- বিচিত্র মানুষের বিচিত্র স্বভাব নিয়ে ব্যোমকেশের চিড়িয়াখানা - February 16, 2021
- রুলার অফ দ্য ওয়ার্ল্ড: মুঘল সাম্রাজ্যের স্বর্ণালী যুগের কারিগর সম্রাট আকবর - February 13, 2021
- ফ্রিডম অ্যাট মিডনাইট: দেশভাগের এক পূর্ণাঙ্গ আখ্যান - February 4, 2021
বিংশ শতাব্দীর আশির দশকের কথা বলছি। ভারত তখন মাত্রই বিশ্বসভায় নিজেকে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালাচ্ছে। ইন্দিরা গান্ধি ১৯৮০ এর নির্বাচনে তার ক্যারিশমা দেখিয়ে আবার ফিরে এসেছেন নিজরূপে। নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েই জিতেছেন তিনি নির্বাচন। অর্থমন্ত্রি হিসেবে নিয়োগ দিলেন রামস্বামী ভেঙ্কটরমনকে। তবে ১৯৮২ সালের দিকে মহাশূন্য অভিযান এবং সামরিক ব্যবস্থাপনার জন্য তাঁকে পাঠিয়ে দিলেন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে। সেই শূন্যস্থান এসে পূরণ করলেন তুলনামূলক কম বয়সের একজন। বয়স পঞ্চাশের কোঠায় পৌঁছে গেলেও এখন পর্যন্ত কোনো মন্ত্রণালয়ের পূর্ণমন্ত্রির দায়িত্ব পালন করেননি। তাই, অর্থ মন্ত্রণালয়ের মত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব এক অপেক্ষাকৃত কম অভিজ্ঞের হাতে দেওয়া কী ঠিক হচ্ছে, এই প্রশ্ন তুলেছিলেন অনেকেই। কিন্তু প্রধানমন্ত্রি ঠিকই চিনেছিলেন তাঁকে। আর প্রতি পদক্ষেপে তাঁর বিশ্বাসের মূল্যও দিয়েছেন তিনি। হ্যাঁ, আর কেউ নন; আমরা বলছি প্রণব মুখার্জির কথা।


প্রণব মুখার্জির জন্ম ও প্রারম্ভিক জীবন
প্রণব মুখার্জি তৎকালীন অবিভক্ত ভারতবর্ষের অন্তর্গত বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির অন্তর্গত (বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের) বীরভূম জেলার মিরাটি গ্রামে ১৯৩৫ সালের ১১ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা কিংকর মুখার্জি ছিলেন ভারতবর্ষের ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের একজন সক্রিয় নেতা এবং ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস এর একজন সদস্য। কিংকর মুখার্জি ১৯৫২ থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের প্রাদেশিক সভায় ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিনিধির দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর মাতার নাম রাজলক্ষ্মী মুখার্জি ।


পিতার রাজনীতির সূত্রে তিনি ছোটকাল থেকেই রাজনীতির সাথে পরিচিত ছিলেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও, মুখার্জি পরিবারে লেখাপড়ার অবস্থান ছিল সর্বাগ্রে।


তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত সুরি বিদ্যাসাগর কলেজ থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেন। পরবর্তীতে, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই তিনি রাষ্ট্রবিজ্ঞান এবং দর্শনে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। এর পাশাপাশি তিনি আইন বিষয়ে এলএলবি অর্জন করেন একই স্থান থেকে।
রাজনৈতিক জীবনে প্রবেশ
পিতার সূত্রে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের আদর্শের দ্বারা প্রণব মুখার্জি প্রভাবিত ছিলেন।১৯৬৬ সালের দিকে যখন তিনি বাংলা কংগ্রেসে (ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের কিছু বিপ্লবী নেতা-কর্মী মিলে কংগ্রেস থেকে বের হয়ে পশ্চিমবঙ্গে এই দল প্রতিষ্ঠা করেন।)(১) একজন সাধারণ সদস্য হিসেবে যোগদান করেন, বাংলা কংগ্রেস তখন এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছিল। নেতা-কর্মীদের অন্তঃকোন্দল চরম রূপ ধারণ করেছিল। কিছুদিন পূর্বেই জওহরলাল নেহেরুর মৃত্যুর কারণে এমনিতেই জাতীয় কংগ্রেস কিছুটা নাজুক অবস্থায় ছিল। তাই চারদিকেই অরাজকতার বিস্তৃতি। ১৯৬৯ সালের উপনির্বাচনের সময় তিনি নিরপেক্ষ প্রার্থী ভি. কে. মেনন এর প্রধান নির্বাচনী এজেন্ট ছিলেন। তাঁর অভিনব কৌশলের কারণে উক্ত নির্বাচনে ভি. কে. মেনন জয়লাভ করেন। এভাবেই তিনি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রি ইন্দিরা গান্ধির দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। পরবর্তীতে তাঁর আমন্ত্রণেই প্রণব মুখার্জি বাংলা কংগ্রেস ছেড়ে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের মূলধারার দলে যোগ দেন।
প্রণবের মূলধারার রাজনীতিতে প্রবেশ
ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের মূলধারার দলে যোগ দেওয়ার পর থেকেই জাতীয় পর্যায়ে তাঁর বড় ধরনের উত্থান ঘটে। টানা বেশ কয়েকবার তিনি রাজ্যসভায় নির্বাচিত হন। এর পাশাপাশি কংগ্রেসের মূল দলে তাঁর অবস্থান পাকাপোক্ত হতে থাকে। ১৯৭৫ সালে ইন্দিরা গান্ধির ঘোষণাকৃত জরুরী অবস্থা চলাকালীন দল এবং সরকার উভয় জায়গায় শক্ত হাতে সকল ধরনের সমালোচনা তিনি দমন করেন। একারণে অনেকে তাঁকে ইন্দিরা গান্ধির অদৃশ্য ডান হাত নামে অভিহিত করা শুরু করেন।
১৯৭৭ সালের নির্বাচনে ইন্দিরা গান্ধির নিয়ন্ত্রিত কংগ্রেসের ভরাডুবি ঘটে। এই সময়ে প্রণব মুখার্জি দৃশ্যপটে কিছুটা পিছনে সরে গেলেও ১৯৮০ সালের নির্বাচনে ইন্দিরা গান্ধি বড় ধরনের জয়লাভ করেন। প্রণব মুখার্জি পার্লামেন্টে সভার প্রধান নির্বাচিত হন। সরকার এবং পার্লামেন্ট উভয় জায়গায় তখন ইন্দিরা গান্ধি নিয়ন্ত্রিত কংগ্রেসের জয়জয়কার। প্রণব মুখার্জি তাঁর কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৮২ সালে ক্যাবিনেটে অর্থমন্ত্রির দায়িত্ব পান।
১৯৮৪ সালে নিজের দেহরক্ষীর গুলিতে প্রধানমন্ত্রি ইন্দিরা গান্ধি নিহত হন। দৃশ্যপটে আসে ব্যাপক পরিবর্তন। ইন্দিরা গান্ধির স্থলাভিষিক্ত হন তাঁরই পুত্র রাজিব গান্ধি। রাজনৈতিকভাবে রাজিব গান্ধি ছিলেন সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ, চাকরি করতেন এয়ার ইন্ডিয়াতে একজন বৈমানিক হিসেবে। নানাবিধ কারণে রাজিব গান্ধি এবং প্রণব মুখার্জির সম্পর্কে শীতলতা সৃষ্টি হয়।


ধীরে ধীরে জাতীয় রাজনীতির মূল নাট্যমঞ্চ থেকে তিনি নিজেকে গুটিয়ে আনলেন। ক্যাবিনেট থেকে তিনি বরখাস্ত হন এবং তাঁকে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কংগ্রেসের কাজে পাঠানোর নামে কেন্দ্র থেকে দূরে সরিয়ে দেওয়া হয়।
প্রণব মুখার্জি নিজেকে ধীরে ধীরে কংগ্রেস থেকে গুটিয়ে ফেললেন, এমনকি পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কংগ্রেস থেকেও। ১৯৮৬ সালে তিনি গঠন করেন রাষ্ট্রীয় সমাজবাদী কংগ্রেস। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের জনপ্রিয় নেতাদের তেমন কেউই ছিলেন না এই রাজনৈতিক দলে। তাই ১৯৮৯ সালের সাধারণ নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গেই তেমন সুবিধা করতে পারেনি এই দল। কালক্রমে এটি মূল জাতীয় কংগ্রেসেই আত্মীকৃত হয়ে যায়।
প্রণবের পুনরায় রাজনীতিতে ফিরে আসা
দাবার ঘর সম্পূর্ণ উল্টে যায় ১৯৯১ সালে, যখন রাজিব গান্ধি তাঁর ১০ম লোকসভা নির্বাচনের প্রচারণা চালানোর সময় এলটিটিই এর সমর্থক থেনমঝি রাজারত্নম এর আত্মঘাতী বোমা বিস্ফোরণে নিহত হন। সেই নির্বাচনে কংগ্রেস নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে এবং প্রবীণ কংগ্রেস নেতা পি ভি নরসিমা রাও প্রধানমন্ত্রি নিযুক্ত হন।


প্রণব মুখার্জি সম্পর্কে তাঁর পরিষ্কার ধারণা ছিল এবং রাজিব গান্ধির মৃত্যুর পরে দলে যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে, তা পূরণ করার জন্য যে তিনিই একমাত্র উপযুক্ত ব্যক্তি; সেটাও তিনি অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। তাঁর আমন্ত্রণে প্রণব মুখার্জি কেন্দ্রীয় সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের দায়িত্বভার নেন এবং একই সাথে ১৯৯৫ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত এই ক্যাবিনেটে তিনি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রির দায়িত্বও পালন করেন।
মূলধারার রাজনীতিতে শক্ত অবস্থান গ্রহণ
আজীবন প্রণব ছিলেন গান্ধি পরিবারের প্রতি অনুরক্ত। সোনিয়া গান্ধিকে মূলধারার রাজনীতিতে নিয়ে আসার পেছনে তাঁর অবদানই সবচেয়ে বেশি।


১৯৯৮ সালে সোনিয়া গান্ধি কংগ্রেসের সভাপতি এবং প্রণব সাধারণ সম্পাদক নিযুক্ত হন। পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কংগ্রেসের সভাপতিও নিযুক্ত হন তিনি।
২০০৪ সালের নির্বাচনে তিনি লোকসভায় কংগ্রেস দলীয় দলনেতা নিযুক্ত হন। আশা করা হচ্ছিল, প্রধানমন্ত্রি হিসেবে প্রণব মুখার্জি দায়িত্ব লাভ করবেন। কিন্তু নানাবিধ কারণে তাঁকে আর দায়িত্ব দেওয়া হয়নি। এই অবস্থায় অনেকে প্রণবকে ভারতীয় জাতীয় ক্রিকেট দলের রাহুল দ্রাবিড়ের সাথে তুলনা করেন। রাহুল দ্রাবিড়কে বলা হত ভারতীয় জাতীয় দলের দেয়াল। যেকোনো বিপর্যয়ের সময় তাঁর কাঁধেই চাপতো গুরুদায়িত্ব। কিন্ত কোনোদিনই তিনি শচীন, সৌরভ বা মহেন্দ্র সিং ধোনির মত সম্মান ও খ্যাতি পাননি।
এই সরকারের প্রথমার্ধে তিনি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৬ সালে এসে নতুন বিপত্তির উদ্ভব ঘটে। ২০০৭ সালে নতুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের কথা ছিল। খুবই জোরালোভাবে কংগ্রেসের রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী হিসেবে শোনা যাচ্ছিল প্রণব মুখার্জির নাম। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার পড়ে গেলো মহাবিপদে। কারণ, কংগ্রেসে তখন তাঁর মত অভিজ্ঞ এবং বিশ্বস্ত আর কেউই ছিলেন না, যার হাতে প্রতিরক্ষা বা পররাষ্ট্রের মত মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া যায়। তাই, রাষ্ট্রপতি পদের জন্য কংগ্রেসের প্রার্থী প্রণব মুখার্জিকে না করে করা হয় প্রতিভা পাতিলকে। প্রণব মুখার্জি ২০০৬ সালেই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নেন।
মনমোহন সিংয়ের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রিত্বে তিনি অর্থমন্ত্রির দায়িত্ব পালন করেন। মনমোহন সিংয়ের দুই সরকারের সময়ই তিনি সরকার, আঞ্চলিক দল এবং জাতীয় দল; এই তিন জায়গায় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। পাশাপাশি তিনি সরকারের বিভিন্ন কমিশনের অংশ হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।
রাজনৈতিক জীবনের আনুষ্ঠানিক পরিসমাপ্তি
২০১২ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের সময় তিনি কংগ্রেস দলীয় প্রার্থী হন এবং উচ্চকক্ষ ও নিম্নকক্ষ উভয় জায়গা থেকে বিপুল সমর্থন পেয়ে তিনি ভারতের ১৩তম রাষ্ট্রপতি নিযুক্ত হন।


এভাবেই এই রাজনৈতিক নেতার আনুষ্ঠানিক রাজনৈতিক জীবনের সমাপ্তি ঘটে। এই দায়িত্ব গ্রহণের পূর্বে তিনি লোকসভা এবং বিধানসভা থেকে পদত্যাগ করেন। পাশাপাশি সরকারের অর্থমন্ত্রির দায়িত্ব থেকেও ইস্তফা দেন। ২০১২ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত তিনি রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন। এরপরে তিনি চলে যান লোকচক্ষুর অন্তরালে। দীর্ঘ প্রায় পাঁচ দশক ছিলেন তিনি কংগ্রেসের মূলস্তম্ভ। কংগ্রেসের বড় ধরনের বিপর্যয়ে তিনি ছিলেন ঢাল হয়ে।
ব্যক্তিগত জীবন
১৯৫৭ সালে তিনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) নড়াইলের শুভ্রা মুখার্জিকে বিবাহ করেন।


এই দম্পতির তিন সন্তান আছে। তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র অভিজিৎ মুখার্জি কংগ্রেসের প্রার্থিতায় প্রণব মুখার্জির আসনে লোকসভা সদস্য নির্বাচিত হন।


কন্যা শর্মিষ্ঠা মুখার্জি একজন কথক নৃত্যশিল্পী এবং কংগ্রেসের একজন রাজনীতিবিদ।


২০১৫ সালে হৃদযন্ত্রের সমস্যায় প্রণব মুখার্জির স্ত্রী শুভ্রা মুখার্জি মৃত্যুবরণ করেন।
প্রণব মুখার্জির রাজনৈতিক অর্জন
প্রণব মুখার্জির রাজনৈতিক অর্জন বিশাল। প্রতি পদেই তিনি সাফল্য অর্জন করেছিলেন। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকাকালীন, ভারত এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সামরিক চুক্তি সম্পাদিত হয়। একই সাথে, রাশিয়ার সাথে কৌশলগত সম্পর্কোন্নয়নে তিনি ভুমিকা পালন করেন। নরসিমা রাও সরকারের ‘লুক ইস্ট পলিসি’ বাস্তবায়নের জন্য তিনি ভারতের পক্ষ থেকে আসিয়ানের ‘ফুল ডায়ালগ পার্টনার’ নিযুক্ত হন। ২০০৮ সালে মুম্বাই সিরিজ বোমা হামলার পরে তাঁর অবস্থান ছিল ভারতের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে যাই হোক না কেন, তিনি সবচেয়ে বেশি সময় ধরে পালন করেছেন অর্থমন্ত্রির দায়িত্ব এবং এক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা ছিল প্রশ্নাতীত। প্রথম দায়িত্বে ভারতের আইএমএফ এর ঋণ পরিশোধ এবং মনমোহন সিংকে ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর নিয়োগ ছিল তাঁর খুবই কৌশলগত পদক্ষেপ। ভারতের আধুনিক সমন্বিত করব্যবস্থার কৃতিত্ব অনেকাংশে তাঁর।
প্রণব মুখার্জির সমালোচনা
প্রণব মুখার্জি তাঁর দীর্ঘ পাঁচ দশকের রাজনৈতিক জীবনে কখনোই নিজেকে একজন জননেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি বলে অনেকেই অভিযোগ করেন। বরং, সর্বদাই তিনি ছিলেন দল এবং সরকারের একজন গুরুত্বপূর্ণ থিংক ট্যাঙ্ক। তাছাড়া, ১৯৭৫ সালে জরুরি অবস্থা চলাকালীন তিনি ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন, এরূপ অভিযোগও আছে তাঁর বিরুদ্ধে। অর্থমন্ত্রি হিসেবে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হওয়াতে তিনি জনরোষের সম্মুখীন হয়েছিলেন।
আরও পড়ুন: নেতাজি: এক মহানায়কের জীবনকথা এবং মৃত্যু
সম্মাননা
তিনি তাঁর কর্মক্ষেত্রে সফল হিসেবে জনবিদিত। ইউরোমানি ম্যাগাজিন এর এক সমীক্ষা অনুযায়ী তিনি ১৯৮৪ সালে পৃথিবীর অন্যতম সফল একজন অর্থমন্ত্রি ছিলেন। ২০১৪ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন। ২০১৩ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক ডি.লিট. উপাধি লাভ করেন। এছাড়াও, ২০০৮ সালে ভারতের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা পদ্মবিভূষণ এবং ২০১৯ সালে ভারতের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা ভারতরত্ন লাভ করেন।


বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে সহায়তার স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি ২০১৩ সালে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক ‘বাংলাদেশ স্বাধীনতা যুদ্ধ সম্মাননা’ লাভ করেন।


প্রণব মুখার্জির মহাপ্রয়াণ
রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব শেষ হওয়ার পরে একপ্রকার লোকচক্ষুর আড়ালে চলে যান।দায়িত্ব পালন শেষে অবসরপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি হিসেবে সরকার থেকে বরাদ্দপ্রাপ্ত ১০ রাজাজি মার্গ এর বাসায় তিনি চলে যান। সেখানে তিনি তাঁর বইয়ের সংগ্রহ নিয়ে জীবন কাটাতে থাকেন। ২০২০ সালের আগস্ট মাসে ব্রেইন সার্জারির পূর্বে করা রক্ত পরীক্ষা থেকে জানা যায়, তিনি কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত।


তিনি টুইটারে জনগণের সাথে এই তথ্য শেয়ার করেন। কিছুদিন পরে নিজের বাসায় বাথরুমে স্লিপ করে পরে যাওয়াতে মাথায় আঘাত পাবার পরে তাঁকে দ্রুত হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। ১৩ আগস্ট হাসপাতালের পক্ষ থেকে জানানো হয়, তিনি কোমায় আছেন। ২৫ আগস্ট জানানো হয় যে, তাঁর অবস্থা দিন দিন খারাপ হচ্ছে। ৩১ আগস্ট, বিকাল ৫ টা ৫০ মিনিটে তাঁর পুত্র অভিজিৎ মুখার্জির টুইটার অ্যাকাউন্ট এর টুইট থেকে প্রণব মুখার্জির মৃত্যু নিশ্চিত হয়।


এই সংবাদের পরেই রাজনৈতিক অঙ্গনে নেমে আসে শোকের ছায়া। সরকারের পক্ষ থেকে ৩১ আগস্ট থেকে ৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করা হয় এবং জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সকল রাজনৈতিক নেতা তাঁর কর্মময় জীবনের স্মরণ করেন এবং তাঁর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেন।


পরবর্তীতে ২০২০ সালের ১ সেপ্টেম্বর ভারতীয় সময় বেলা ২টায় দিল্লিতে তাঁর সৎকার করা হয়।
ভারতের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে প্রণব মুখার্জির মত নেতা সত্যিই বিরল। যাবতীয় ধরনের বিতর্ক থেকে তিনি দূরে ছিলেন আজীবন। নিজের যাবতীয় দায়িত্ব তিনি অত্যন্ত সুচারুরূপে সম্পাদন করেছেন। দল হোক বা সরকার, সবজায়গায় তিনি সততা এবং নিয়ম-নিষ্ঠার অনুশীলন করে গেছেন। আগামীর জন্য তিনি এক অনুকরণীয় আদর্শ হয়ে থাকবেন।
গ্রন্থসূত্র :
(১) Split in a Predominant Party : The Indian National Congress in 1969; লেখক : মহেন্দ্র প্রসাদ সিং; অভিনব প্রকাশনী; পৃষ্ঠা – ১০৫
ফিচার ছবিসূত্র: The Financial Express