- বরফ গলা নদী: জহির রায়হানের লেখনীতে নিম্ন মধ্যবিত্তের দুঃখগাথা - October 11, 2020
- জাগরী – রাজনৈতিক উপন্যাসে স্নেহ ও আদর্শের মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব - August 13, 2020
চিরায়ত উপন্যাস: বরফ গলা নদী
লেখক: জহির রায়হান
প্রকাশ সাল: ১৯৬৯
অতীত। বর্তমান। ভবিষ্যৎ। ছুরি দিয়ে কেটে-কেটে জীবনটাকে বিশ্লেষণ করার মতো প্রবৃত্তি না হলেও, জীবনের ক্ষণস্থায়ী মুহূর্তগুলো, টুকরো টুকরো ঘটনাগুলো স্মৃতি হয়ে দেখা দেয় মনে। সেখানে আনন্দ আছে, বিষাদ আছে। ব্যর্থতা আছে, সফলতা আছে। হাসি আছে, অশ্রু আছে। এসব কিছু নিয়েই বরফ গলা নদী লিখেছেন বাংলা সাহিত্যের কালজয়ী লেখক জহির রায়হান।
অতীতের মতো বর্তমানও যেন ঘড়ির পেন্ডুলামের মতো ওঠা আর পড়ার মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলেছে। ভবিষ্যৎ কেমন হবে তা কেউ বলতে পারে না। …


বরফ গলা নদী উপন্যাসটি একটি বাস্তবধর্মী নিম্ন মধ্যবিত্তের স্বপ্নের গল্প। যেখানে বেঁচে থাকাটা শুধু সুন্দর ভবিষ্যৎ হবে এই স্বপ্ন নিয়ে। দরিদ্র কেরানি হাসমত আলী ও সালেহা বিবির বড় ছেলে পরিবারের জন্য কিছু করতে না পারলেও তার আর্দশ থেকে বিচ্যুত হয় না। মরিয়মের টিউশনি করে সংসার চালানোর সংগ্রাম লেখকের বর্ণনায় জীবন পায়। দরিদ্র কেরানি হাসমত আলী ও সালেহা বিবির পাঁচ সন্তান, মাহমুদ, মরিয়ম, হাসিনা, খোকন ও দুলু আর মরিয়মের স্বামী মনসুর বা লিলি এই চরিত্রগুলো নিয়ে ঔপনাসিক কলমের ছোঁয়ায়, বরফ গলা নদী উপন্যাসটিকে প্রাণ দিয়েছেন।
মাহমুদ ও লিলি
মাহমুদ পরিবারের বড় ছেলে। গ্রাজুয়েশন সম্পন্নের পর চাকরি খুঁজছে। বাউন্ডুলে ছেলে, পত্রিকা অফিসের চাকরিতে নিজ স্বাধীনতা না থাকায় ছেড়েও দিয়েছে। এ নিয়ে বাঙালি পরিবারের চিত্রটাও কি হয় সেটাও আছে। জীবনের ভালো খারাপ সময়টার কিছু অংশ কাটিয়েছে নঈম, রফিকের সাথে খোদাবক্সের দোকানে বাকির খাতা দিন দিন ভারী করে ।
আমদের জীবনে অনেক সময় কোনো একটা বস্তু কিংবা কোনো একটা মুহূর্ত আমাদের অতীতের স্মৃতিতে নিয়ে যায়। তেমনি একটা ফটো তাকে অতীতের সকল স্মৃতি স্মরণ করিয়ে দেয়।
হঠাৎ করেই মাহমুদ চিরদিনের মতো হারিয়ে ফেলে পরিবারের সবাইকে। সবাইকে হারিয়ে মাহমুদের মনে হয় –
আমার কেন মৃত্যু হল না??
পাঁচ বছর আগে হারিয়েছে অনেক কিছু, কিন্তু নতুন করে পেয়েছে লিলিকে, মিতাকে। জীবন যেন তার স্বাভাবিক ছন্দেই এগিয়ে যাচ্ছে কারো প্রতি কোনো ভ্রূক্ষেপই নেই। তাই সবশেষে মাহমুদের বলা সংলাপগুলো শাশ্বত সত্যকেই ধারণ করে-
কেন কাঁদছো লিলি? জীবনটা কি কারো অপেক্ষায় বসে থাকে? আমাদেরও একদিন মরতে হবে। তবে পৃথিবী এমনি চলবে। তার চলা বন্ধ হবে না কোনদিন। যে শক্তি জীবনকে চালিয়ে নিয়ে চলছে, তার কি কোন শেষ আছে লিলি…?
১৯৪২ সালের গণ-আন্দোলনের পটভূমিতে লিখিত জাগরী বই। একজন গান্ধিবাদী বাবা, তার সোশ্যালিস্ট ছেলে বিলু আর কমিউনিস্ট মতাদর্শে বিশ্বাসী নীলু এবং স্বামীর আজ্ঞাবাহী শাশ্বত মাতা এই চারজন যার মূল উপজীব্য চরিত্র। আরেকটু বিস্তারিত জানতে বইটির আলোচনা পড়ে আসুন: জাগরী – রাজনৈতিক উপন্যাসে স্নেহ ও আদর্শের মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব
মনসুর ও মরিয়ম
মরিয়ম, মেয়েটা এসএসসির টিউশনি করে কলেজ পাশ করেছে। টিউশনিতে গিয়ে পরিচয় মনসুরের সাথে ভালোলাগা তৈরি। মরিয়মের তিক্ত অতীত মরিয়মকে শঙ্কিত করে।
কিন্তু হঠাৎ মনসুরের উপস্থিতি পাল্টে দেয় মরিয়মের জীবন। মনসুরের সাথে বিয়ের পর স্বপ্নের ন্যায় জীবন কাটে মরিয়মের। কিন্ত মনসুরের সামনে মরিয়মের অতীত উন্মোচিত হলো। স্বপ্নগুলো কেমন যেন কপূর্রের মত উবে যায়। মনসুরের প্রশ্নের মুখে মরিয়মের মনে হয় –
তোমার কি মনে হয়, মানুষ দুবার প্রেমে পড়তে পারে ….?
আচ্ছা পাঠক, সত্যি কি মানুষ দুইবার প্রেমে পড়তে পারে না?
বাংলাদেশের প্রকাশনালয়গুলোর হাল-হাকিকত জানতে ঘুরে আসুন:
বিষয়বস্তু
সালেহা বিবির বৃষ্টির সময় ঘরে পানি পড়ার স্থানে পাত্র দেয়ার ঘটনা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখায় নিম্নবিত্তের পরিবারের করুণ বাস্তবতা। কৈশোরের প্রেম, পারিবারিক দায়িত্ব, সম্পর্কের টানাপোড়েন, বাঙালি পরিবারগুলোর ভালো থাকার নিরন্তর চেষ্টাকে উপজীব্য করে রচিত হয়েছে ‘বরফ গলা নদী’।
আর লেখক সব কিছুর সমাধান হিসেবে কি মৃত্যুকেই দেখিয়েছেন…? প্রশ্নটি পাঠক হিসাবে আপনার মনে উদিত হবে যে, তা অস্বাভাবিক কিছু না। সব কিছু ছাপিয়ে জীবনের গতিশীলতাই মুখ্য।


উপন্যাসের গঠন শৈলী ও লেখক
উপন্যাসটির গঠন শৈলীর ক্ষেত্রে যে বিষয়টি প্রথম নজর কাড়ে, তা হলো উপন্যাসটি শুরু হয়েছে শেষ দিয়ে। উপসংহারের আগে শিরোনাম দিয়ে উপন্যাসটির শেষ অংশ প্রথম ৩ পৃষ্ঠায় বর্ণিত হয়েছে। তার আগেও যা ঘটেছিল শিরোনাম নাম দিয়ে লেখক মূল গল্প বর্ণনা করেছেন।
শুরুতে শেষ বলে দিলেও উপন্যাসটি তার রহস্য আর আবেদন হারায়নি। কিংবদন্তিতুল্য লেখক জহির রায়হান বলেই তা সম্ভব। লেখক উপন্যাসে ঝরনাধারার মতই শব্দ গেঁথে সাবলীলভাবে বরফ গলা নদী উপন্যাসের জন্ম দিয়েছেন। যার কোনো কিছুই অতিরঞ্জিত নয়, সবই বাস্তবতার সৃষ্টিশীল রূপ দান।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সংঘটিত গণহত্যা নিয়ে নির্মিত স্টপ জেনোসাইড নামক প্রামাণ্যচিত্রের জন্য জহির রায়হানের খ্যাতি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বিস্তৃত। সিনেমা শিল্পের ন্যায় সাহিত্য অঙ্গনেও তাঁর দৃপ্ত পদচারণা রয়েছে। ১৯৬০ সালে শেষ বিকালের মেয়ে উপন্যাস প্রকাশের মাধ্যমে জহির রায়হান নামক তারকার বিজয়রথের শুভারম্ভ হয়। বরফ গলা নদী তাঁর চতুর্থ উপন্যাস। এটি প্রকাশিত হয় ১৯৬৯ সালে। তাঁর লেখা হাজার বছর ধরে উপন্যাসটি দীর্ঘ সময় বাংলাদেশের মাধ্যমিক বাংলা পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত ছিল।
জহির রায়হানের সৃষ্টিকর্মকে কাব্যের ঝঙ্কারে সাজিয়ে পাই,
শেষ বিকালের মেয়ে
তোমার জন্যে দাঁড়িয়ে আছি, বরফ গলা
নদীর তীরে, হাজার বছর ধরে, আরেক ফাল্গুন আসবে বলে আর কতদিন
তৃষ্ণা নিয়ে,
কয়েকটি মৃত্যু গুনব
এই ক্ষণজন্মা পুরুষ তাঁর ৩৭ বছরের জীবনে, বাংলা সাহিত্য ও সিনেমা শিল্পে অনুভব ও জীবন অভিজ্ঞতার এক বৈচিত্র্যপূর্ণ প্রাচুর্যের সম্ভার গড়ে দিয়েছেন।
ফিচার ছবিসূত্র: Pikwizard
অসামান্যতে প্রকাশিত অন্যান্য বই ও চলচ্চিত্র সংক্রান্ত আলোচনা পেয়ে যাবেন এখানে –
বই ও চলচ্চিত্র আলোচনা – অসামান্য
সম্পর্কিত নিবন্ধসমূহ: