- আফ্রিকা: প্রযুক্তি খাতে অন্যতম দ্রুত বর্ধনশীল এক অঞ্চল - October 20, 2020
প্রযুক্তির দ্রুত অগ্রগতির এই যুগে পৃথিবীর বেশিরভাগ মানুষ আজ মোবাইল এবং ইন্টারনেটের সাথে যুক্ত। বর্তমানে যে-কেউ খুব সহজেই প্রয়োজনীয় সকল তথ্য ইন্টারনেটে পেতে পারে; কিন্তু আপনি জেনে অবাক হবেন যে, পৃথিবীতে এখনো ৩ বিলিয়নেরও বেশি মানুষ আন্তর্জালের আওতার বাইরে! শুধু তাই নয়, আমার-আপনার প্রতিদিনের ব্যবহার করা খুব সাধারণ প্রযুক্তি থেকেও তারা বঞ্চিত। আফ্রিকা এমন এক মহাদেশ, যেখানে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক পরিমাণে এমন লোক রয়েছে।
এর অন্যতম প্রধান কারণ দরিদ্রতা। সঞ্চয়ের টাকা সুরক্ষিত রাখার ব্যবস্থাও আফ্রিকার অনেক জায়গায় নেই। মানুষ যে এক্ষেত্রে ব্যাংক ব্যবহার করছে না তা নয়, বিষয়টি হচ্ছে আফ্রিকার বেশিরভাগ জায়গায় ব্যাংকই নেই। তাই টাকা সবাইকে হাতে হাতে অথবা ঘরের কোন সুরক্ষিত জায়গায় রাখতে হয়। ফলে অনেকসময় টাকা হারিয়ে কিংবা চুরি হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। আর আফ্রিকার মতো জায়গায় প্রায় সবাই কঠোর পরিশ্রম করে টাকা অর্জন করে।
অনেকে হয়ত ভাবতে পারেন যে, বুদ্ধিমানের কাজ হবে টাকা যত দ্রুত সম্ভব সঠিক জায়গায় খরচ করে ফেলা। কিন্তু না! আফ্রিকার কৃষকদের ফসল বোনার মৌসুমে অন্যান্য সময়ের চেয়ে বেশি অর্থের প্রয়োজন হয়। এই অর্থ কৃষকরা ভালো জাতের বীজ বা পশুপাখি কেনায় ব্যবহার করে। কিন্তু অধিকাংশ সময় দেখা যায়, ঐ নির্দিষ্ট মৌসুম আসতে আসতে কৃষকদের কাছে যথেষ্ট পরিমাণ অর্থ থাকে না।তাই তাদের অর্থের প্রতি আলাদা খেয়াল রাখতে হয়।
এখন আপনার মনে হতে পারে যে, কোন প্রযুক্তি এই অর্থের সুরক্ষা ও কৃষিক্ষেত্রে সাহায্য করতে পারে? এখানে, আফ্রিকানরা একেবারে আধুনিক প্রযুক্তি সামর্থ্যে আনতে না পারলেও, তাদের কাছে যা আছে, তা হচ্ছে মোবাইল ফোন! হ্যাঁ, মোবাইল ফোন! নতুন কৃষকদের মাঝে অনেকেরই ফসল বোনা বা মৌসুম নিয়ে বেশ কিছু প্রশ্ন থাকে, যেমন কখন ফসল বোনা বা কাটার সঠিক সময়, অথবা কোন মৌসুমে কোন ফসল ফলানো যায় ইত্যাদি।
ফলে মৌসুম অনুযায়ী ফসল, আবহাওয়া, বাজারমূল্য ইত্যাদি যাবতীয় তথ্য বিভিন্ন কৃষি সংস্থা কিংবা স্থানীয় কর্তৃপক্ষ মুঠোফোন বার্তার মাধ্যমে গ্রাহককে প্রদান করে থাকে, অর্থাৎ এই ন্যূনতম প্রযুক্তি তাদের কাজকে অনেক সহজ করে দিয়েছে।
এমপেসা একটি মোবাইল ভিত্তিক ব্যাংকিং ব্যবস্থা, যেটি কিনা আফ্রিকার মানুষদের অর্থ সঞ্চয় করা অনেকটাই সহজ করে দিয়েছে। এখানে একজন ব্যবহারকারী তার কাছে থাকা অর্থ Mpesa অ্যাকাউন্টে (Mpesa সেবা কেন্দ্র অথবা খুচরা বিক্রেতার কাছে) জমা রাখে এবং একটি পিন কোড ব্যবহার করে মুঠোফোনের মাধ্যমে অর্থ আদান-প্রদান কিংবা ব্যালেন্স চেক করতে পারে। এক্ষেত্রে প্রতিবার লেনদেনের সময় খুবই কম পরিমাণ চার্জ দিতে হয়।
এটি আফ্রিকায় এতটাই প্রভাব ফেলেছে যে, কোম্পানিটি (২০০৭) চালু হওয়ার মাত্র ৩ বছরের মাথায় সেটি আফ্রিকার সবথেকে সফল মোবাইলভিত্তিক ব্যাংকিং সেবায় পরিণত হয়েছে।
২০২০ সালের ফোর্বসের একটি নিবন্ধ অনুযায়ী পুরো আফ্রিকাজুড়ে এমপেসার ৪০ মিলিয়ন ব্যবহারকারী রয়েছে, যা সেখানকার খুব এক বড় সমস্যা দূর করেছে। আর এই সবই হয়ে থাকে একেবারে সাধারণ টেক্সট মেসেজিং-এর মাধ্যমে।[১]
মোজা ওয়াইফাই, বিআরসিকে (BRCK) কোম্পানির একটি পাবলিক ওয়াইফাই নেটওয়ার্ক, যেখানে নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে যে কোনো ব্যক্তি বিনামূল্যে ইন্টারনেটের সাথে যুক্ত হতে পারে, যেখানে একজন ব্যবহারকারী, গান শোনা, ভিডিয়ো দেখা, কিংবা ই-বই পড়ার জন্য সঞ্চিত তথ্য ব্যবহার করতে পারে।
পাটাতনটি উভয়ের সুবিধার্থে অন্যান্য কোম্পানিদেরও বিজ্ঞাপনও প্রদর্শন করার সুযোগ দিয়ে থাকে, তা সে ভিডিয়ো, ওয়েবসাইট কিংবা অ্যাপ যাই হোক না কেন। তাছাড়া কোম্পানিটির উপর বেশ কিছু বিনিয়োগও রয়েছে।
বিআরসিকে কেনিয়ার একটি উল্লেখযোগ্য সংস্থা এবং খুব অল্প সময়ের মধ্যে তারা আফ্রিকায় নিজেদের একটি শক্ত অবস্থান তৈরি করে নিয়েছে। বর্তমানে পূর্ব আফ্রিকায় বিআরসিকে ২,৭০০ টি স্থানে রয়েছে এবং মাসিক ৭ লাখেরও বেশি ব্যবহারকারী তাদের সেবা ব্যবহার করে থাকে।
বিআরসিকে-র প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এরিক হার্সম্যান বলেন:
আমরা সেখানে কাজ করি না, যেখানে আমরা মনে করি ইন্টারনেট ব্যবহারকারী আছে। আমরা সেখানে কাজ করি, যেখানে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী নেই। আমরা বুঝতে পারি যে, তাদের অর্থের অভাব। তাই এখানে ব্যবসায়ের মডেল আমাদের অনেকটাই ভিন্ন। আমাদের ব্যবহারকারীরা অর্থ দিয়ে ইন্টারনেট নয়, বরং তাদের সময় দিয়ে ইন্টারনেট কেনে।[২]
কিন্তু এই ফ্রিতে ইন্টারনেট ব্যবহারে প্রাইভেসির ঝুঁকি থাকা অস্বাভাবিক কিছু নয়। তবুও মোজা ওয়াইফাই এর জনপ্রিয়তা আফ্রিকায় ব্যাপকভাবে বেড়ে চলেছে।
এখন একটি প্রশ্ন আসতেই পারে, যে আফ্রিকার দরিদ্র মানুষরা সাধারণ জীবনে অতিরিক্ত টাকা খরচ না করতে পারলে মোবাইল ফোনের উপর কিভাবে করবে? আর আফ্রিকায় উঠতি বাজারে মোবাইল ফোন কিনতে গড়প্রতি মানুষ $৩৪ (৩,০০০৳) খরচ করতে পারে। কিন্তু এই টাকায় 3G/4G/LTE ফোন না পাওয়াই স্বাভাবিক, যেখানে গড় স্মার্টফোনে খরচ হয় $১২০ (১০,৫০০৳)।
আর এখানেই KaiOS তার প্রভাব বিস্তার করছে।
২০১৬ সালে ‘ফায়ারফক্স ওএস’ এর ব্যর্থতার পর ‘মোজিলা’ তাদের মোবাইল অপারেটিং সিস্টেমের প্রজেক্টটি বন্ধ করে দেয়। কিন্তু ওপেন সোর্স হওয়ায় থেকে যায় এই পুরো ওয়েব ভিত্তিক ওএস প্রজেক্টের সোর্স কোড।
তার একবছর পর, এই কোডের উপর ভিত্তি করে জন্ম নেয় এক নতুন ওয়েব ভিত্তিক অপারেটিং সিস্টেম, যা ‘কাইওএস‘ নামে পরিচিত। এটি কেবল এইচটিএমএল, সিএসএস এবং জাভাস্ক্রিপ্ট দিয়ে লেখা হলেও এর মধ্যে থাকা আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্যগুলো যে কাউকে মুগ্ধ করবে।
এমনকি স্মার্টফোনের বেশ কিছু জনপ্রিয় অ্যাপস, যেমন- ইউটিউব, গুগল অ্যাসিস্টেন্ট, টুইটার, হোয়াটসঅ্যাপ, গুগল ম্যাপস, ফেসবুক ইত্যাদি খুব ভালোভাবেই এই ওএস এর সাথে অপটিমাইজ করা হয়েছে, ফলে একজন ব্যবহারকারী স্মার্টফোনের অভিজ্ঞতা কিছুটা হলেও পেয়ে থাকেন।
এছাড়াও এতে থার্ড পার্টি অ্যাপ্লিকেশনের সু-ব্যবস্থা থাকার সাথে সাথে কাইওএস এর আলাদা করে সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট কিটও আছে। ফলে একজন ডেভেলপার খুব সহজেই অ্যাপ, গেম তৈরী করে কাই অ্যাপ স্টোরে প্রকাশ করতে পারবেন। আর অ্যাপগুলোতে বিজ্ঞাপন প্রদর্শন করার সুবিধা তো রয়েছেই।


রিপোর্ট অনুযায়ী[৩] ২০১৮ এর শুরুর দিকে অ্যাপলকে পেছনে ফেলে কাইওএস ভারতের ২য় অধিক জনপ্রিয় অপারেটিং সিস্টেমে পরিণত হয়েছে। তার উপর তারা বেশ কিছু কোম্পানি যেমন: নোকিয়া, জিও, অ্যালকাটেল, টেকনো ইত্যাদি ম্যানুফ্যাকচারদের সাথে যুক্ত হয়ে মোবাইল ইন্ডাস্ট্রিতে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করছে।
কেবল মার্কেট শেয়ার কিংবা মুনাফা আদায়ের জন্য নয়, আজও যারা ইন্টারনেট থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে তাদের জন্য স্মার্টফোনের বিশেষ বৈশিষ্ট্যগুলো, একটি ফিচার ফোনে সবার দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে কাইওএস তার পুরো চেষ্টা করছে।
আরও পড়ুন: লিনাস টোরভাল্ডস: যিনি হতে পারতেন বিল গেটস
সবশেষে বলতে গেলে, কাইওএস পুরোপুরি একটি প্ল্যাটফর্ম। অ্যান্ড্রয়েড, আইওএস এর সাথে তাল মিলিয়ে তারাও মোবাইল ইন্ডাস্ট্রিতে পরিবর্তন আনছে এবং আফ্রিকা হয়ে উঠেছে পৃথিবীর সবথেকে দ্রুত বর্ধনশীল মোবাইল ইন্ডাস্ট্রির একটি।
কিন্তু আফ্রিকায় যদি বিদ্যুৎ এর অভাব থাকে, তাহলে মানুষ, মোবাইল বা অন্যান্য ইলেকট্রনিক্স কীভাবে ব্যবহার করবে?
আধুনিক যুগে আমাদের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, প্রকৃতিকে হুমকির মুখে না ফেলে কীভাবে প্রযুক্তি সবার মাঝে পৌঁছানো যায়। আফ্রিকার ৬৫০ মিলিয়ন মানুষ এখনো বিদ্যুৎ থেকে বঞ্চিত থাকলেও, বেশ কিছু স্টার্টআপ কোম্পানি প্রতিনিয়ত চেষ্টা করে যাচ্ছে সমস্যাটির সমাধান করতে।
‘পাওয়ারহাইভ‘ হচ্ছে কেনিয়ার প্রথম ব্যক্তিগত লাইসেন্সযুক্ত প্রতিষ্ঠান, যারা বর্তমানে ২৫টির বেশি গ্রামে কাজ করছে। এখানে বিদ্যুৎ ব্যবহারকারীদের একটি ছোট নেটওয়ার্ক সৌরকোষের (সোলার) মূল উৎসের সাথে সংযুক্ত থাকে, যা স্বাধীনভাবে কাজ করতে সক্ষম হয়।
সহজ কথায়, সৌরকোষ থেকে শক্তি ব্যাটারিতে সংরক্ষিত হয়, তারপর ব্যাটারি থেকে বিভিন্ন ঘরে বিদ্যুৎ সরবরাহ হয়ে থাকে। এই প্রযুক্তি শুরুতে বেশ ব্যয়বহুল হলেও, ধীরে ধীরে এর দাম অনেক কমে এসেছে। আগে যেখানে প্রতি ওয়াট বিদ্যুৎ এর দাম ছিল ৫-৬ ডলার, যা আজ ২০ সেন্ট এ এসে দাঁড়িয়েছে।[৫]
এবং এর ফলাফল!?
বর্তমানে অনেক আফ্রিকানরা তাদের দৈনন্দিন জীবনে বিদ্যুৎ ব্যবহার করতে পারছে। এর ব্যবহার রয়েছে মোবাইল ফোন থেকে শুরু করে বিভিন্ন ইলেক্ট্রনিক্স চার্জ করতে। এবং আরেকটি বিস্ময় হচ্ছে আফ্রিকায় ইলেক্ট্রিক বাইক এর প্রভাব।
এটি অন্যান্য সাধারণ মোটরসাইকেলের মত কাজ করে এবং এতে মুভিং পার্ট কম থাকায় ব্যবহার করা বা ঠিক করতেও সুবিধা হয়। ব্যাটারির ক্ষেত্রে এখানে বিভিন্ন জায়গায় রয়েছে মোটর স্টেশন, যেখানে খুব সহজেই ব্যাটারি পরিবর্তন, বা রিপেয়ার করা যায়। এমনকি ফুয়েল এর তুলনায় ইলেক্ট্রিক বাইকের ব্যাটারি কম মূল্যে পাওয়া যায়।
বিভিন্ন স্কুল, খামার, গ্যারেজ, বা গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় প্রযুক্তি তার অবদান রাখছে। এসব ছাড়াও, আরো বহু স্টার্টআপ কোম্পানি আফ্রিকায় তাদের কাজ করে যাচ্ছে। আর প্রতিটি ক্ষেত্রেই তাদের খেয়াল রাখতে হচ্ছে প্রযুক্তিটি পরিবেশবান্ধব কিনা এবং সাধারণ মানুষের জন্য তা কতটুকু সাশ্রয়ী।
আর এভাবেই প্রযুক্তির বিস্তার আফ্রিকায় বিপ্লব ঘটাচ্ছে এবং সময়ের সাথে সাথে তৈরি হয়ে নিচ্ছে আফ্রিকার আগামী প্রজন্ম।
ফিচার ছবিসূত্র: ফ্লিকার
তথ্যসূত্র:
সম্পর্কিত নিবন্ধসমূহ: