- মেরি কুরি: তেজস্ক্রিয়তায় প্রাণ গেলো যাঁর - August 20, 2020
কাছে গেলেই রয়েছে প্রাণের ঝুঁকি। এমন পদার্থকে বছরের পর বছর পকেটে নিয়ে ঘুরতে পারবেন কি? একজন কিন্তু ঠিকই পেরেছেন। তেজস্ক্রিয় পদার্থ নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করেছেন গোটা জীবন। জ্ঞানের উৎকর্ষসাধনে উৎসর্গ করেছেন নিজের প্রাণ। মেরি কুরি, হ্যাঁ, কথা বলছি তাকে নিয়েই।
শৈশব এবং শিক্ষা
মেরি কুরি ১৮৬৭ সালের ৭ই নভেম্বর পোল্যান্ডে জন্মগ্রহণ করেন। মেরি কুরি ছিলেন পিতামাতার পাঁচ সন্তানের মধ্যে সবচেয়ে ছোট। মেরির বাবা মা উভয়েই শিক্ষক ছিলেন। তাঁর বাবা লেডিস্লাও ছিলেন গণিত ও পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষক। মাত্র ১০ বছর বয়সে মেরি কুরি তাঁর মা ব্রোনিসলয়াকে হারান।
এরপর তিনি বাবার সান্নিধ্যে বড় হন। ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনার প্রতি প্রবল আগ্রহী ছিলেন মেরি। মাধ্যমিক স্কুলের সেরা ছাত্রী হয়েও তিনি অরসাওয়ের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারেন নি। কারণ সেটি ছিল শুধু ছেলেদের পড়ার জন্য।
মেরি ও তাঁর বোন ব্রোনিয়া দুজনেই বিদেশে গিয়ে পড়ালেখার স্বপ্ন দেখতেন। কিন্তু পড়াশোনার খরচ জোগানোর জন্য তাঁদের কাছে পর্যাপ্ত অর্থ ছিল না। কিন্তু তাঁদের ইচ্ছা ছিল অদম্য। দুই বোন মিলে এক চুক্তি করলেন। মেরি কুরি ব্রোনিয়াকে সাহায্য করবেন যতদিন না তাঁর পড়ালেখা শেষ হচ্ছে। বিনিময়ে ব্রোনিয়া পড়ালেখা শেষ করার পর মেরিকে পড়ালেখায় সাহায্য করবেন।


প্রায় পাঁচ বছর মেরি গভর্নেস ও গৃহশিক্ষক হিসেবে কাজ করেন। কাজের অবসরে তিনি পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন ও গণিত বিষয়ে বিভিন্ন বই পড়তেন।
১৮৯১ সাল, মেরি কুরির স্বপ্ন পূরণ হলো এবার। পাড়ি জমালেন প্যারিসের বিখ্যাত সোরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ে। তিনি গভীরভাবে পড়াশোনায় মনোনিবেশ করলেন। এর মূল্যও তাঁকে জোগাতে হয়েছে হাড়ে হাড়ে। সামান্য অর্থ দিয়ে কোনোমতে তাঁর দিন চলত। ভালো খাবার গ্রহণ না করায় প্রায়শ অসুস্থ থাকতেন।
১৮৯৩ সালে তিনি পদার্থবিজ্ঞানে মাস্টার্স অভিধা সম্পন্ন করেন। পরের বছরে তিনি গণিতেও ডিগ্রি অর্জন করেন।
পিয়ারে কুরির সাথে বিয়ে
মেরি কুরি ১৮৯৫ সালের ২৬ শে জুলাই ফরাসি পদার্থবিজ্ঞানী পিয়ারে কুরির সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। সোরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় মেরি কুরি পিয়ারে কুরির সাথে পরিচিত হন।
দুজনের মধ্যে একটা ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তাঁরা একে অপরের প্রতি খুবই আন্তরিক ছিলেন। শুরুতে মেরি এবং পিয়ারে স্বতন্ত্র প্রকল্পে কাজ করলেও মেরি কুরির তেজস্ক্রিয়তা আবিষ্কারের পর, পিয়ারে নিজের কাজ বাদ দিয়ে স্ত্রীকে সাহায্য করেন।
১৯০৬ সালে দুর্ঘটনাবশত ঘোড়ার গাড়ির সামনে পড়ে পিয়ারে কুরির মৃত্যু ঘটে। স্বামীর মৃত্যুর শোক সত্ত্বেও সোরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম মহিলা প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন।
ছেলেমেয়ে
১৮৯৭ সালে মেরি এবং পিয়ারে তাঁদের প্রথম কন্যা ইরেনিকে পৃথিবীর আলো দেখান। তাঁদের দ্বিতীয় কন্যা ইভের জন্ম হয় ১৯০৪ সালে।
ইরেনি জোলিয়ট-কুরি তাঁর মায়ের দেখানো পথ অনুসরণ করেন। নতুন তেজস্ক্রিয় মৌল আবিষ্কার করায় ১৯৩৫ সালে তিনি ও তাঁর স্বামী নোবেল পুরস্কার অর্জন করেন।
১৯৩৭ সালে ইভ কুরি তাঁর মায়ের জীবনী লেখেন যেটি নিয়ে পরবর্তীতে সিনেমা তৈরি করা হয়েছিল।
মেরি কুরির আবিষ্কার
কুরি তাঁর স্বামীর সাথে তেজস্ক্রিয় পদার্থ পোলোনিয়াম এবং রেডিয়াম আবিষ্কার করেন। স্বামীর মৃত্যুর পর তিনি এক্স-রের উন্নতিতেও কাজ করেন।
তেজস্ক্রিয়তা, পোলোনিয়াম এবং রেডিয়াম
মেরি কুরি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখেন, যে অবস্থতেই থাকুক না কেন—ইউরেনিয়াম এক ধরনের রশ্মি বিকিরণ করে। ইউরেনিয়ামের গঠনগত কারণেই এই ধরনের রশ্মি বিকিরিত হয়। কুরি নিজে এই রশ্মির নাম দেন তেজস্ক্রিয় রশ্মি। মেরি কুরির এই যুগান্তকারী আবিষ্কার পদার্থবিজ্ঞানে এক নতুন শাখার সৃষ্টি করে।
তেজস্ত্রিয়তা আবিষ্কারের পর কুরি দম্পতি তাঁদের গবেষণা চালিয়ে যান। খনিজ পিচব্লেন্ড নিয়ে কাজ করার সময় ১৮৯৮ সালে তাঁরা একটি নতুন তেজস্ক্রিয় পদার্থ আবিষ্কার করেন। মেরির নিজ দেশ পোল্যান্ডের নামানুসারে তাঁরা এই পদার্থের নাম দেন পোলোনিয়াম।
পিচব্লেন্ড থেকে তারা রেডিয়াম নামে আরও একটি তেজস্ক্রিয় পদার্থ আবিষ্কার করেন। ১৯০২ সালে কুরি দম্পতি ঘোষণা দেন যে, তারা এক ডেসিগ্রাম রেডিয়াম প্রস্তুত করেছে। এর ফলে রেডিয়ামের অস্তিত্ব প্রমাণিত হয়।
এক্স-রের উন্নয়ন
১৯১৪ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর সময় মেরি কুরি এক্স-রের উন্নতিতে কাজ করেন। তিনি সহজে বহনীয় এক্স-রে মেশিন তৈরি করেন। ডাক্তাররা এটাকে লিটল কুরি নামে ডাকে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর তিনি তাঁর সুখ্যাতিকে কাজে লাগিয়ে রিসার্চের জন্য অর্থ সংগ্রহ করেন। তিনি ১৯২১ ও ১৯২৯ সালে রেডিয়াম কেনার অর্থ সংগ্রহের জন্য আমেরিকা পাড়ি জমান।
এবার পেলেন নোবেল পুরষ্কার
মেরি কুরি ছিলেন ইতিহাসের সর্বপ্রথম নোবেল জয়ী নারী। তিনি ১৯০৩ সালে পদার্থবিজ্ঞানে ও ১৯১১ সালে রসায়নে নোবেল পুরষ্কার লাভ করেন। ইতিহাসে তিনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি বিজ্ঞানের দুটি আলাদা বিষয়ে (পদার্থ ও রসায়ন) নোবেল পুরষ্কার লাভ করেন।
১৯০৩ সালে মেরি কুরি ও তাঁর স্বামী তেজস্ক্রিয় পদার্থ নিয়ে কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পান। পুরষ্কারের টাকা দিয়ে তাঁরা গবেষণা চালিয়ে যান।
১৯১১ সালে তিনি রেডিয়াম ও পোলোনিয়াম আবিষ্কারের জন্য দ্বিতীয় বারের মতো রসায়নে নোবেল পুরষ্কার লাভ করেন। এই সময়ে তিনি অ্যালবার্ট আইন্সটাইন ও ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক এর মত বড় বড় বিজ্ঞানীদের সাথে কাজ করার সুযোগ পান।
মৃত্যু
মেরি কুরি কর্মজীবনের বেশিরভাগ সময় তেজস্ক্রিয় পদার্থ নিয়ে কাজ করেছেন। কিন্তু তিনি তেজস্ক্রিয় রশ্মির ভয়াবহতা সম্পর্কে জানতেন না।
তিনি সবসময় পকেটে করে রেডিয়ামের শিশি নিয়ে ঘুরতেন। ১৯৩৪ সালের ৪ জুলাই কোনো এক অজানা রোগে তাঁর মৃত্যু হয়। ধারণা করা হয়, তেজস্ক্রিয়তাই তাঁর মৃত্যুর কারণ।
চলচ্চিত্র
১৯৪৩ সালে মেরি কুরিকে নিয়ে করা প্রথম চলচ্চিত্র মাদাম কুরি মুক্তি পায়। এছাড়াও মেরি কুরির জীবন নিয়ে মেরি কুরি: দ্য করেজ অফ নলেজ (মেরি কুরি: জ্ঞানের পরাক্রম, রেডিয়োঅ্যাক্টিভ (তেজস্ক্রিয়তা)সহ বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্র মুক্তি পায়।
মেরি কুরির জিনিসপত্র: দেখতে হলেই প্রাণের ঝুঁকি
মেরি কুরির মৃত্যুর প্রায় ১০০ বছর পেরিয়ে গেছে। তাঁর পোশাক, ডাইরি, আসবাবপত্র এবং রিসার্চ পেপার গুলো এখনো তেজস্ক্রিয়।
রাষ্ট্রীয় এবং বিজ্ঞানের সম্পদ বিবেচনায় মেরি কুরির ব্যবহৃত জিনিপত্র ফ্রান্সের প্যারিসে অবস্থিত জাতীয় লাইব্রেরিতে সিসার তৈরি বাক্সের মধ্যে সংরক্ষিত আছে যাতে এগুলো তেজস্ক্রিয় রশ্মি বিকিরণ করতে না পারে।
আপনি যদি তাঁর জিনিসপত্র দেখতে চান তবে আপনাকে একটি দলিলে স্বাক্ষর করতে হবে। আর সেই দলিলে লেখা থাকবে,
আপনার যদি মৃত্যু হয় তাহলে কেউ দায়ী থাকবে না।
এমনি ঝুঁকি বিবেচনায় মেরি কুরিকে যে কফিনে সমাধিত করা হয় সেটিও ১ ইঞ্চি সিসার পাতে মুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
আরও পড়ুন: শ্রোডিঙ্গার এবং তাঁর সমীকরণ ও বিড়ালের গল্প
তথ্যসূত্র:
ফিচার ছবিসূত্রঃ Flickr