- ব্রেইন কম্পিউটার ইন্টারফেস: মস্তিষ্ক দিয়ে যন্ত্র নিয়ন্ত্রণ এবার হাতের মুঠোয় - November 22, 2020
- শিক্ষায় ফ্রি ও ওপেনসোর্স সফটওয়্যার: হরিণ, বাঘ, রসমালাই - November 3, 2020
- হুয়াওয়ে মোবাইল: শুরুর শেষ নাকি শেষের শুরু? - September 26, 2020
ব্রেইন কম্পিউটার ইন্টারফেস নিয়ে আলোচনার পূর্বে আলেয়া কুদ্দুসের কাছে থেকে ঘুরে আসা যাক। আপনাদের কি আলেয়া আর কুদ্দুসের কথা মনে আছে? ঐ যে ব্লকচেইন নিবন্ধে যারা পালিয়ে বিয়ে করেছিল। এখন কেমন আছে তারা? তারা সুখে সংসার করছিল। কিন্তু হঠাৎ করে তাদের জীবনে নেমে আসে ঘোর অন্ধকার। সেদিন ছিল আলেয়া কুদ্দুসের প্রথম বিবাহবার্ষিকী। কুদ্দুস আলেয়ার জন্য গোলাপ ফুল কিনতে নিউমার্কেট যায়। এদিকে আলেয়া সেজেগুজে কুদ্দুসের পছন্দের পায়েস রান্না করে বসে আছে। আলেয়া বসে আছে তো আছেই, কুদ্দুস আর বাড়ি আসে না। ক্রিং ক্রিং! হঠাৎ করেই আলেয়ার ফোন বেজে উঠল। দুরু দুরু বুকে আলেয়া ফোন ধরল। তারপর যা শুনল তা শোনার জন্য আলেয়ার কান একদম প্রস্তুত ছিল না।
ফোনের মাধ্যমে যে একটা দুঃসংবাদ দেওয়া হয়েছে সেটা তো আপনি বুঝতেই পারছেন। কিন্তু কী সেই দুঃসংবাদ। কুদ্দুস কি অন্য মেয়ের সঙ্গে পালিয়ে গেছে? তা নয়। কুদ্দুস ফুল কিনে বাড়ি ফেরার পথে একটি দ্রুতগামী ট্রাকের সঙ্গে দুর্ঘটনার শিকার হয়। ট্রাকের ড্রাইভার পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। স্থানীয় লোকজন রক্তাক্ত অবস্থায় একজনকে পড়ে থাকতে দেখে অ্যাম্বুলেন্সে কল দেয়। অ্যাম্বুলেন্সে করে কুদ্দুসকে নিয়ে যাওয়া হয় শহরের একটি নামজাদা হাসপাতালে।


হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কুদ্দুসের ফোন থেকে ডায়াল লিস্টে প্রথমে থাকা আলেয়াকে ফোন করে। খবর পাওয়ার সাথে সাথেই আলেয়া হাসপাতালে ছুটে আসে। পাঠক, কী মনে হচ্ছে? কুদ্দুস কি মরে যাবে? তৈরি হবে অমর এক প্রেমকাহিনী। নাকি আলেয়ার টুরু লাভের কারণে বেঁচে যাবে কুদ্দুস?
আপনাদের দোয়ায় এ যাত্রায় কুদ্দুস বেঁচে যায়। কিন্তু মাথায় আঘাত পাওয়ায় তার হাত-পা প্যারালাইজড হয়ে যায়। এমনকি কুদ্দুস কথা বলতেও পারে না। এখন কুদ্দুসকে হুইল চেয়ারে চলাফেরা করতে হয়। তার জীবন অনেকটা বিশ্ববিখ্যাত পদার্থবিদ স্টিফেন হকিং এর মত হয়ে গেছে। কুদ্দুসের জীবনকে একটু সহজ করে দেওয়ার জন্য অসামান্য ব্লগ নিয়ে আসছে ব্রেইন কম্পিউটার ইন্টারফেস।
ব্রেইন কম্পিউটার ইন্টারফেস কী?
এখন কথা হচ্ছে ব্রেইন কম্পিউটার ইন্টারফেস জিনিসটা আসলে কী তা তো আমাদের জানতে হবে। সহজ ভাষায় বললে ব্রেইন কম্পিউটার ইন্টারফেস হচ্ছে এমন একটি যন্ত্র যা ব্রেইন তথা মস্তিষ্কের সিগন্যাল বুঝতে পারে। শুধু সিগন্যাল বুঝতে পারে না, সেই সাথে বিশ্লেষণও করতে পারে। আরেকটু গুছিয়ে বললে ব্রেইন কম্পিউটার ইন্টারফেস হচ্ছে এমন একটা মেশিন যা ব্রেইন এবং একটি বাহ্যিক যন্ত্রের (যেমন: কম্পিউটার) সাথে যোগাযোগ স্থাপন করে।


ব্রেইন কম্পিউটার ইন্টারফেসের কার্যপদ্ধতি


আমরা জানি যে, একটি নিউরন অপর নিউরনকে ইলেক্ট্রোকেমিক্যাল সিগন্যাল পাঠায়। এই সিগন্যালগুলো রিড করার জন্য মাথার করোটিতে (স্কাল) সেন্সর বসানো হয়। সেন্সর দুইভাবে বসানো যেতে পারে। এক. সার্জারি করে মস্তিষ্কের সঙ্গে সরাসরি কানেক্ট করার মাধ্যমে। দুই. করোটির উপরেই সেন্সরগুলো বসানো। সার্জারি করা সময়সাপেক্ষ। তাছাড়া বিভিন্ন রকম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা যেতে পারে। তাই, করোটির উপরেই সেন্সর বসানোই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। তবে মস্তিষ্কের সঙ্গে সরাসরি কানেক্ট করলে যতটা ভাল সিগন্যাল পাওয়া যেত, করোটির উপর সেন্সরগুলো বসানোর ফলে তার থেকে দুর্বল সিগন্যাল পাওয়া যাবে। তবে এই দুর্বল সিগন্যাল দিয়েই আমাদের কাজ হয়ে যাবে।
কুদ্দুসের করোটিতে আমরা সেন্সর তো বসিয়ে দিলাম। এবার কী? এবার সেই সেন্সরগুলোকে একটি কম্পিউটারের সাথে যুক্ত করতে হবে। কিন্তু কীভাবে যুক্ত করা যায়? তারের মাধ্যমে যুক্ত করা সবচেয়ে সহজ অপশন। তার দিয়ে যুক্ত করার পর কী হবে? এরপর কম্পিউটারের বিশেষ অ্যালগরিদম সেই সিগন্যালগুলো বিশ্লেষণ করবে। এজন্য কম্পিউটারকে আগে থেকেই কোন সিগন্যাল দ্বারা কী বোঝায় তা জানতে হবে। ধরা যাক নিচের সিগন্যাল দ্বারা বোঝায় আমি সামনে যেতে চাই।


আবারও কুদ্দুসের কাছে ফিরে যাই। মনে আছে নিশ্চয় কুদ্দুসের জীবন হুইলচেয়ারে সীমাবদ্ধ। সে কথা বলতে পারে না, হাত-পা নড়াতেও পারে না। এখন যদি সে মনে মনে চিন্তা করে আমি সামনে যেতে চাই তাহলে তার ব্রেইনে সিগন্যাল উৎপন্ন হবে। সেই সিগন্যাল সেন্সরের মাধ্যমে কম্পিউটারের কাছে যাবে। কম্পিউটার সেই সিগন্যাল বিশ্লেষণ করে বুঝতে পারবে যে কুদ্দুস সামনে যেতে চায়। হুইলচেয়ার যদি ইলেক্ট্রিক হয় তাহলে কম্পিউটার হুইলচেয়ারকে সামনে এগোনোর নির্দেশ দিতে পারবে। তখন হুইলচেয়ার সামনে এগিয়ে যাবে। এভাবে মস্তিষ্কের চিন্তাভাবনা দ্বারা যেকোনো ইলেকট্রিক ডিভাইস নিয়ন্ত্রণ করা যাবে।
স্টিফেন হকিং
কুদ্দুসকে আমরা তার আগের জীবন ফিরিয়ে দিতে না পারলেও তার জীবনযাপন কিছুটা সহজ করে দিতে পেরেছি এটাই মনের শান্তি। এবার কুদ্দুস-আলেয়ার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে স্টিফেন হকিং এর কাছে আসা যাক।


স্টিফেন হকিংকে কে না চেনে! শত শারীরিক অক্ষমতাকে তিনি বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে একের পর এক বই লেখেছেন, নতুন তত্ত্ব দিয়েছেন। তিনি তার বই লেখা, ভাষণ দেওয়া কিংবা অন্যান্য কাজ করতেন হুইলচেয়ারে যুক্ত কম্পিউটারের মাধ্যমে। গালের মাংশপেশির নাড়ানোর মাধ্যমে তিনি কম্পিউটারে টাইপ করতেন। এভাবে টাইপ করেই তিনি একের পর এক কালজয়ী বই লিখে গেছেন।
কমার্শিয়াল ব্রেইন কম্পিউটার ইন্টারফেস
খুবই বেসিক ধরণের ব্রেইন কম্পিউটার ইন্টারফেস বাজারে কিনতে পাওয়া যায়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে Emotiv EPOC, InteraXon Muse, NeuroSky Mindwave।


টেড টকে অভিজিত সাতানী (Abhijeet Satani) ব্রেইন কম্পিউটার ইন্টারফেসের কিছু প্রোটোটাইপ দেখিয়েছিলেন। আপনি চাইলে ভিডিওটি দেখতে পারেন।
ভবিষ্যতে কী চমক অপেক্ষা করছে?
আবারও আমরা আলেয়া কুদ্দুসের কাছে ফিরে গেলাম। হঠাৎ করে কুদ্দুসের পাবজি গেম খেলার ইচ্ছে হল। কিন্ত হায়! কুদ্দুস তো তার হাত নড়াতে পারে না। সে গেম খেলবে কি করে?


প্রযুক্তির কাজই হচ্ছে মানবজীবনকে আরও সহজ করে তোলা। আলেয়া কি পারবে প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে কুদ্দুসের গেম খেলার ইচ্ছে পূরণ করতে? উত্তর হচ্ছে, হ্যাঁ, পারবে। ব্রেইন কম্পিউটার ইন্টারফেসের সাহায্যেই এটা সম্ভব।
ব্রেইন কম্পিউটার ইন্টারফেসের কার্যপদ্ধতি নিয়ে যখন আলোচনা করেছিলাম তখন বলেছিলাম যে তারের মাধ্যমে সেন্সরগুলোকে কম্পিউটারের সাথে যুক্ত করা হয়। কিন্তু চাইলেই তারবিহীন মাধ্যম যেমন: ইন্টারনেটের মাধ্যমেও যুক্ত করা যায়। তবে আসল আকর্ষণ হচ্ছে আপনি একজনের ব্রেইনের সাথে আরেকজনের ব্রেইন ইন্টারনেটের মাধ্যমে যুক্ত করতে পারবেন। সেজন্য গ্রাহকের করোটিতেও আরেক ধরণের সেন্সর বসাতে হবে। যাতে করে প্রেরকের করোটিতে বসানো সেন্সর থেকে পাঠানো সিগন্যাল গ্রহণ করতে পারে।
ধরা যাক, আলেয়া আর কুদ্দুস দুজনের মাথার করোটিতে উপযুক্ত সেন্সর বসানো আছে। সেন্সর দুইটি একে অপরের সাথে ইন্টারনেটের মাধ্যমে যুক্ত। সুতরাং বলা যায়, আলেয়া এবং কুদ্দুসের ব্রেইন একে অপরের সাথে যুক্ত।
কুদ্দুসকে মোবাইলের সামনে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং পাবজি ম্যাচ শুরু হয়ে গেছে। কুদ্দুসের সামনে প্রতিপক্ষ দলের একজন কুদ্দুসকে মারতে আসছে। এখন কুদ্দুসকে রাইফেল দিয়ে গুলি ছুঁড়তে হবে। সে মনে মনে গুলি ছোঁড়ার চিন্তা করল। এর ফলে তার মস্তিষ্কে সিগন্যাল তৈরি হল। সেই সিগন্যাল কুদ্দুসের করোটিতে লাগানো সেন্সর রিড করল। তারপর ইন্টারনেটের মাধ্যমে সেই সিগন্যাল চলে গেল আলেয়ার করোটিতে লাগানো সেন্সরের কাছে। সেই সেন্সর আলেয়ার মস্তিষ্কে সিগন্যাল প্রেরণ করল। আলেয়ার মস্তিষ্ক বুঝতে পারল যে এখন গুলি ছুঁড়তে হবে। সেই অনুসারে আলেয়া হাত দিয়ে গুলি ছোঁড়ার আইকনে টাচ করল। এভাবে কুদ্দুসের গেম খেলা চলতে লাগল।


আপনি বলতে পারেন এত ভেজাল করার কি আছে! কুদ্দুসের হাতে এমন কোন যন্ত্র লাগিয়ে দিলেই হয় যেটা হাত নাড়াচাড়া করাতে পারে। তাহলে কুদ্দুসের মস্তিষ্কে উৎপন্ন হওয়া সিগন্যাল সেন্সরের মাধ্যমে হুইলচেয়ারে যুক্ত কম্পিউটারে যাবে। কম্পিউটার তখন হাতে লাগানো যন্ত্রকে হাত নাড়ানোর নির্দেশ দিবে।
আপনি একদম ঠিক কথা বলেছেন। আসলে এই গল্প অবতারণা করার উদ্দেশ্য হল – আপনাকে বোঝানো যে একজনের ব্রেইন দিয়ে উৎপন্ন সিগন্যাল দিয়ে আরেকজনের ব্রেইনের সাথে যোগাযোগ করা যায়। বিশ্বাস করুন বা নাই করুন। এরকম একটা এক্সপেরিমেন্ট ২০১৪ সালেই করা সম্ভব হয়েছে। তাহলে এবার চিন্তা করে দেখুন ভবিষ্যতে আরও কী কী চমক আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে?


এই ধারণা কাজে লাগানো যায় শিক্ষাক্ষেত্রে। তাহলে শিক্ষকের মস্তিষ্ক দিয়ে সরাসরি শিক্ষার্থীদের শেখানো যায়। তখন শিখন-প্রক্রিয়া হবে অনেক দ্রুত। আরও কত কী যে সম্ভব তা শুধু আপনার কল্পনাশক্তির উপর নির্ভর করছে। সায়েন্স ফিকশন মুভির গল্পগুলো সত্য হওয়ার সময় বুঝি চলেই এল!
প্রচ্ছদ চিত্রসূত্র: Pixabay
তথ্যসূত্র:
- University of Washington
- Explaining Computers
- TEDx Talks
🤯 Marshal let’s work on something like this in the future.
অবশ্যই তোর সাথে কাজ করে বেশ আনন্দ পাব
I really find this topic interesting and want to work on it in future ☺️
And you described the procedure very nicely!
ব্রেইন কম্পিউটার ইন্টারফেস নিয়ে আগ্রহ আছে শুনে খুশি হলাম। আশা করি ভবিষ্যতে তোর কাছে থেকে দারুণ কিছু উপহার পাব।
ekjoner brain theke signal jacche onno ekjoner brain e..but jar brain e jacche tar brain je signal generate kore tar shathe interaction I think ekta challange chilo ei research e….tor lekhata pore beparta onek interesting mone hoilo..!!!
বিষয়টা আসলেই অনেক আকর্ষণীয়। তাই তো পাবজির রেফারেন্স টেনে এত নাটকীয়ভাবে বিষয়টা আলোচনা করেছি।
Almost sounds like something out of a science fiction movie . A very interesting read indeed!
Good work Marshal, hope to work on something similar to this in future
ভাই সায়েন্স রিলেটেড টপিক নিয়ে অনেকেই লিখতে পারে, কিন্তু তোর মতো করে গুছিয়ে আকর্ষণীয় করে উপস্থাপন করার ক্ষমতা খুব কম লোকজনেরই আছে। আশা করি ভবিষ্যতে এমন আরো অনেক সুন্দর সুন্দর ব্যাপার সম্পর্কে জানতে পারবো