- কল্পকাহিনীকে হার মানানো আপেক্ষিক সময়ের তত্ত্ব এবং টুইন প্যারাডক্স - March 26, 2021
- মুখোমুখি বাপু ও বঙ্গবন্ধু: সমাপ্ত বনাম অসমাপ্ত অধ্যায় - January 20, 2021
- ক্ষুদিরাম বসু: ছোট্ট অথচ বিদ্রোহী এক জীবন - December 3, 2020
পৃথিবীতে কালান্তরে এমন কিছু মানুষের আবির্ভাব ঘটে যাদের আগমন এবং কর্মকাণ্ডে পুরো মানবজাতির কল্যাণ নিহিত থাকে। অন্ধকারে তাঁরা আসেন আলাের মশাল নিয়ে। নতুন করে ভাবতে শেখান, নিজেদের অধিকার আদায় করতে শেখান নিপীড়িত, নির্যাতিত মানুষের। তেমনি একজন মহামানব কিংবদন্তি গান্ধী, মহাত্মা উপাধিসহ যাকে লোকে মহাত্মা গান্ধী নামেই চেনে। যার হাতে দমিত হয়েছে ব্রিটিশ শাসনের শৃঙ্খল। সূচিত হয়েছে স্বাধীনতার সূর্য। জীবনের সবটুকু দিয়ে রচনা করেছেন মানবকল্যাণের বাণী। তিনি সার্বজনীন, অমলিন, সর্বদলীয় আদর্শ।
গান্ধী ও তাঁর জন্মকথা
পুরো নাম মােহনদাস করমচাঁদ গান্ধী। সবার কাছে মহাত্মা গান্ধী নামে পরিচিত। তাঁর জন্ম ২রা অক্টোবর ১৮৬৯ সালে, গুজরাটের পোরবন্দরে। বাবা ছিলেন পােরবন্দরের দেওয়ান (প্রধানমন্ত্রী)। মা ছিলেন প্রণামী, বৈষ্ণব গােষ্ঠীর। তাই ছােটবেলা থেকেই তিনি জীবের প্রতি অহিংসা, নিরামিষভােজন, আত্মশুদ্ধির জন্য উপবাসে থাকা, বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী ও সম্প্রদায়ের পারস্পরিক সহিষ্ণুতা ইত্যাদি বিষয় শিখতে আরম্ভ করেন।
বিবাহ
১৮৮৩ সালে মাত্র ১৪ বছর বয়সে বাবা মায়ের পছন্দে কস্তুরবা মাখাঞ্জীর সাথে তাঁর বিবাহ অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়। পরবর্তীতে গান্ধী দম্পতির কোল আলো করে চার ছেলে হরিলাল গান্ধী, মনিলাল গান্ধী, রামদাস গান্ধী এবং দেবদাস গান্ধী পৃথিবীতে আসে।


শিক্ষাজীবনে গান্ধী
ছাত্রজীবনের অনেকটা সময় কাটে পােরবন্দর ও রাজকোটে। তিনি গুজরাটের ভবনগরের সামালদাস কলেজ থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তারপর পরিবারের ইচ্ছায় মাত্র ১৮ বছর বয়সে ১৮৮৮ সালের ৪ সেপ্টেম্বর ব্যারিস্টারি পড়ার জন্য ইউনিভার্সিটি কলেজ অফ লন্ডনে চলে যান। রাজধানী লন্ডনে তার জীবন-যাপন ছিল মায়ের কাছে করা শপথে প্রভাবিত। মায়ের কাছে দেয়া শপথ অনুযায়ী মাংস, মদ এবং খারাপ নারী ত্যাগসহ হিন্দুদের সকল নৈতিক উপদেশ তিনি যথাযথ ভাবে পালন করেন।
পিতা-মাতার প্রতি গান্ধী
আত্মত্যাগের যে কোনাে উদ্যোগে অন্যের সাথী হওয়া সর্বদাই উত্তম কাজ। আপনার সন্তানকে সকল ভালো আত্মত্যাগে উৎসর্গ করবেন। পাশাপাশি চেষ্টা করবেন প্রত্যেক বালক-বালিকাকে কিছু প্রয়ােজনীয় হাতের কাজ শিক্ষা দেয়া। এতে তাদের পর্যাপ্ত ব্যায়াম হবে এবং তারা যে-কোনো কঠিন কাজ সানন্দে করার মত মনোবল পাবে।
-মহাত্মা গান্ধী
চরিত্র গঠনকে ছেলে মেয়েদের সঠিক শিক্ষার জন্য ভিত্তি হিসেবে গণ্য করা উচিত। তাদের এ ভিত্তি যদি দৃঢ়ভাবে স্থাপিত হয় তাহলে তারা নিজেরাই অথবা বন্ধুদের সাহায্যে অন্য সকল বিষয় শিখতে পারবে, এমনটাই মনে করতেন মহান আত্মার ধারক মহাত্মা গান্ধী।
আজ থেকে আপনি আপনার ছেলেদেরকে অন্য ছেলেদের থেকে উৎকৃষ্টতর ভাবুন, তা আপনি কোন দিনই তাদের সম্মুখে বলবেন না। তাদের মাথায় এরূপ উৎকৃষ্টতার ধারণা ঢুকিয়ে দেয়ার অর্থ হলাে তাদেরকে গােল্লায় যেতে সাহায্য করা।
-মহাত্মা গান্ধী
আরও পড়ুন: স্টেথোস্কোপ আবিষ্কার: মেয়ে ভীতি থেকে যে যন্ত্রের জন্ম
শিক্ষকদের প্রতি মহাত্মা গান্ধী
তিনি মনে করতেন ছেলে ও মেয়েদেরকে সঠিকভাবে লালন-পালন ও শিক্ষা দেওয়া সত্যিই অনেক কঠিন কাজ। তিনি তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেন-
“আপনার সন্তানের যথাযথ বিকাশে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রয়ােজনীয়তা অবশ্যই আছে। পাঠ্যবই সম্পর্কে আমরা অনেক কথা শুনে থাকি। এর মূলে যা রয়েছে তা হচ্ছে-
ছাত্রদের ওপর বেশি বই এর বােঝা চাপানাে মােটেই যুক্তিযুক্ত নয় বলে আমার ধারণা। আমি সর্বদা অনুভব করেছি যে ছাত্রদের জন্য সত্যিকার পাঠ্যবই হলাে তাদের শিক্ষক। মনে পড়ে আমার শিক্ষকরা পাঠ্যবই থেকে আমাকে খুব অল্পই পড়িয়েছেন, তবে বই এর বাইরে থেকে তারা যা শিক্ষা দিয়েছেন তা এখনাে পরিষ্কার মনে আছে ।” -মহাত্মা গান্ধী
তাই প্রতিটি শিক্ষকের উচিত বিভিন্ন ধরনের বই পড়ে তা থেকে আত্মস্থ জ্ঞান নিজের ভাষায় সহজ সাবলীল ভাবে ছাত্রদের মাঝে বিলিয়ে দেয়া। কেননা শিশুরা দেখে শেখার চাইতে শুনে বেশি শেখে।
বই পড়ে মনে রাখা তাদের জন্য বেশ পরিশ্রমের কাজ কিন্তু মুখে বলে তাদেরকে যা শেখানো হবে তা তারা অতি সহজেই মনে রাখতে পারবে। পড়া তাদের জন্য কঠিন কাজ কিন্তু তাদের জন্য শোনা আনন্দদায়ক। যদি কোনো একটা বিষয়কে আনন্দদায়ক করতে ব্যর্থতার কারণে একঘেয়ে করা হয়, তাহলে তখন সেটা আর শিক্ষা না থেকে শিক্ষার্থীদের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়ায়।
তাই প্রতিটি সত্যিকার শিক্ষক ও অভিভাবকের উচিত এবং দায়িত্বের একটি হচ্ছে সন্তানদের হৃদয়কে স্পর্শ করা। পাশাপাশি অবশ্যই তাদের সুখ-দুঃখের অংশীদার হওয়া এবং তাদের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করে, যৌবনের উদ্বেলিত আশা-আকাংক্ষা সঠিক পথে প্রবাহিত করার আপ্রাণ চেষ্টা করা।
ছাত্রদের অপকর্ম ধরা পড়লেই শিক্ষকের কর্তব্য হওয়া উচিত যত দ্রুত সম্ভব সঠিক পথে আনা। কিন্তু এর পূর্বশর্ত হতে হবে স্বচ্ছ অন্তদৃষ্টি ও আত্মিক উপযুক্ততা। যেখানে শিক্ষক ও ছাত্রদের মধ্যে সত্যিকার ভালােবাসা নেই যেখানে ছাত্রদের অপকর্ম শিক্ষকের মর্মমূলে আঘাত করেনা, সেখানে আর যাই থাকুক শিক্ষা নামক বস্তুটি নেই।
আবার যেখানে শিক্ষকের প্রতি ছাত্রদের সম্মানবােধ নেই, সেখানে ছাত্রের ভুলের জন্য শিক্ষকের দায়িত্বের বিষয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে না। ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্ক তো হবে একে অপরের আত্মার সম্পর্ক।
গান্ধীজির মূলনীতি
সত্য
সত্য একটা বিশাল বৃক্ষের মতাে, তুমি যত বেশি এর যত্ন নেবে, সে তত বেশি ফল দেবে। সত্যের খনিতে যত গভীরে অনুসন্ধান করবে, তত বেশি মণিমুক্তা আবিষ্কার করবে, তােমার সামনে বৈচিত্র্যময় সেবার বৃহত্তর দুয়ার খুলে যাবে।
-মহাত্মা গান্ধী
সত্যের সাধককে প্রায়ই অন্ধকারে হাতড়াতে হয় কিন্তু মানুষ নিজের কর্তব্য সম্পর্কে সর্বদা সমভাবে আগাম ও পরিষ্কার ধারণা করতে পারে না। তিনি নিজের জীবনকে সত্য অনুসন্ধানের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করেছিলেন। ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে এবং নিজের ওপর নিরীক্ষা চালিয়ে তা অর্জন করেছিলেন।
অহিংসা
হিংসা দ্বারা স্বাধীনতা অর্জন করার চেয়ে পরাধীনতা প্রিয়।
-মহাত্মা গান্ধী
অহিংসা হলাে একটি সমন্বিত নীতি। আমরা মরণশীল মানুষ অসহায়ভাবে হিংসার দাবানলে ধরা পড়ে যাই। জীবন জীবনকে খেয়ে বাঁচে এ কথার মধ্যে গৃঢ় অর্থ ভুলে যাই।
বাহ্যিকভাবে মানুষ জেনে হােক বা না জেনে হােক, হিংসার কাজ না করে বাঁচতে পারে না। প্রকৃতপক্ষে তার বেঁচে থাকা, খাওয়া, পান করা, ঘােরাফেরা এসবের মধ্যে আবশ্যিকভাবে কিছু হিংসা জড়িয়ে আছে এর জন্য প্রতিমুহূর্তে জীবনের ধ্বংস সাধিত হচ্ছে। সুতরাং একজন অহিংসার পূজারী তার বিশ্বাসে অবিচল থাকবে যদি তার সকল কাজের মূলে থাকে দয়া, যদি সে সাধ্যমতাে চেষ্টা করে ক্ষুদ্রতম প্রাণীরও ধ্বংস এড়িয়ে তাকে রক্ষা করতে চেষ্টা করে আর এভাবে হিংসার ভয়াবহ বৃত্ত থেকে নিজেকে মুক্ত রাখার অবিরাম চেষ্টা করে। তাহলে তার দয়া ও আত্ম-সংযম ক্রমাগত বাড়তে থাকবে।
গান্ধীজি তার জীবনীতে বলেন,
যখন আমি হতাশ হই, আমি স্মরণ করি সমগ্র ইতিহাসেই সত্য ও ভালােবাসার জয় হয়েছে। দুঃশাসক ও হত্যাকারীদের অপরাজেয় মনে হলেও শেষে সবসময়ই তাদের পতন ঘটে।
ব্রহ্মচর্য
একদিন স্ত্রীর সঙ্গে প্রণয়ের কিছু পর তাঁর বাবার মৃত্যুর সংবাদ আসে। ঘটনাটি তাঁর কাছে দ্বিগুণ লজ্জার হয়ে দাঁড়ায়। এই কারণে তিনি মাত্র ৩৬ বছর বয়সে বিবাহিত থাকা অবস্থায় ব্রহ্মচারী নীতি গ্রহণ করেন। গান্ধীর নিকট ব্রহ্মচর্যের অর্থ ছিল চিন্তা, বাক্য ও কর্মের নিয়ন্ত্রণ।
বিশ্বাস
তিনি সবসময় বলতেন,
আমাদের শ্রমের বদলে পুরস্কারের আশায় বসে থাকা উচিত নয়। আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে, সকল ভালাে কাজের প্রতিদান শেষ পর্যন্ত পাওয়া যায়। আমাদের সবার উচিত অতীতের কথা ভুলে গিয়ে সামনে যে কাজ আছে তা নিয়ে চিন্তা করা।
আবার একজন সাধারণ হিন্দু হিসেবে তিনি সব ধর্মকে সমানভাবে বিবেচনা করতেন।
সরলতা
গান্ধীজি প্রবলভাবে বিশ্বাস করতেন যে, সামাজিক কাজে নিয়ােজিত ব্যক্তি অবশ্যই সরল সাধারণ জীবন-যাপন করবে। তিনি নিজেও দক্ষিণ আফ্রিকায় যাপিত পশ্চিমা জীবনাচরণ ত্যাগ করার মাধ্যমে এর প্রমাণ দেন। এমন জীবনধারণ ব্যবস্থাকে শূন্যে নেমে যাওয়া হিসেবে আখ্যায়িত করেন। তাঁর জীবনাচরণে ছিল অপ্রয়ােজনীয় খরচ কমিয়ে ফেলা, সাদামাটা জীবন-যাপন গ্রহণ এবং নিজের কাপড় নিজে ধােয়া ।
২০০৭ সালের ১৫ জুন জাতিসংঘের সাধারণ সভায় তাঁর জন্মদিন ২ অক্টোবরকে আন্তর্জাতিক অহিংস দিবস হিসেবে ঘােষণা করা হয়। জাতিসংঘের সব সদস্য দেশ এমনকি বাংলাদেশও এই দিনটিকে বিশেষভাবে পালন করা হয়। এ দিনটিকে ভারত সরকার প্রতিবছর গান্ধীজি জয়ন্তী হিসেবে পালন করে।


মহান আত্মা যার তাঁকেই তাে মহাত্মা বলা যায়। জনমানবের কল্যাণে তাঁরা নিজেকে মহানুভবতার উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরতে সক্ষম। মহাত্মা গান্ধীও ছিলেন তেমনি একজন মানুষ। তিনি ছিলেন ভারতবর্ষের জন্য বিধাতার অকৃত্রিম দান। তাইতো বিশ্বের সব গোত্রের, সব ভাষাভাষীর মানুষ তাকে আজও শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে আসছে, ভবিষ্যতেও স্মরণ করে যাবে।
সহায়ক গ্রন্থপুঞ্জি:
- Gandhi, Mahatma. The Story of My Experiments With Truth: An Autobiography of Mahatma Gandhi
- গান্ধী, মহাত্মা.আমার আত্মজীবনী, অনুবাদক: আব্দুল ওয়াহাব। প্রকাশনালয়: স্বরবৃত্ত, ISBN:9789848939581
তথ্যসূত্র:
ফিচার ছবিসূত্র: Wikimedia Commons
অসাধারণ শব্দের বুনন। অহিংসা সম্পর্কে গান্ধীজীর উক্তিটি তীরের মত বুকে এসে বেঁধেছে।
ধন্যবাদ।পাশাপাশি উনার রচিত আত্মজীবনী পড়ে দেখার অনুরোধ রইলো।এমন অনেক কথা আছে যা পড়ে সত্যিই শরীরে অন্যরকম শিহরণ আসে,ভাবিয়ে তুলে কল্পনার গহীন থেকে গহীনের সুপ্ত,অচিন্তনীয় ভাবনাগুলো কে।