- মঙ্গল অভিযাত্রা : মঙ্গলে মানববসতি গড়ার এক অকল্পনীয় মিশন - December 19, 2020
- আলফ্রেড দ্য গ্রেট: ভাইকিং আক্রমণের বিরুদ্ধে একজন সফল রক্ষক (পর্ব ২) - December 15, 2020
- আলফ্রেড দ্য গ্রেট: ভাইকিং আক্রমণের বিরুদ্ধে একজন সফল রক্ষক, পর্ব ১ - December 11, 2020
অসম্ভবকে সম্ভব করার এক অদ্ভুত মনোভাব নিয়েই হয়তো জন্মেছে মানুষ। হয়তো পৃথিবীতে এমন স্থান খুবই কম আছে যেখানে মানুষের পদধূলি পরেনি। এভারেস্ট এর চূড়া থেকে শুরু করে রহস্যে ঘেরা মারিয়ানা ট্রেন্চ (Mariana Trench) পর্যন্ত সকল স্থানে গবেষণা বিরাজমান। (যদিও মারিয়ানা ট্রেন্চ এর একদম গভীর পর্যন্ত যাওয়া এখনও সম্ভব হয় নি।) পৃথিবীর সবচেয়ে কাছের উপগ্রহ চাঁদকে জয় করার পর মানুষের মনের অন্তরালে জন্ম নিয়েছে বিশাল স্বপ্ন। স্বপ্ন হানা দিচ্ছে উপগ্রহ ছাড়িয়ে পৃথিবীর সবচেয়ে কাছের গ্রহ অর্থাৎ মঙ্গলের দিকে। হ্যাঁ, মঙ্গল অভিযাত্রা। এই গ্রহটি নিয়ে প্রতিনিয়ত জন্ম নিচ্ছে নতুন নতুন তথ্যের। জন্ম নিচ্ছে রহস্য ঘেরা নতুন নতুন প্রশ্নের।
মহাকাশ গবেষণার কথা শুনলেই প্রথমেই যে প্রতিষ্ঠানের কথা মাথায় আসে তা হলো ‘NASA’। তবে ধীরে ধীরে আসছে সে ধারণায় পরিবর্তন। নাসা তো রয়েছেই, তবে এখন জন্ম নিচ্ছে আরো কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের। বর্তমানে মঙ্গল অভিযাত্রা কিংবা Road to Mars এর নাম শুনলে যে মানুষটার কথা সবথেকে বেশি আলোড়িত হয় তিনি হলেন ইলন মাস্ক (Elon Musk) এবং তার সনামধন্য প্রতিষ্ঠান ‘স্পেস এক্স’ (SpaceX)। যা ধীরে ধীরে নাসাকে টেক্কা দিতে চাচ্ছে।
হ্যাঁ আজ আমরা কথা বলবো সেই ইলন মাস্কের দুঃসাহসী মঙ্গল জয়ের কিছু পরিকল্পনা নিয়ে। যেই পরিকল্পনায় আছে ২০৫০ সালের মধ্যে পৃথিবী থেকে ১০ লক্ষ মানুষকে মঙ্গলে স্থায়ী বসবাসের জন্য প্রেরণ করার পরিকল্পনা।
তাঁর পরিকল্পনার অংশবিশেষ শুরু করার আগে আসুন তাঁর সফলতার কিছুটা ধারণা দেয়া যাক। ইলন মাস্ক একজন স্বনামধন্য প্রকৌশলী এবং একই সাথে একজন উদ্যোক্তা। নিচের ছক দ্বারাই হয়তো বুঝতে পারবেন কেন তিনি বর্তমানকালের সফলতম উদ্যোক্তাদের একজন।
Organization | Designation |
SpaceX | Founder, CEO, CTO & Chief Designer |
Tesla | Investor, CEO & Product Architect |
Boring Company | Founder |
Neuralink | Co-founder |
OpenAI | Co-founder & Initial Co-chairman |
PayPal | Ex Co-founder |
SpaceX এর ছোট্ট ইতিহাস
২০০২ সালে ইলন মাস্কের হাত ধরে জন্ম নেয় বিশ্বের প্রথম বেসরকারি মহাকাশ প্রস্তুতকারক এবং মহাকাশ পরিবহন পরিসেবা SpaceX বা Space Exploration Technologies Corporation। স্পেস এক্স মূলত মহাকাশ শিল্পের বিপ্লব ঘটাতে এবং সাশ্রয়ী দামে মহাকাশ যাত্রা (Space Flight)-কে বাস্তবে পরিণত করার লক্ষ্যে এগিয়ে চলছে।


ছোট্ট একটি স্যাটেলাইট পাঠানোর জন্য ‘ফ্যালকন ১’ (Falcon 1) রকেট নিয়ে সংস্থাটি এ অঙ্গনে প্রবেশ করছিল।


মঙ্গল অভিযাত্রায় ইলন মাস্কের লক্ষ্য ও পরিকল্পনা
পৃথিবীরর চারিদিকে তো অনেক স্যাটেলাইট প্রেরণ করা হয়েছে। এমনকি চাঁদে যাওয়াটাও এখন বড় কিছু না। তাই সবার থেকে এগিয়ে থাকতে হলে জয় করতে হবে অন্য এক গ্রহ। সেদিক বিবেচনায় মঙ্গলই হলো মহাকাশ দৌড়ের প্রধান গন্তব্য। তিনি শুরু করেছেন মঙ্গল অভিযাত্রার প্রস্তুতি।
ইলন মাস্কের নতুন স্বপ্ন যেন কল্পনাকেও হার মানায়। তিনি মনে করেন ভবিষ্যতে মানবজাতিকে টিকে থাকার সংগ্রাম মোকাবেলা করতে হলে ভিন্ন গ্রহে বসতি স্থাপন করতে হবে। ইলন মাস্কের এমন ভাবনা ‘মেকিং লাইফ মাল্টিপ্ল্যানেটারি‘ (Making Life Multi-Planetary) নামে পরিচিত। তিনি কোন এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন-
নাসার আশায় আমি কখনো বসে থাকবো না। মানবজাতির স্বার্থে আমরা মঙ্গলে বসতি গড়ার সব ধরনের প্রস্তুতি নিচ্ছি।
তাঁর সবথেকে বড় স্বপ্ন হলো মানবজাতিকে মঙ্গলে পাঠানো। তিনি গর্বের সাথে বলেছেন যে তিনি প্রতি সিট ৫০০,০০০ ডলারের কম দামে মানব যাত্রীদের নিয়ে উড়তে সক্ষম হবেন। কিন্তু এক্ষেত্রে তিনি হয়তো অতিরিক্ত প্রতিশ্রুতিশীল। ৫০০,০০ ডলার যা বাংলাদেশি বর্তমান টাকায় ৪ কোটি টাকার কিছুটা বেশি। বাংলাদেশের সাপেক্ষে এটি একটি বিশাল অংক। কিন্তু যদি আমরা পশ্চিমা বিশ্বের কথা চিন্তা করি এবং একটি রকেট যাত্রা ও সেখানে বসবাসের খরচের কথা একটু চিন্তা করলে আহামরি কোনো সংখ্যা মনেই হবে না।
মাস্ক আশাবাদী ১০ বছরের মধ্যে ১০০০টি ‘স্টারশিপ‘ (Star Ship) তৈরীর। তাঁর লক্ষ্য হলো প্রতিদিন গড়ে তিনটি স্টারশিপ চালু করা এবং মঙ্গলের ভ্রমণকে সহজলভ্য করা। এক টুইট বার্তায় তিনি বলেন যাদের পর্যাপ্ত অর্থ নেই তাদের জন্য লোন এর ব্যবস্থা থাকবে।
অনেকে ভাবছেন স্টারশিপ কি? স্টারশিপ যদি পুরোপুরি ভাবে তৈরি করা হয় তবে এটি হবে এখন পর্যন্ত ইতিহাসের সবথেকে শক্তিশালী এবং সর্বাধিক ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন একটি রকেট। রকেটটি কিভাবে যাত্রা করবে সে সম্পর্কে মাস্ক এখনও স্পষ্ট কোনো কিছু বলেননি।
আরও পড়ুন প্যারালাল ইউনিভার্স: বাস্তব নাকি কল্পকাহিনি?


তবে তিনি অনুমান করেছেন যে স্থায়ী বসবাসের বন্দোবস্ত তৈরি করতে স্টারশিপের পুরো বহরের প্রয়োজন হবে।


মোট ১০০০ টি স্টারশিপ আনুমানিক ১০০ মেগাটন (1 Mt = 1000000000 kg) সামগ্রী পরিবহন করতে পারবে এবং প্রতি জাহাজে ১০০ জন করে মোট ১০০০ জন লোকের স্থানান্তর করা সম্ভব হবে। এতো বিশাল একটি জাহাজ পাঠাতে নির্দ্বিধায় একটি বিশাল খরচের খাতা তৈরি হবে। তবে এ খরচ কিছুটা কমানোর জন্য একটি সময় যাত্রার জন্য বেছে নেওয়া হয়েছে। তা হলো প্রতি ২৫ মাস অন্তর পৃথিবী মঙ্গলের সবথেকে কাছে অবস্থানে করে। সেই সময়টি স্বল্প জ্বালানি যাত্রায় সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। যদিও সে স্বল্প মঙ্গল অভিযাত্রা পথের সময় হবে ৭ মাস।
নাসা ২০৩০ সালের মধ্যে মানুষ প্রেরণ করতে চায় মঙ্গল গ্রহে। কিন্তু স্পেস এক্স চায় আরো দ্রুত। ২০২৪ সালের মধ্যে। তবে বসতি স্থাপনের সবথেকে বড় প্রশ্ন হলো একবার সেখানে গেলে কিভাবে বেঁচে থাকবো?
মঙ্গলের বায়ুমন্ডলের বেশিরভাগই কার্বন ডাই অক্সাইড (CO2)। গ্রহের পৃষ্ঠতল খুবই শীতল এবং গ্রহের মধ্যাকর্ষণ পৃথিবীর ৩৮ শতাংশ। কিন্তু পৃথিবীর দক্ষিণ গোলার্ধে বিদ্যমান কিছু বিন্দুতে এর শক্তি বেশি। তাই এ অংশগুলো আবেশ বাড়ানো গেলে ধীরে ধীরে তা শক্তির বিচারে পৃথিবীর কাছাকাছি আসবে। এছাড়াও বায়ুমন্ডল সমুদ্র পৃষ্ঠের বায়ুমন্ডলের ১ শতাংশের সমান। এটি পৃষ্ঠতলে পৌঁছানো কঠিন করে তোলে। মঙ্গলে মূলত পানি নেই। কিন্তু উত্তর মেরুতে জমা বরফের অস্তিত্ব আছে বলে জানা যায়। সে বরফ গলানো গেলে হয়তো বসবাসের যোগ্য হয়ে উঠবে। মঙ্গলের তাপমাত্রা বসবাসের অযোগ্য। তবে সেখানে বিভিন্ন কারখানা স্থাপন করা যেতে পারে। যা গ্রিন হাউস গ্যাস (Green House Gas) নিঃসরণ করে ধীরে ধীরে গ্রহের তাপমাত্রা প্রয়োজনীয় মাত্রায় বৃদ্ধি করতে পারে। এছাড়া এক টুইট বার্তায় মাস্ক বলেন সেখানে প্রথমবারের মতো কাচের তৈরি বাসস্থান তৈরি হবে। বার্তাটি ছিলো এরকম –
“Life in glass domes at first. Eventually, terraformed to support life, like Earth.”




এতসব হাজারো প্রতিকূলতার মাঝেও মঙ্গল জয়ের স্বপ্নের বীজ তৈরি এবং সেখান বসতি স্থাপনের চেষ্টাই হলো মাস্কের একটি স্বপ্ন। যিনি শুধু স্বপ্নই দেখেনি তা বাস্তবায়নের জন্য উঠে পরে লেগেছেন। তবে বিশ্ব যে ভাবে অগ্রসর হচ্ছে এবং শক্তিশালী নতুন প্রযুক্তির যে হারে উদ্ভাবন হচ্ছে, এতে ধরে নেয়াই যায় মঙ্গলে বাসিন্দা হওয়া হয়তো এখন শুধুমাত্র সময়ের অপেক্ষা মাত্র। সফল হোক মঙ্গল অভিযাত্রা।
নতুন কিছু জানলাম। লেখক মহোদয়কে ধন্যবাদ।