- অ্যাশেজ: ছাইভস্ম থেকে অভিজাত টেস্ট সিরিজ হয়ে ওঠার গল্প - November 4, 2020
- ইউরোপ: ভ্রমণপিপাসুদের জন্য শীর্ষ ৭টি স্থান - October 25, 2020
- পেলে: ফুটবল ইতিহাসে কালজয়ী এক সম্রাটের ইতিকথা (শেষ পর্ব) - October 5, 2020
কেউ বলেন বিশ্বসেরা, কেউবা আবার বলেন সর্বকালের সেরা; কারো আবার অভিমত সর্বকালের সেরাদের সেরা। বলছি মেসি, হ্যাঁ লিওনেল মেসির কথাই। কাব্যিক ভাষায় যাকে বলা হয় ভিনগ্রহের ফুটবলার। যার নিপুণ পায়ের সুনিপুণ খেলা সকল ফুটবলপ্রেমিকে মাতোয়ারা করে দেয়। মনে হয় যেন কোনো সুদক্ষ শিল্পী তার সুনিপুণ দক্ষতা দিয়ে তার মনের কল্পনাকে বাস্তবে রুপান্তর করছেন।
তার খেলা দেখে অবাক হননি এমন ফুটবলপ্রেমি খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। কোচ, ফুটবলার কিংবা ভক্ত; সব স্থানে তার খেলা নিয়ে নানান আলোচনা। সবার মুখে যেন তারই বন্দনা!
বার্সার সাবেক কোচ এবং বর্তমান ম্যানসিটি কোচ পেপ গার্দিওলা তো বলেই দিয়েছেন,
তাকে নিয়ে লিখো না। তাকে বর্ণনা করার চেষ্টা কোরো না, শুধু দেখে যাও!
শুধু কী গার্দিওলা? সর্বকালের গ্রেটেস্ট ফুটবলারদের মুখে রীতিমতো তাকে নিয়ে বন্দনা শুনলে যে কারোর চোখ কপালে ওঠার দায়।
বর্তমান সময়ে, লিওনেল মেসির ক্লাব বার্সেলোনা ছেড়ে যাওয়ার জোর গুঞ্জন রীতিমতো সকল কোচ, ফুটবলার এবং ফুটবলপ্রেমিদের মনে নানান সমীকরণের জন্ম দিচ্ছে। সেই সুবাদে আমরা বার্সেলোনায় লিওনেল মেসির অবদান দেখে আসি এক ঝলকে।
বার্সেলোনায় ক্যারিয়ার শুরুর ইতিহাস


১৯৮৭ সালে ২৪ শে জুন আর্জেন্টিনার ছোট্ট শহর রোজারিওতে ঘর আলোকিত করে এক বিস্ময়কর বালকের জন্ম হয়। নাম তার লিওনেল মেসি। ছোটবেলা থেকে ফুটবলের প্রতি ছিল তার দারুণ ঝোঁক।
মাত্র ৮ বছর বয়সে অর্থাৎ ১৯৯৫ সালে রোজারিও ভিত্তিক একটি ফুটবল ক্লাব নিওয়েল’স ওল্ড বয়েজ নামক একটি ক্লাবে যোগ দেন। স্থানীয় ক্লাবটি এরপর থেকে এতটাই শক্তিশালী হয়ে উঠে যে ৪ বছরে মাত্র একটি ম্যাচে পরাজিত হয়! সেসময় স্থানীয়রা তার ফুটবল খেলায় বিস্মিত হয়ে মেসি দ্যা মেশিন অফ ৮৭ নামে ডাকা শুরু করে। তবে, ওই নামে ডাকার কারণটা বেশ মজার ছিল। সবাইকে সে সময় তাদের জন্মসালসহ ডাকা হতো।
তবে ১১ বছর বয়সে নীল পরিচ্ছন্ন আকাশে একখণ্ড কালো মেঘ আচ্ছন্ন করে। চারদিক নিস্তব্ধতার বেড়াজালে আচ্ছন্ন হয়ে গেল হঠাৎ করে। মাত্র ১১ বছর বয়সে গ্রোথ হরমোনের সমস্যা দেখা দেয়। যার ফলে প্রতিমাসে প্রায় ৯০০ ডলার খরচ হতো চিকিৎসার জন্য! কিন্তু পরিবার এবং ক্লাব রোজারিওর পক্ষে এত টাকার ব্যয় বহন করা রীতিমতো দুষ্কর ছিল।


যখন এই অনিশ্চয়তা, ঠিক তখনই আকাশে মেঘের ঘনঘটা থেকে মাঝখানে সূর্য একটু করে উকিঁ দিল!
তৎকালীন বার্সেলোনার ক্রীড়া পরিচালক কার্লোস রেক্ট্রাস মেসির পাশে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন। তার কানে এই দুরন্ত এবং প্রতিভাবান ফুটবলারের সম্পর্কে প্রশংসা ভেসে আসতে থাকে। এবং তার সমস্ত চিকিৎসার ভার বার্সেলোনা বহন করতে রাজি হয়।
সেসময় হাতের কাছে কোন কাগজপত্র না থাকায় একটা ন্যাপকিন প্যাপারে চুক্তি করেন বার্সেলোনার তৎকালীন ক্রীড়া পরিচালক।


তারপর পরিবার সহ মেসি পাড়ি জমান সূদুর বার্সেলোনায়। তারপর সেখানে যুব একাডেমি লা মাসিয়াতে যোগদান করেন।
তারপর, ২০০০ সালে মাত্র ১৩ বছর বয়সে মেসি বার্সার অনুর্ধ-১৪ দলে জায়গা করে নেন।এরপর, ২০০০ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত যুব একাডেমি ইনফান্তিনো কাদেতে-বি এবং কাদেতে-এ তে খেলেন।
এরপর, ২০০৩-০৪ মৌসুমে মেসি পের্তো নামক ক্লাবের সাথে দো ড্রাগাও স্টেডিয়ামে খেলেন।
অবশেষে, ২০০৪ সালের ১৬ই অক্টোবর এস্পানিওলের বিপক্ষে অলিম্পিক স্টেডিয়ামে মেসির লা-লিগায় প্রথম অভিষেক হয়। সেই ম্যাচের এক মাত্র গোলস্কোরার ডেকো এর পরিবর্তে শেষ সাত মিনিটে মাঠে নামেন এই বিশ্বসেরা ফুটবলার।


এরপর থেকেই বার্সেলোনার স্কোয়াডে নিয়মিত মুখ মেসি।
বার্সেলোনার মেসি, মেসির বার্সেলোনা
মেসি মানেই বার্সেলোনা আর বার্সেলোনা মানেই মেসি! যারা একটু-আধটু ফুটবলের খবর রাখেন কিংবা বার্সেলোনার খেলার খবর রাখেন তাদের কাছে নিঃসন্দেহে এটি একটি চিরচেনা উক্তি!


লিওনেল মেসি তার ক্যারিয়ারের বেশিরভাগ সময় বার্সেলোনায় কাটিয়েছেন। এখন পর্যন তিনি একমাত্র আন্তর্জাতিক ক্লাব হিসেবে বার্সেলোনায় খেলে যাচ্ছেন।
এমন কী আছে যা তিনি বার্সেলোনাকে এনে দেননি? এমন কোনো রেকর্ড আছে কি, যা মেসি বার্সায় থাকা অবস্থায় ভাঙতে পারেননি? সম্ভবত সকল ফুটবলপ্রেমিদের একই উত্তর হবে “না!” কারণ তিনি যে ভিনগ্রহের ফুটবলার নামে খ্যাত! অসাধারণ খেলার মাধ্যমে সকল রেকর্ডের খাতায় নাম লিখিয়ে তিনি আজ বিশ্বসেরা!
সেই ২০০৪ সালে এস্পানিওলের বিপক্ষে অভিষেক হওয়ার পর থেকে ২০০৪/০৫, ২০০৫/০৬, ২০০৮/০৯, ২০০৯/১০, ২০১০/১১, ২০১২/১৩, ২০১৪/১৫, ২০১৫/১৬, ২০১৭/১৮ এবং ২০১৮/১৯ মৌসুমের এই ১০ টি লা-লিগা শিরোপা মেসি বার্সাকে এনে দিয়েছেন!


এরপর তিনি ৪ টি চ্যাম্পিয়নস ট্রফি – ২০০৫/০৬, ২০০৮/০৯, ২০১০/১১ এবং ২০১৪/১৫ মৌসুমের শিরোপা এনে দেন বার্সাকে।


এরপর ৬টি কোপা দেল রেই – ২০০৮/০৯, ২০১১/১২, ২০১৪/১৫, ২০১৫/১৬, ২০১৬/১৭ এবং ২০১৭/১৮ মৌসুমে ট্রফি এনে দেন বার্সাকে।
এরপর, ৩ টি ক্লাব ওয়ার্ল্ড কাপ – ২০০৯/১০,২০১১/১২ এবং ২০১৫/১৬।


এছাড়াও , ৮ টি স্প্যানিশ সুপার কাপ – ২০০৫/০৬, ২০০৬/০৭, ২০০৯/১০, ২০১০/১১, ২০১১/১২, ২০১৩/১৪, ২০১৬/১৭, ২০১৮/১৯ মৌসুমের শিরোপা এনে দেন বার্সাকে।
রেকর্ড এবং অর্জনের পাতায় মেসি
বার্সেলোনার হয়ে মেসি রেকর্ড গড়েননি এমন কিছু খুঁজে রীতিমতো দুষ্কর! ব্যক্তিগত, দলীয় সকল রেকর্ড তাকে আজ সর্বকালের সেরা খেলোয়াড়ে রূপ দিয়েছে!
- লিওনেল মেসি একমাত্র ফুটবলার যিনি রেকর্ড ছয়টি ফিফা ব্যালন ডি’অরের মালিক! উল্লেখ্য ২০০৯, ২০১০, ২০১১, ২০১২, ২০১৫ এবং ২০১৯ এ ফিফার বর্ষসেরা ফুটবলারের খ্যাতি অর্জন করেন।


- রেকর্ড ৭ বার লা-লিগার টপ স্কোরার হয়ে সাতটি পিচিচি ট্রপির অর্জন করেন লিওনেল মেসি। সাতটি পিসিসি ট্রফি নিয়ে তার সমানে আছেন জার্মানির গার্ড মুলার এবং পর্তুগালের বেনফিকো।


- বিশ্বের একমাত্র ফুটবলার হিসেবে লিওনেল মেসি রেকর্ড ৬ টি গোল্ডেন বুটের মালিক!
- পেশাদার লিগে সকল দলের বিপক্ষে টানা গোল করার রেকর্ড একমাত্র লিওনেল মেসির।
- এক মৌসুমে রেকর্ড ২১ টি এসিস্ট করে জাভির রেকর্ড ভেঙে দিয়ে স্প্যানিশ লা লিগার ইতিহাসে একমাত্র ফুটবলার হিসেবে এই কীর্তি গড়েন লিওনেল মেসি।
- একমাত্র ফুটবলার হিসেবে স্প্যানিশ লা লিগার ইতিহাসে রেকর্ড ৩৬ টি হ্যাট্রিক করেন মেসি।
- মেসি স্প্যানিশ ফুটবল ইতিহাসে একমাত্র ফুটবলার যিনি ক্লাবের হয়ে ৫০০ টির বেশি ম্যাচ জয়ের সাক্ষী হিসেবে থেকেছেন।
- ফুটবল ইতিহাসে মেসি একমাত্র ফুটবলার যিনি চ্যাম্পিয়নস লীগে ৩৪ টি ভিন্ন ক্লাবের বিপক্ষে গোল করার কীর্তি গড়েছেন।
- লা লিগার ইতিহাসে সবচেয়ে ম্যান অফ দ্যা ম্যাচ খেতাব জিতেছেন মেসি।
- স্প্যানিশ লা লিগার ইতিহাসে টানা ১২ টি লা-লিগায় ২০ টির অধিক গোল করার রেকর্ড একমাত্র মেসির ঝুলিতে!
- এল ক্লাসিকোর ইতিহাসে মেসি একমাত্র বার্সার ফুটবলার যিনি রেকর্ড ৪৩ টি ম্যাচে অংশগ্রহণ করেছেন।
- স্প্যানিশ লা লিগার ইতিহাসে প্রথম ফুটবলার হিসেবে এক মৌসুমে ২০ টির বেশি গোল এবং ২০ টির বেশি অ্যাসিস্ট করেন লিওনেল মেসি।
- এল ক্লাসিকোর ইতিহাসে রেকর্ড ২৬ টি গোল করে টপ স্কোরার হিসেবে রয়েছেন লিওনেল মেসি।
- একক লা লিগার খেলোয়াড় হিসেবে এক মৌসুমে ৫০ টি গোল করে লা লিগার ইতিহাসে রেকর্ড গড়েন মেসি।
- এক মৌসুমে একমাত্র বার্সার ফুটবলার হিসেবে রেকর্ড ৭১ টি গোল করে ইতিহাস গড়েন লিওনেল মেসি। যা ইউরোপের টপ ৫ টি লিগে এক মৌসুমে এমন রেকর্ড কেউ গড়তে পারেননি।
- স্প্যানিশ লা লীগার ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি রেকর্ড গোল স্কোরার লিওনেল মেসি।
আরও পড়ুন:
ক্লাব ছাড়ার গুঞ্জন
লিওনেল মেসির বার্সেলোনা ছাড়ার গুঞ্জন খুব জোরালো হয়ে গেছে। ২০১৭ সালে এক টিভি সাক্ষাৎকারে মেসি বলেছিলেন,
বার্সেলোনা আমার দ্বিতীয় বাড়ি। এখান থেকে চলে যাওয়ার প্রশ্নই আসে না।
যদিও এবারের গুঞ্জনটা একটু জোরালো। তবুও সকল ফুটবলপ্রেমি লিওনেল মেসিকে তার প্রিয় ক্লাব বার্সেলোনাতে দেখতে চায়। পুনরায় তার ফুটবলের ঝলক চিরচেনা ক্লাব বার্সার মাঠে দেখার অপেক্ষায় !
শেষকথা
কে বিশ্বসেরা খেলোয়াড়? লিও মেসি; কে ইতিহাসের সেরা খেলোয়াড়? লিও মেসি!
-আর্সেন ওয়েঙ্গার
আর্সেনালের সর্বকালের সেরা কোচ আর্সেন ওয়েঙ্গারের কথাটির সাথে একমত হয়ে বলতে হয়, সে সেরা। শুধু সেরা নয়, সর্বকালের অন্যতম সেরা। অদূর ভবিষ্যতে তার রেকর্ডগুলো আদৌ কেউ ভাঙতে পারবে কিনা সন্দেহ।
তো মেসির কোন অর্জনে আপনি অধিক উচ্ছ্বসিত হয়েছেন, মন্তব্য করে জানিয়ে দিন! আর আপনাদের মতে সামনের মৌসুমে মেসি কি ক্লাব ছাড়বে, নাকি তার প্রিয় ক্লাব বার্সাতেই আবার ঝলক দেখাবে?
তথ্যসূত্র:
- FC Barcelona
- ESPN
- The Sun
- Goal
- Planet Football
- Britannica
- The Guardians
ফিচার ছবি – লিওনেল মেসি । সূত্র – getty images
আরও পড়ুন: সাভান্ট সিনড্রোম ও কিছু মানুষের বদলে যাওয়া জীবনের গল্প (পর্ব ১)