- সেরার সেরা দাবাড়ুগণ ৩: মিখাইল তাল, দ্য ম্যাজিশিয়ান ফ্রম রিগা, পর্ব ৩ - December 31, 2020
- সেরার সেরা দাবাড়ুগণ ২: মিখাইল তাল, দ্য ম্যাজিশিয়ান ফ্রম রিগা ২য় পর্ব - December 1, 2020
- সেরার সেরা দাবাড়ুগণ ১: মিখাইল তাল, দ্য ম্যাজিশিয়ান ১ম পর্ব - November 20, 2020
খেলাধুলার মধ্যে দাবা যেমন বেশ বুদ্ধিবৃত্তিক, সাথে আনপ্রেডিক্টেবল; তেমনই দাবাড়ুদের জীবনও বেশ বৈচিত্র্যময়। বিশ্বখ্যাত যেসব দাবাড়ু স্বীয় প্রতিভা আর সৃজনশীলতা দিয়ে দাবার বোর্ডে নিজের নাম স্বর্ণাক্ষরে লিখে গিয়েছেন, আমাদের এই সিরিজ তাদের নিয়েই! এখানে বিশ্বচ্যাম্পিয়নদের নিয়ে যেমন আলোচনা আসবে, তেমনই গ্র্যান্ডমাস্টারই হননি, এমন দাবাড়ুদের ক্যারিয়ারও তুলে আনবো আমরা পাদপ্রদীপের আলোয়। কিস্তিমাতের এই ধারাবাহিকের শুরুটা আমরা করেছি অষ্টম বিশ্বচ্যাম্পিয়ন মিখাইল তাল তথা ম্যাজিশিয়ানকে দিয়ে।
প্রথম পর্বে এবং দ্বিতীয় পর্বে আমরা তালের বাল্যকাল, দাবায় আগমন, খেলার ধরন, ক্যান্ডিডেট টুর্নামেন্ট জয় এবং রেকর্ড সৃষ্টি করে বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপ জয় দেখেছি। আজকের তৃতীয় পর্বে তালের বিশ্বচ্যাম্পিয়নের খেতাব হারানো, তৎপরবর্তী ক্যারিয়ার, অসুস্থতা, মৃত্যু নিয়ে আলোচনা থাকবে। শেষ পর্বে আমরা তার লেগ্যাসি তথা তার স্মরণে অন্যান্য বিশ্বখ্যাত দাবাড়ুদের বিশ্লেষণ নিয়ে হাজির হবো।
Tal doesn’t move the pieces by hand, he just uses a magic wand!
Grandmaster Ragozin১


মুকুট হারানো
গত বছর তালের কাছে বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপ হারানো বতভিনিক ১৯৬১ সালে সরাসরি রি-ম্যাচ পান তৎকালীন নিয়ম অনুসারে। এই ম্যাচে ড্র হয় মাত্র ছয় গেম। তাল অষ্টম গেম ড্র করে পয়েন্ট কাছাকাছি আনেন ৪.৫-৩.৫ করেন। কিন্তু পরবর্তী তিন গেম টানা জিতে বতভিনিক এক বড়সড় লিড নেন। এরপরের নয়গেমে দুইপক্ষই তিনটি করে জয় পায়। এরপর শেষগেমটি জিতে পুরো চ্যাম্পিয়নশিপের সু-সমাপ্তি করেন বতভিনিক। ১৩-৮ পয়েন্টে তার হারানো মুকুট পুনরুদ্ধার করেন এই গ্র্যান্ডমাস্টার।
ম্যাচ শেষের সংবাদ সম্মেলনে বতভিনিক তালের প্রশংসা করার পাশাপাশি প্রস্তুতির অভাবকে পরাজয়ের অন্যতম নিয়ামক হিসেবে উল্লেখ করেন। বতভিনিক বলেন,
যখন বোর্ডে ঘুঁটির আধিক্য থাকে, অনেক ভ্যারিয়েশন সম্ভব হয় সেরকম ক্ষেত্রে তালের সমকক্ষ কেউ নেই। তালের ক্যালকুলেশন স্কিলও দারুণ! তবে তার প্রস্তুতিতে ঘাটতি স্পষ্টভাবে লক্ষ্যনীয়। পর্যাপ্ত প্রিপারেশন নিয়ে আসলে এখনকার থেকে অনেকগুন বেশি বিপজ্জনক হিসেবে আবির্ভূত হতেন তিনি।
বয়সে বতভিনিকের অর্ধেক হলেও তাল এই সামান্য বয়সেই জটিল এক ব্যাধিতে ভুগতে শুরু করেছিলেন। কিডনির সমস্যা তাকে যথেষ্ট ভোগাচ্ছিল, যদিও তাল কোনো অজুহাত দেননি। মিখাইল তাল আসলেই মহানুভব একজন ব্যক্তি ছিলেন, ম্যাচ জয়ের পূর্ণ কৃতিত্ব বতভিনিককে দিয়ে তিনি বলেন,
I think that I lost to him because he beat me! He was very well-prepared for the second match. Botvinnik knew my play better than I knew his.


বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপ পরবর্তী ক্যারিয়ার
তাল পরবর্তীতে আর বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপ ম্যাচের জন্য কোয়ালিফাই করতে পারেননি। অসুস্থতার জন্য ১৯৬২ সালের ক্যান্ডিডেটস টুর্নামেন্ট থেকে নিজের নাম প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হন তাল। যদিও ষাটের দশক জুড়েই বেশ শক্ত খেলোয়াড় হিসেবে খেলে গিয়েছেন তিনি। ১৯৬৪ সালে ইন্টারজোনাল টুর্নামেন্ট জিতে তা আবার প্রমাণ করেন তাল। ক্যান্ডিডেটস টুর্নামেন্ট খেলার যোগ্যতা অর্জন করেন আবার, যার বিজয়ী চ্যাম্পিয়নকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে ফাইনালে বরিস স্পাস্কির কাছে +১ -৪ =৬ পয়েন্টে (একটি জয়, চারটি পরাজয়, ছয় ড্র)হেরে সেই আশায় গুড়েবালি হয় তালের। ১৯৬৭ সালে তাল তার তৃতীয় সোভিয়েত চ্যাম্পিয়নশিপ অর্জন করেন লেভ পোলগেভস্কির সাথে যৌথভাবে। ১৯৬৯ সালের ক্যান্ডিডেটস-এর সেমিফাইনালে ভিক্টর কোর্চনোই এর কাছে হেরে যান তাল। এভাবে আর ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপ খেলা হয়ে ওঠেনি তালের।


অসুস্থতা এবং একটি মজার ঘটনা
পুরোটা ক্যারিয়ার জুড়েই অসুস্থতা অনেক ভুগিয়েছে তালকে। অনেকবার টুর্নামেন্টের মাঝখানে সরাসরি হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছে। তাল তার আত্মজীবনীতে২ ১৯৬৯ সালের একটি ঘটনা লিখেছেন। সেবার তিবিলিসি গিয়ে তার একটি কিডনি অপসারণ করেন তিনি। চিকিৎসকদের মতে যা আরও ২-৩ বছর আগেই অপসারণ করা দরকার হয়ে পড়েছিল। অপারেশন সফলভাবেই সম্পন্ন হয়, পাঁচদিন পরেই তাল পরবর্তী টুর্নামেন্ট খেলার জন্য তৈরি হওয়া শুরু করেন।
কিন্তু গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে, অপারেশন থিয়েটারেই তাল মারা গেছেন। যুগোস্লাভিয়ার পত্র-পত্রিকায় সেই খবর ছাপা হলে তার সেখানকার বন্ধু-বান্ধবগণ শোকে বিহ্বল হয়ে পড়েন। তাল তখন সশরীরে তাদের আশ্বাস দিতে যান সেই ক্লাসিক কৌতুক বলে, The rumors about my death are greatly exaggerated! সেখানে তার কাঙ্ক্ষিত টুর্নামেন্টটিও খেলেন তাল, সুয়েটিনের বিপক্ষে এক ম্যাচে কুইন স্যাক্রিফাইস করলে ধারাভাষ্যকার হাস্যরস করে বলেন, not bad for a dead man, don’t you think!


ক্যারিয়ারের পড়ন্তবেলায়
রোগের সাথে যুঝে হলেও খেলা চালিয়ে গিয়েছিলেন তাল। শুধু ষাটের দশকই নয়, সত্তর এমনকি আশির দশকেও দারুণ প্রতাপের সাথে খেলতে থাকেন তাল। তার পরের তিনটি সোভিয়েত চ্যাম্পিয়নশিপ যথাক্রমে ১৯৭২, ১৯৭৪ এবং ১৯৭৮ এ নিজের করে নেন তিনি। এর মধ্যে ১৯৭২-৭৪ এই সময়কালে দুইটি আনবিটেন স্ট্রিক গড়েন ৮৬ এবং ৯৫ ম্যাচের যা কিনা ২০১৮ পর্যন্ত টিকে ছিল! র্যাঙ্কিং-এ সর্বদাই শীর্ষ দশের মধ্যে থাকতেন তিনি, এমনকি বিভিন্ন সময় ২-৩ এও উঠে এসেছিলেন!
কিংবদন্তি ববি ফিশার কিন্তু তালকে খেলতে মোটেই স্বাচ্ছন্দ্য পেতেন না। তিনি ফিশারের জন্য বলা যায় অভিশাপের মতো ছিলেন। কারণ, তাল প্রায় সর্বদাই তাকে শোচনীয়ভাবে হারাতেন। ফিশার ১৯৬১ সালে ব্লেড টুর্নামেন্টে তালের বিরুদ্ধে প্রথমবারের মতো জিততে সক্ষম হন। কিন্তু তা সত্ত্বেও, তাল সবসময় ফিশারের জন্য ঝামেলা হয়ে ছিলেন, বিশেষ করে তার ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে।


এরপর একটা সময় তাল কারপভের সাথে কাজ করেছেন, খুব গুরুত্বের সাথে কাজ করেছেন। যদিও তাদের খেলার ধরন ভিন্ন ছিল। ধারণা করা হয়, ফিশারের বিরুদ্ধে ম্যাচের আগে এটা শুরু করেন তারা, কারপভ যখন কোর্চনোইয়ের সাথে খেলেন তখন তাল তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। কিন্তু তাদের এই আন্তঃসম্পর্কের সর্বোচ্চটা ছিল ১৯৭৮ সালে। এ সময় তালের উত্থানকেও নির্দেশ করে, কারণ এই ধরনের সহযোগিতা উভয় পক্ষকেই সাহায্য করে। তালের সাহায্য কারপভের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল, কিন্তু তালও দাবার নতুন ধাঁচ সম্পর্কে অনেক কিছু শিখেছিলেন। তালের ১৯৭৮-৭৯ সালে তার উত্থানও এই কাজের ফল।
জীবনের শেষ বড় কোনো অর্জন হিসেবে তাল ১৯৮৮ সালে দ্রুতগতির ব্লিটজ বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হন! ৩২ জনের নক-আউট টুর্নামেন্ট ছিল এটি। কারপভ প্লে-অফেই ছিটকে যান, ক্যাসপারভ কোয়ার্টার-ফাইনালে।
মৃত্যু
দাবা অন্তঃপ্রান এই মানুষটা মৃত্যুর একমাস আগেও ব্লিটজ টুর্নামেন্ট খেলেছেন। খেলাটাকে আসলেই মন থেকে ভালবাসতেন তিনি। কিডনি ফেইলিউরকে তার মৃত্যুর কারণ হিসেবে বলা হয়। স্বাস্থ্যের দিকে বলতে গেলে নজরই ছিল না তার, পার্টিপ্রিয় তাল একদিকে যেমন ছিলেন তুখোড় ধূমপায়ী, সাথে মদ্যপানও করতেন বলে জানা যায়। যেগুলো এই মারাত্মক পরিণতির দিকে এগিয়েই দিয়েছে শুধু। আরেক বর্ণনা অনুযায়ী অন্ননালীতে রক্তক্ষরণে মারা যান তিনি। মস্কোর এক হাসপাতালে ২৭ অথবা ২৮ জুন দেহত্যাগ করেন এই জাদুকর। গ্যারি ক্যাসপারভ তার বইয়ে৩ ২৮ জুন বলেছেন, যদিও তালের সমাধিফলকে উৎকীর্ণ আছে ২৭ তারিখ।


অসাধারণ খেলার ধরনের কারণে মিখাইল নেখমেভিচ দ্য এইটথ, তাল বিভিন্ন উপাধিতে ভূষিত হয়েছিলেন। যার মধ্যে দ্য ম্যাজিশিয়ান ফ্রম রিগা, দ্য পাইরেট অফ লাতভিয়া, দ্য এলিয়েন ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। বন্ধুরা ডাকত মিশা বলে। তাল আসলে দাবার এক বিপ্লবের নাম, প্রথাগত শিকল ভেঙে নিয়ম-কানুনের ঊর্ধে ওঠার নাম। তালের মৃত্যুর পর মার্কিন গ্র্যান্ডমাস্টার রবার্ট ব্রাইন নিউ ইয়র্ক টাইমসকে বলেন, এটা শুনতে খুব সাধারণ শোনাতে পারে, কিন্তু খুব কম খেলোয়াড়ই তার মত দাবাকে ভালবাসত। অনেকের কাছেই খেলাটা একটা পরিশ্রমের মত, যেখানে তাল আসলে সেটা উপভোগ করতেন।
চলবে …
প্রচ্ছদ চিত্রসূত্র: উইকিমিডিয়া কমন্স
তথ্যসূত্র:
- Mikhail Tal, Chess.com
- Botvinniks 1961 after match press conference, Chess.com Blog/Spectrowsky
- Kasparov on Tal, Echo Moskvy
- Tal-Botvinnik 1961, ChessGames.com
টিকা:
- ১ Tal, Mikhail. Tal-Botvinnik 1960. Revised & Expanded Fifth Edition. 2000. ISBN: 1-888690-08-9.
- ২ Tal, Mikhail. Damsky, Iakov. The Life and Games of Mikhail Tal. Cadogan Chess Series. 1998. ISBN: 1 85744 202 4.
- ৩ Kasparov, Garry. My Great Predecessors II. Everyman Chess Series. 2003. ISBN: 1 85744 342 X.
সম্পর্কিত নিবন্ধসমূহ: