- ভালোবাসার এই নদী কিন্তু নিঃশব্দে বয়ে চলছে: প্রাঞ্জল - November 24, 2020
- বাংলাদেশের প্রকাশনালয় - August 12, 2020
হওয়া উচিত ছিল ‘প্রকাশনালয়’। বাংলা একাডেমি ব্যবহারিক বাংলা অভিধানে সেরকমই অন্তর্ভুক্ত। অথচ বইমেলা এলেই নানান রঙের ‘প্রকাশনী’ শুনে যেতে হয়। এটা কেমনতরো ব্যাপার! যারা বইয়ের কারবার করে, তারাই এমন প্রমাদ ফেঁদে বসবে!
যাই হোক, আমি প্রকাশক নই, দৈনিক খবরের কাগজের অনুসন্ধানী সাংবাদিক নই, কবি-সাহিত্যিক-বিজ্ঞানী-গবেষক কিছুই নই। আমার এই প্রশস্ত বাকওয়াস হবে নিতান্ত একজন সাধারণ অনুসন্ধিৎসু পাঠক হিসেবে–যে পাঠক মেলার স্টল থেকে স্টলে ঘোরে, বই কেনে, আর নিশ্চয় করে বইপঞ্জিটা (বা ক্যাটালগ) সংগ্রহ করে আনে। সেই যে কবে ফেব্রুয়ারির মেলায় এনেছিলাম বইপঞ্জিগুলো, এই কয়েক দিন আগে পাঁচ মাস পর সেসবের একটা কিনারা করলাম। ফেব্রুয়ারি তো চলে যায় বইয়ের প্রতি বিহ্বল দৃষ্টি নিক্ষেপ করে করেই–তখন কী আর বইপঞ্জি ঘাঁটানোর সময় থাকে!
রকমারিতে অর্ডার করলে বা হুট করে বাতিঘরে বা পাঠক সমাবেশে গিয়ে খোঁজাখুঁজি করলেই তো চলে, বা ওদেরকে বললেই তো হয় কোন বই চাচ্ছেন–আবার প্রকাশনীর বইপঞ্জি নিয়ে কণ্ডূয়ন কেন! আছে, দরকার আছে বলেই বলছি। আমাদের গ্রন্থবিতানগুলো এখনো ততটা পরিণত নয় যে আপনাকে সবসময় ভালো পরামর্শ দিতে পারবে (হ্যাঁ, এখন বলবেন, তা ভাই, বাতিঘর বা পাঠক সমাবেশ বা ঐ দূরের মিরপুরের চর্চার কথা যদি ভালো দিই, আজিজ সুপার মার্কেটে বা কাঁটাবনের কনকর্ড এম্পোরিয়ামের ভূগর্ভ-তলায় বেশ কিছু দোকান তো আছেই। ওখানে গিয়ে চাহিদাটা ছেড়ে দিলেই তো হয়! জবাবে বলব, তা সেরকম কয়টা দোকানই অতটা পরিণত? সন্ধিপাঠ বা বিদিতের মতো কয়টা দোকান প্রকাশনী অনুসারে বই গুছিয়ে রাখে?)
পরিণত গ্রন্থবিপণিতেও আপনি সবসময় স্বত্বাধিকারীর সহায়তা পাবেন না। কারণ আপনার চাহিদা আর রুচির সীমা আপনারই জানা। অনেক চটকদার বইয়ের অন্তরালে পড়ে থাকে চিত্তহারী সব বই। সেসব বই না কিনলে, না পড়লে প্রকাশক আগ্রহ হারায়, লেখক তো বটেই! ঢুঁড়ে বের করতে হয় বইপঞ্জি তন্নতন্ন করে।
কোন প্রকাশনালয় কেমন, তারা কী ধরনের বই বের করে, সেটা জানা থাকলে অপসারণ পদ্ধতিতে (প্রসেস অফ এলিমিনেশন) দিয়ে চট করে বুঝে যেতে পারেন কোনটা রুচিদীন বই প্রকাশ করে বেশিরভাগ সময়, কে মৌসুমী ব্যবসায়ী আর কে আহেল কিতাবের পসার বসায়। দীর্ঘ অনুক্রমণিকা শেষ। আমি এবার একে একে প্রকাশনালয়ের নাম করব, তা নিতান্তই বিক্ষিপ্তভাবে, মস্তিষ্কে ‘আগে এলে আগে লিখব’ এই মন্ত্রে।
বিকেন্দ্রীকৃত প্রকাশনালয়ের আখ্যান
সিলেট-ভিত্তিক নাগরীর নয়নসুখাবহ হরফ শৈলী দেখে এর অনুরক্ত হয়ে পড়েছি। স্রেফ সিলেটে বসে এমন অলোকসামান্য প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা আদতেই প্রশংসার দাবি রাখে। ২০২০ এর মেলা থেকে কিনেছি এদের প্রকাশিত ইমতিয়ার শামীমের ‘গ্রামায়নের ইতিকথা‘। নির্জনবাসী সাহিত্যিক ইমতিয়ার শামীমকে এই মেলাতেই চিনলাম।


নাগরী নোম চমস্কির একটা অনুবাদ বের করেছে। নাম সাম্রাজ্যবাদীদের উচ্চাভিলাষ। কাজ তো ভালো। কিন্তু আমি দেখি তারা মূল লেখক বা প্রকাশকের কাছ থেকে অনুমতি নিল কী না। নেয় নি। কারো মানসজগতে তাকে তার মগজবাত্যার (ঐ ব্রেইনস্টর্মিং আর কী!) যথাযথ পাওনা পরিশোধ না করাটা আমার কাছে নীতিহীন লাগে।
আরে! আমার মাথা এতটা নিচু হয়ে যাওয়ার তো কোনো কারণই নেই। সিলেটেরই আরেক প্রকাশনাঘর চৈতন্য। তরুণ প্রকাশক রাজীব চৌধুরী একের পর এক অনুবাদ বের করে যাচ্ছেন। নোম চমস্কি, আন্দ্রেই ভিচেক, লেসলি হেইজ়েলটন–চিন্তাবিশ্বের একেকজন হেভিওয়েট। ফলস্বরূপ নোম চমস্কি আর আন্দ্রেই ভিচেকের দুটো বই-ই কিনেছি। দাম একটু বেশি। নৈতিকতা অনুসরণের জন্য দাম দেব না তো কীসের জন্য দেব? আর যত দামই হোক, তা মূল ইংরেজির তুলনায় যথেষ্ট কম।


‘নাইন ইলেভেন: কোনো বিকল্প ছিল কি?’ বইটার মুদ্রিত মূল্য ৪৫০ টাকা। অন্তত বিশ শতাংশ ছাড় সব বইয়ের দোকানেই দেয়। আর প্রি-অর্ডার করলে ত্রিশ শতাংশ পর্যন্ত ছাড় দেওয়া হয় প্রকাশনালয়ের পক্ষ থেকে। অর্থাৎ অন্তত ৩৬০ টাকায় পেয়ে যাচ্ছি হালাল একখান বহি। যেখানে মূল (ভারতীয়) সংস্করণটার দাম ৭০০ রুপি।
ভারতে অনলাইন বিপণি ব্যতিরেকে কোনো অভিজাত দোকানেই মুদ্রিত মূল্যের ওপর ছাড় দেয় না। অর্থাৎ বাতিঘর বা পাঠক সমাবেশ থেকে কিনলে ৭০০×১.৭=১১৯০ টাকা লাগত। এখন আপনার (১১৯০-৩৬০) টাকা=৮৩০ টাকা বেঁচে গেল। আমি তাই প্রকাশিতব্য বিলেতি লেখক-মনস্তত্ত্ববিদ ও সাবেক মধ্যপ্রাচ্য-সংবাদদাতা হেইজ়েলটনের নবী মুহাম্মদের পর কিনবই বলে স্থির করেছি।
এই আঁক কষেই মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানদের সাধ পূরণ করতে হয়। এই প্রয়াসটা অবশ্য অভিজ্ঞতা সিঞ্চনে সহায়ক– বসুধার অলিগলি ঘোরা হয়ে যায়!
অবশ্য তুর্কি প্রতিবাদী লেখিকা এলিফ শাফাকের বই অনূদিত হয়েছে অনুমতি ছাড়াই। তাই কোনো প্রকাশনালয় নিয়েই একদেশদর্শিতা দেখাতে আমি রাজি নই। কথা হবে প্রকাশকের সঙ্গে ফেসবুকের মন্তব্য বাক্সে, মেসেঞ্জারে, জিমেইলে। গঠনমূলক সমালোচনা আর পরামর্শে গ্রহণক্ষম প্রকাশককে ঋদ্ধ করাটা পাঠকের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।
সিলেট-ভিত্তিক আরেকটা বেশ পরিচিত প্রকাশনালয় উৎস প্রকাশন। হ্যাঁ, তারা তাদের প্রকাশিত সিলেটের লোকগীতি সাধকদের যে সিরিজ়টা আছে, সেই সেটটা যেকোনো পাঠাগারকেই সমৃদ্ধ করবে। শিতলং শাহের বইটা তো আমি নেবই।
প্রকাশক মোস্তফা সেলিমের সঙ্গে বাতচিত করে যা বুঝলাম, সিলেটের ইতিহাস-ঐতিহ্য তুলে ধরা, সিলেটি সারস্বতসমাজের হারিয়ে যাওয়া মূল্যবান সব বই জোগাড় করে পুনঃপ্রকাশ করছেন বা করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তার মধ্যে একটা বই হজরত শাহ জালাল (র.) ও সিলেটের ইতিহাস (সৈয়দ মুর্তাজা আলী) এই মুহূর্তে পড়ছি। দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফের ‘আত্মজীবনী’ও প্রকাশ করেছে। মোস্তফা সেলিম নিজেই সংকলিত করেছেন নাগরী বর্ণপরিচয়। তবে অনুমোদিত বিদেশি বইয়ের অনুবাদ নিন্দার্হ বটে।
চাটগাঁয়ের এক ছোট্ট প্রকাশনালয় খুঁজে পেয়েছি। নাম তার ‘খড়িমাটি’। নয়নরঞ্জন সব প্রচ্ছদের বই! হাফিজ রশিদ খান–অ্যাডর্ন প্রকাশিত তাঁর আদিবাসী-সংক্রান্ত বই পড়েছি। এবার দেখি খড়িমাটির স্টলেও তাঁর বই! অবশ্য থাকারই কথা। উনি থাকেনও চাটগাঁয়ে। জনপ্রিয় তেমন লেখকের বই নেই–এটাই আকর্ষণীয় ব্যাপার। তার মানে তারা আদতেই লেখাকেই অগ্রগণ্যতা দিচ্ছে বেশি। আর স্টল বা কুটির যা-ই বলি, কী তকল্লবি! গ্রন্থপঞ্জির শ্রী আর কুটিরের নকশা দেখেই বলা চলে প্রকাশনালয়ের মানসপট কেমন।


যাই হোক, কিনেছিলাম জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক জহির আহমেদের জনপরিসরে একজন নৃবিজ্ঞানীর ভাবনা। জনপ্রিয় বিজ্ঞানের বই। ইয়ুভাল নোয়াহ হারারি পাঠে যদি শরাফত প্রকাশ পায়, জহির আহমেদের বই পাঠও শরাফতময় হওয়া উচিত। প্রকাশনালয়ের তত্ত্বতাবাসে এই এক সুবিধা। বইমেলার ফটক পেরিয়েই ‘তাম্রলিপি কই? তাম্রলিপি কই?’ না করে ব্রাত্য এই প্রকাশনা কুটির তাবাস করে বের করলে বৈচিত্র্য ছাড়া একঘেয়েমি নেই।


খড়িমাটিরই এক কর্মী বলছিলেন, তাঁদের এক বই এক প্রভাবশালী নেত্রী বেশ অর্থযোগে বের করেছে। অবশ্যম্ভাবীভাবে তেলের গন্ধ পাচ্ছিলাম। স্ব-প্রকাশনার বিতর্কে যাচ্ছি না, তবে বিশেষ করে এইরূপ বই আজকাল তৈলচক্র ছাড়া তেমন সমাদৃত হয় না–আর তাতে প্রকাশনালয়ের রুচি সম্পর্কে প্রশ্ন ওঠে।
ওখান থেকেই কিনলাম জ্যোতির্ময় নন্দী অনূদিত হ্যাকুনিন ইসশু (শত কবির শত কবিতা)। জাপানি কবিদের কবিতাশতক। নির্বাসিত প্রকাশনালয় শুদ্ধস্বর প্রকাশিত শোয়াইব জিবরানের কমলকুমার চরিতম্ এর মতন গুরুত্ববহ কাজ করেছে তারা।
এবার কি বাতিঘরের কথা বলা চলে? না না, ঐ বাতিঘর না–যারা সম্মতি বিনা অনুবাদ বই প্রকাশ করে, নিক পিরোগ নিজের বই যাদের বঙ্গানুবাদে দেখতে পেয়ে শরম দিয়েছিলেন ফেসবুকে–তাদের কথা বলছি না। আমি বলছি চট্টগ্রাম-ভিত্তিক বাতিঘরের কথা। তাদের কেন্দ্রের আকর্ষণ পেরিয়ে এসে পরিধিতে চলবার কথা বলছি। হ্যাঁ, আক্ষরিক অর্থেও স্বত্বাধিকারী দীপঙ্কর দাশ বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের অভিজ্ঞতা পুঁজি করেই জামাল খান রোডে গড়ে তুলেছিলেন বাতিঘর। যদিও তারা আজ ঢাকায় কিংবা সিলেটে বাতি পৌঁছে দিচ্ছে, তাদের অঞ্চলভিত্তিক প্রকাশনা এখনো দেখা যায়।
সুনীতিভূষণ কানুনগোর চট্টগ্রামের প্রাচীন ইতিহাস অথবা চাটগাঁয়েরই আলোকবর্তিকা আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ বিরচিত ইসলামাবাদ, শাহেদ আলীর বাংলা সাহিত্যে চট্টগ্রামের অবদান –এইসব পুনঃপ্রকাশ নিজের জন্মভূমির প্রতি টান ব্যতিরেকে করা যায় কি? এটা হয়তো একটা নিয়ামক, তবে একমাত্র নয়। নইলে যখন তারা সিলেটে পদার্পণ করল, রবীন্দ্রনাথের সিলেটে আগমনের শতবর্ষে রীতিমতো বিদ্বান ব্যক্তি উষারঞ্জন ভট্টাচার্যকে দিয়ে সিলেটে রবীন্দ্রনাথ ১৯১৯ বের করার ভাবনা কী করে এলো তাদের মাথায়!
এত ভালো কাজ সত্ত্বেও অননুমোদিত অনুবাদ বই প্রকাশের কলঙ্কটাও আছে। বাতিঘরের মতন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তা বেখাপ্পা।
সম্পর্কিত নিবন্ধসমূহ: