন জার্মান আতশবাজি প্রস্তুতকারী “স্টেপ রকেটের” ধারণা আবিষ্কার করেন, যা ছিল আতশবাজিকে আরও উচ্চতর উচ্চতা প্রদানের একটি ধারণা। যাতে একটি বড় স্কাই রকেট (১ম স্টেজ) একটি ছোট স্কাই রকেটকে (২য় স্টেজ) বহন করেছিল। ১ম স্টেজ তথা বড় রকেটটির জ্বলা শেষ হলে ২য় স্টেজ তথা ছোট রকেটটি জ্বলা শুরু করত আর এতে করে আরও বেশি উচ্চতা পর্যন্ত চলতে পারত। বর্তমানে যেসব রকেটকে আমরা পৃথিবীর বাইরে মহাশুন্যে যেতে দেখি জোহান শ্মিডলাপের ধারণাটি মূলত এগুলোরই প্রাথমিক ধারণা ছিল।


তবে তখন পর্যন্ত রকেট কেবল আতশবাজি কিংবা যুদ্ধবিগ্রহের কাজেই ব্যবহৃত হতো। কিন্তু একজন চীনা কিংবদন্তি প্রথম রকেটকে পরিবহনের কাজে ব্যবহারের কথা জানান। ওয়ান-হু (Wan-Hu) নামের এই চীনা কর্মকর্তা তার অনেক সহকারীর সহায়তায় একটি রকেট চালিত উড়ন্ত চেয়ারের ব্যবস্থা করেন। যাতে ছিল ২ টি বড় আকারের ঘুড়ি এবং ৪৭ টি আগুনের তীরের রকেট।
তার এই উড়ন্ত চেয়ারকে উড়ানোর দিন ওয়ান-হু নিজেই সেই চেয়ারে বসে রকেট জ্বালানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন। মশাল দ্বারা ঐ ৪৭ টি রকেটকে সহকারীরা জ্বালিয়েছিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই ধোঁয়ার কুণ্ডুলীতে তৈরি মেঘের মত দৃশ্য থেকে গর্জন ভেসে আসে, ওয়ান-হু ও তার উড়ন্ত চেয়ার চলে যায়। ওয়ান-হু এর কি হয়েছিল তা ঠিকমত জানা যায় না। কিন্তু খুব সম্ভবত ওয়ান-হু ও তার উড়ন্ত চেয়ার বিস্ফোরিত হয়ে চুরমার হয়ে গিয়েছিল, কেননা ঐ ৪৭ টি রকেট বিস্ফোরণ তৈরির জন্য যথেষ্ট কার্যকর ছিল।
তখন পর্যন্ত রকেটবিদ্যাকে বিজ্ঞানের অংশ হিসেবে তেমনভাবে ভাবা হত না। তবে সপ্তদশ শতাব্দীতে ইংরেজ বিজ্ঞানী স্যার আইজ্যাক নিউটনের (Sir Isaac Newton) গতির তিনটি সূত্র দ্বারা রকেট কীভাবে কাজ করে তার ব্যাখ্যা পাওয়া যায়।
রকেটবিদ্যাকে বিজ্ঞানের অংশ হিসেবে কাজে লাগানোর সেই গল্প জানতে পাঠকদের লক্ষ্য রাখতে হবে আমাদের এই সিরিজের পরবর্তী পর্বে।
ফিচার চিত্রসুত্র : Wikimedia Commons
তথ্যসূত্র :
১। Ancient Origins
২। Smithsonian
৩। Britannica Encyclopedia
৪। Nasa
৫। Spaceline
পুরোটা সময় মন দিয়ে পড়লাম। অনেক তথ্যবহুল লিখা। সামনের পর্বের অপেক্ষায় আছি!
ধন্যবাদ।