- দ্য স্পাই ইন ইয়োর ফোন: এনএসও কর্তৃক তথ্যের বিপজ্জনক ব্যবহার - January 22, 2021
- এক পৃথিবী, এক রাষ্ট্র: বাস্তব নাকি কেবলই ধূসর কল্পনা - January 18, 2021
- সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়: বাংলা চলচ্চিত্রের মুকুটহীন মহারাজ (তৃতীয় পর্ব) - December 27, 2020
অন্য অনেক সাম্রাজ্যের সাথে তুলনা করলে, মুঘল রাজবংশের স্থায়িত্ব ছিল কম। ১৫২৬ থেকে ১৮৫৭, রাজবংশের স্থায়িত্ব মাত্র ৩৫০ বছর। কিন্তু মুঘল শাসকেরা ছিলেন ব্যতিক্রম। স্থাপত্যকীর্তি যে হাজার হাজার বছর ধরে তাঁদের কথা মানুষের মাঝে স্মরণীয় করে রাখবে, সে সম্পর্কে তারা অবগত ছিলেন। আর সেই চিন্তাধারারই ফসল হল তাজমহল। একবিংশ শতাব্দীতে এসেও মুঘল রাজবংশের কীর্তি প্রচার করে যাচ্ছে তাজমহল। একই সাথে সম্রাট শাহজাহান ও মমতাজ মহলের অমর প্রেম কাহিনীকে প্রজন্মান্তরে ছড়িয়ে দিচ্ছে ভারতের উত্তর প্রদেশের আগ্রায় স্থাপিত এই তাজমহল। ১৯৮৩ সালে ইউনেস্কো এই অসামান্য স্থাপত্যকীর্তিকে বিশ্ব ঐতিহ্যের অন্তর্ভুক্ত করে।
তাজমহল যেন নদীর তীর বেয়ে বেড়ে ওঠা সময়ের কপোলতলে এক নিঃসঙ্গ অশ্রুবিন্দু।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
মমতাজ এবং শাহজাহানের প্রণয়
শাহজাহান এবং মমতাজের প্রথম সাক্ষাৎ হয় ১৬০৭ সালে, রাজকীয় মিনা বাজারে। মুঘল সাম্রাজ্যে মিনা বাজার নামে এক ব্যতিক্রমী প্রথা প্রচলিত ছিল। মুঘল সম্রাটরা খুব ধুমধামের সাথে নওরোজ উৎসব পালন করতেন। নওরোজ ছিল মূলত পারস্য এবং মধ্য এশিয়ায় প্রচলিত নববর্ষ উৎসব। এই উৎসবের অন্যতম অনুষঙ্গ ছিল মিনা বাজার। সেখানে রাজপরিবারের প্রায় সকল নারী এবং রাজ্যের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের পরিবারের নারী সদস্যরাও উপস্থিত থাকতেন। মমতাজের পিতা আসফ খান ছিলেন জাহাঙ্গীরের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা এবং পাশাপাশি জাহাঙ্গীরের স্ত্রী নূরজাহানের বড় ভাই।
এই কারণেই মুঘল রাজপরিবারের সাথে আসফ খান এবং তাঁর পরিবারের বেশ ঘনিষ্ঠতা। একারণেই মিনা বাজারে মমতাজ মহলও আমন্ত্রিত ছিলেন। সেখানেই তাঁদের সাক্ষাৎ হয় এবং এই সাক্ষাৎ থেকেই তাঁদের মাঝে সুসম্পর্ক গড়ে উঠে।
১৬০৭ সালে মমতাজ মহলের সাথে দেখা হওয়ার কিছুদিন পরেই তাঁদের আকদ সম্পন্ন হয়।
এর প্রায় পাঁচ বছর পরে, ১৬১২ সালের ৩০ এপ্রিল, রাজকীয় অনুষ্ঠানাদির মাধ্যমে তাঁদের বিবাহ সম্পন্ন হয়।
সম্রাজ্ঞী মমতাজ
শাহজাহানের সাথে বিবাহিত জীবনে অনেক ঝড়-ঝঞ্ঝা পোহাতে হয়েছে মমতাজ মহলকে। শাহজাহানের বিবাহের পূর্বেই সম্রাট জাহাঙ্গীর এবং তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র খসরু (শাহজাহানের বৈমাত্রেয় ভাই) বিরোধে জড়িয়ে পড়েন। অবস্থা এতটাই খারাপ হয়ে যায়, জাহাঙ্গীর বাধ্য হন সামরিক অভিযান পরিচালনা করতে। এর মাঝে দিয়ে সম্রাটের আরেক স্ত্রী নূরজাহান ধীরে ধীরে ক্ষমতা নিজের কুক্ষিগত করতে শুরু করেন এবং সম্রাটের সাথে শাহজাহানের সম্পর্কও খারাপ করার প্রচেষ্টা চালাতে থাকেন।
শাহজাহান বাধ্য হন নিজের স্ত্রীকে সাথে করে পালিয়ে যেতে। পালিয়ে পালিয়ে ভ্রমণ করেন ভারতবর্ষের বহু স্থানে। এই অবস্থায় তাঁর পুত্র-কন্যাদের জন্ম হয়।
ঘটনার ঘনঘটায় জাহাঙ্গীর মৃত্যুবরণ করেন এবং শাহজাহান সম্রাট হিসেবে অভিষিক্ত হন।
মমতাজ মহলের মৃত্যু
সর্বকনিষ্ঠ কন্যা গওহর বেগমকে জন্ম দিতে গিয়ে ১৬৩১ সালের ১৭ জুন মাত্র ৩৮ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। সে সময় শাহজাহান দাক্ষিণাত্যে বিজাপুরি সৈন্যদের বিরদ্ধে অভিযান পরিচালনা করছিলেন। শাহজাহানকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য মমতাজ মহল সেখানে অবস্থান করছিলেন। এখানেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
অস্থায়ীভাবে সম্রাট শাহজাহানের চাচা মির্জা দানিয়েলের বুরহানপুরে তাপ্তি নদীর অপর পাশে তৈরি করা জায়নাবাদ বাগানে মমতাজ মহলকে সমাহিত করা হয়।১


শাহজাহানের শোক প্রকাশ
স্ত্রী মমতাজ মহলের মৃত্যুর পরে শাহজাহান মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। তিনি বিলাপের এক পর্যায়ে বলেন,
না, এটা একটা বার্তা আমাদের সৃষ্টিকর্তা আমাকে মনে করিয়ে দিচ্ছেন যে, আমার সম্পদ আর ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও আমি শুধুমাত্র একজন মানুষ।২
সম্রাজ্ঞীর মৃত্যুতে সম্রাট শাহজাহান নিজে একবার সমস্ত রাজ্যপাট ছেড়ে সন্ন্যাস পর্যন্ত নেওয়ার কথা ভেবেছিলেন। কিন্তু কন্যা জাহানারা বেগমের কথায় এই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেন। যাবতীয় ধরনের রঙিন বস্ত্র এবং অলংকার পরিধান তিনি পরিত্যাগ করেন। জনশ্রুতি আছে যে, দুশ্চিন্তায় তাঁর মাথার সমস্ত চুল মাত্র দুই সপ্তাহের মধ্যেই সাদা হয়ে গিয়েছিল এবং তিনি এত বেশি ক্রন্দন করেছিলেন যে, তাঁর চোখের দৃষ্টিশক্তি দুর্বল হয়ে পড়ে।
রাজসভায় শোকের ছায়া নেমে আসে। তখনও দাক্ষিণাত্যে অবস্থান করেছিলেন। নির্বাহী আদেশে তিনি এক বছরের জন্য শোক পালনের আদেশ প্রদান করেন।
তাজমহল নির্মাণের সিদ্ধান্ত
তিনি সিদ্ধান্ত নেন, তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রীর সমাধি বুরহানপুরে এরূপ সাধারণ হবে না। তিনি এমন এক স্থাপনা গড়ে তুলবেন, যা যুগে যুগে কালে কালে সকলের কাছে তাঁর স্ত্রীর প্রতি তাঁর ঐকান্তিক প্রেমের সাক্ষ্য হয়ে থাকবে। তাই, বুরহানপুরের সাধারণ সমাধি থেকে তাঁর স্ত্রীর দেহাবশেষ তিনি উঠিয়ে আনার নির্দেশ দেন। তিনি দাক্ষিণাত্যে থাকা অবস্থায়ই তাঁর জ্যেষ্ঠ কন্যা জাহানারা মায়ের দেহাবশেষ নিয়ে আগ্রার উদ্দেশ্যে রওনা দেন। ১৬৩১ সালের ডিসেম্বর মাসে তিনি কন্যা জাহানারার থেকে পত্র পান –
‘আব্বাজান, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমি আপনাকে জানাতে চাই যে, আমরা দশ সপ্তাহের ভ্রমণ শেষে নিরাপদে আগ্রা পৌঁছেছি আর ঠিক যেভাবে আপনি চেয়েছেন, যমুনার তীরে অস্থায়ী একটি সমাধিতে মায়ের মৃতদেহ রাখা হয়েছে। যতই আমরা শহরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলাম রাস্তার দুই পাশে মাথায় ধুলা মেখে ক্রন্দন করছিল সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা জনতা। পুরো ভ্রমণ জুড়েই পারিপার্শ্বিক অবস্থা ছিল এরকম যেন দুঃখের নীল ছায়া গ্রাস করেছে আমাদের পুরো ভূমি। পরবর্তীতে সব জানিয়ে সবিস্তারে পত্র লিখবো।’৩
স্থাপনার স্থান নির্বাচন
এখন স্থান নির্ণয়ে খোঁজ লাগালেন শাহজাহান। শাহজাহানের স্বপ্নের স্থাপনা ছিল তুলনামূলকভাবে বৃহদাকৃতির। তাই স্থাপত্যবিদগণ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন প্রথমে শক্ত এবং কঠিন মাটির উপরে কাঠের শক্ত ভিত তৈরি করা হবে। তারপরে তার উপরে সেই বিশালাকৃতি স্থাপনা নির্মাণ করা হবে। শক্ত মাটির জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত ছিল নদীর তীরবর্তী পলিমাটি। এই কারণে, যমুনা নদীর তীরবর্তী কোনো স্থান নির্বাচন করাই যুক্তিযুক্ত ছিল। তাছাড়া, শাহজাহান এমন কোনো জায়গা খুঁজছিলেন, যা সরাসরি আগ্রার রাজপ্রাসাদ থেকে দেখা যাবে। যমুনা নদীর তীরবর্তী একটি জায়গা বাছাই করা হয় যা শাহজাহানের সকল শর্ত পূরণ করে।
খুঁজে দেখা গেল, সেই স্থানের মালিক হলেন রাজা জয় সিং; যিনি ছিলেন রাজা মান সিংয়ের নাতি। এই রাজপুত পরিবার বহুদিন ধরেই মুঘল রাজপরিবারের সাথে বৈবাহিক সম্পর্কে আবদ্ধ। রাজা মান সিংয়ের আপন ফুফু যোধা বাই ছিলেন সম্রাট আকবরের স্ত্রী এবং পরবর্তী সম্রাট জাহাঙ্গীরের মাতা। রাজা মান সিংয়ের বোন মান বাঈ ছিলেন সম্রাট জাহাঙ্গীরের প্রথম স্ত্রী। তাই, রাজা জয় সিং সানন্দে ঐ জমি সম্রাট শাহজাহানকে বিক্রি করে দিতে রাজি হন। ঐ ক্রয়-বিক্রয়ের সংশ্লিষ্ট লিখিত তথ্যাদি আজও ভারতের জাতীয় মহাফেজখানায় সংরক্ষিত আছে।
প্রধান স্থাপত্যবিদ হিসেবে উস্তাদ আহমেদ লাহৌরির নিয়োগ
এরপরে শুরু হল নকশা সংক্রান্ত কার্যাদি। শাহজাহানের শ্বশুর আসফ খানের পিতা গিয়াস বেগ সুদূর পারস্য থেকে এসেছিলেন। আসফ খান এক পারসিক স্থাপত্যবিদের সাহায্য নিয়ে নিজের জন্য কিছু অনিন্দ্যসুন্দর স্থাপনা নির্মাণ করেছিলেন। শাহজাহান এই ব্যাপারে অবগত ছিলেন। তিনি সেই পারসিক স্থাপত্যবিদক উস্তাদ আহমেদ লাহৌরি বুরহানপুরে থাকা অবস্থায়ই আমন্ত্রণ জানান।৪


উস্তাদ আহমেদ লাহৌরি ছিলেন স্পষ্টভাষী। কোনোরকম চাটুকারিতার আশ্রয় নিতেন না তিনি। তাই, সম্রাটের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে তিনি বদ্ধপরিকর ছিলেন। অন্য স্থাপত্যবিদেরা যেমন সম্রাটের প্রতি কথায় ‘জি হুজুর, জি হুজুর’ করতেন, উস্তাদ আহমেদ লাহৌরি ছিলেন ব্যতিক্রম। সম্রাটের উত্তম পরামর্শের প্রতি যেমন সমর্থন করতেন; তেমনই বাজে সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করতেন। এরূপ ব্যক্তিত্বকে সম্রাট শাহজাহানের অধিকতর পছন্দ হয়েছিল। তাই নিজ স্ত্রী মমতাজ মহলের স্মৃতি রক্ষার্থে তিনি যে বিশালাকৃতি স্থাপনা নির্মাণে তিনি ইচ্ছুক, তার মূল দায়িত্ব তিনি উস্তাদ আহমেদ লাহৌরির হাতেই সমর্পণ করেন।
স্থাপত্যের ধরন
উস্তাদ আহমেদ লাহৌরি একজন পারস্য অধিবাসী বিধায় পূর্বে থেকেই পারসিক স্থাপনা সম্পর্কে অবগত ছিলেন। তিনি চাচ্ছিলেন, পারস্যের অধিবাসীরা যেরূপ পারিদায়েজা (বাংলা অর্থ – স্বর্গের উদ্যান) তৈরি করেন; সেরূপ ভাবেই এই স্থাপনা নির্মাণের।৫
তাছাড়া, মুঘল স্থাপত্যরীতিতে তৈরি সম্রাট হুমায়ুনের সমাধিও তিনি ভ্রমণ করেছিলেন।
সমাধির স্থাপত্যরীতি উস্তাদ আহমেদ লাহৌরিকে আকর্ষণ করেছিল।
এ সমস্ত স্থাপত্যশৈলী এবং নিজের অর্জিত জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে, উস্তাদ আহমেদ লাহৌরি তাঁর নিজের জীবনের সবচেয়ে বড় প্রজেক্টের জন্য নকশা তৈরি করা শুরু করলেন। আর এভাবেই মমতাজ-শাহজাহানের অমর প্রেমকে পৃথিবীর বুকে অক্ষয় করে রাখার প্রক্রিয়া শুরু হলো।
তাজমহলের নির্মাণ এবং নকশা সম্পর্কে জানতে চোখ রাখুন অসামান্যতে মোঃ রেদোয়ান হোসেন এর পরবর্তী লেখায়।
ফিচার চিত্রসূত্র – Unsplash
তথ্যসূত্র:
গ্রন্থসূত্র:
- ১ রাদারফোর্ড, অ্যালেক্স (মে, ২০১৩)। এম্পায়ার অব দ্য মোগল : দ্য সার্পেন্টস টুথ। ISBN -978-0755347636। অনুবাদক : জেসি মেরি কুইয়া। পৃষ্ঠা – ৮৬
- ২ রাদারফোর্ড, অ্যালেক্স (মে, ২০১৩)। এম্পায়ার অব দ্য মোগল : দ্য সার্পেন্টস টুথ। ISBN -978-0755347636। অনুবাদক : জেসি মেরি কুইয়া। পৃষ্ঠা – ৮৭
- ৩ রাদারফোর্ড, অ্যালেক্স (মে, ২০১৩)। এম্পায়ার অব দ্য মোগল : দ্য সার্পেন্টস টুথ। ISBN -978-0755347636। অনুবাদক : জেসি মেরি কুইয়া। পৃষ্ঠা -১০৩
- ৪ রাদারফোর্ড, অ্যালেক্স (মে, ২০১৩)। এম্পায়ার অব দ্য মোগল : দ্য সার্পেন্টস টুথ। ISBN -978-0755347636। অনুবাদক : জেসি মেরি কুইয়া। পৃষ্ঠা – ১০৬
- ৫ রাদারফোর্ড, অ্যালেক্স (মে, ২০১৩)। এম্পায়ার অব দ্য মোগল : দ্য সার্পেন্টস টুথ। ISBN -978-0755347636। অনুবাদক : জেসি মেরি কুইয়া। পৃষ্ঠা – ১০৫
সম্পর্কিত নিবন্ধসমূহ: