- প্যারালাল ইউনিভার্স: বাস্তব নাকি কল্পকাহিনি? - October 18, 2020
- অ্যানা ফ্রাংকের ডায়রি: দ্য সিক্রেট অ্যানেক্স - August 21, 2020
ধরুন, আপনারই মতো দেখতে একজন আরেকটি পৃথিবীতে বসে আপনার মতো মনোযোগ দিয়ে প্যারালাল ইউনিভার্স সম্পর্কে একটি লেখা পড়ছে এবং আপনার মতোই প্রথম লাইন পড়ে মুচকি মুচকি হাসছে! এটা কি আদৌ সম্ভব? নাকি শুধুই আমাদের কল্পনা? সারাদিন Predestination, Interstellar, Doctor Who, Dark, Stranger Things দেখে কি আমরা কল্পকাহিনিকে বাস্তব ভাবা শুরু করেছি? আসুন, দেখি বিজ্ঞান কী বলে?
প্যারালাল ইউনিভার্স কী?
কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞানের মতে আমাদের মহাবিশ্বের মতোই সমান্তরাল আরও কিছু মহাবিশ্ব এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে রয়েছে। অর্থাৎ আমাদের পৃথিবীর মতো আরও কিছু পৃথিবী রয়েছে যেখানে সময় উল্টোদিকে প্রবাহিত হয় আর এক মহাবিশ্বের অস্তিত্বের কথা অন্য সব মহাবিশ্ব জানে না।
মহাবিশ্বের ব্যাপারে আমরা আজ পর্যন্ত যা জানি ১৩.৭ বিলিয়ন বছর আগে তা ছিল এক অনন্য একক বিন্দু। বিগ ব্যাং থিওরি অনুসারে কোনো এক অজানা কারণে এক বিস্ফোরণ হয়, যার ফলে এটি ত্রিমাত্রিক স্থানে প্রসারিত হয়। মহাবিশ্বের আয়তন যত বৃদ্ধি পেতে থাকে ততই এর তাপমাত্রা কমতে থাকে। এর ফলে ছোট ছোট কণাগুলো ধীরে ধীরে ছায়াপথ, গ্রহ, নক্ষত্র ইত্যাদি বৃহদাকার ধারণ করতে থাকে। এখানে প্রশ্ন হলো বিগ ব্যাং সংঘটিত হওয়ার সময় কী শুধু একটি মহাবিশ্ব সৃষ্টি হয়েছিল নাকি অনেকগুলো হয়েছিল?
আমাদের বর্তমান প্রযুক্তির সীমাবদ্ধতার কারণে এ ব্যাপারে আমরা জানতে পারিনা কারণ আমাদের মহাবিশ্ব বাঁকানো রয়েছে। আমরা একটি ফিসবোলের অভ্যন্তরে রয়েছি যার জন্য এর বাইরের কিছু আমরা জানতে অক্ষম।
প্যারালাল ইউনিভার্স এবং শ্রোডিঙ্গারের বিড়াল তত্ত্ব
শ্রোডিঙ্গারের বিড়াল তত্ত্ব অথবা জম্বি ক্যাট থিওরির সাহায্যে প্যারালাল ইউনিভার্সের অসাধারণ একটি ব্যাখা পাওয়া যায়। তত্ত্বটি ছিল এরকম –
কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞানের মতে আমরা জানি একটি ইলেকট্রন একই সাথে দুই দিকে ঘুরতে পারে। এখন একটি বদ্ধ কক্ষে একটি ইলেকট্রন রয়েছে। ইলেকট্রনটি ঘূর্ণন শনাক্তকারী একটি যন্ত্রের সাথে যুক্ত যার শেষ প্রান্তে একটি হাতুড়ি রয়েছে। হাতুড়ির সামনে একটি বিষপূর্ণ ফ্লাস্ক রয়েছে যা একটি জীবন্ত বিড়ালের সাথে একটি আবদ্ধ পাত্রে রাখা আছে। পাত্রটি পরিবেশের আহিত কোয়ান্টাম ডিকোহেরেন্স প্রতিরোধী। যদি পাত্রের ভেতরে থাকা গাইগার কাউন্টার তেজস্ক্রিয়তা শনাক্ত করে, তবে ফ্লাস্কটি ভেঙ্গে যাবে এবং বিষ নির্গত হবার কারণে বিড়ালটি মারা পড়বে। কোয়ান্টাম বলবিদ্যার কোপেনহেগেন ব্যাখ্যানুযায়ী, কিছু সময় পর দেখা যাবে, বিড়ালটি জীবিত এবং মৃত। যদিও বাক্সের ভেতরে তাকালে আমরা দেখতে পাবো বিড়ালটি হয় জীবিত নয় মৃত।
অর্থাৎ ইলেকট্রনটি যদি ঘড়ির কাঁটার দিকে ঘোরে তাহলে বিড়ালটি মারা যাবে এবং যদি ঘড়ির কাঁটার বিপরীত দিকে ঘোরে তবে বিড়ালটি বেঁচে থাকবে। কিন্তু আমরা জানি ইলেকট্রন একই সাথে দুই দিকে ঘোরে সুতরাং এমন একটি বিড়াল ঐ কক্ষে রয়েছে যা একই সাথে জীবিত এবং মৃত। এটি কীভাবে সম্ভব? একটি মাত্র ক্ষেত্রে এই ঘটনা সম্ভব এবং তা হলো যদি দুইটি বিপরীত ঘটনা একই সময়ে একই স্থানে ঘটে এবং যা প্যারালাল ইউনিভার্সের অস্তিত্বকে ইঙ্গিত করে।
শ্রোডিঙ্গার এবং তাঁর বিড়াল তত্ত্ব সম্পর্কে আরেকটু জানতে পড়ে আসুন, শ্রোডিঙ্গার এবং তাঁর সমীকরণ ও বিড়ালের গল্প
কেন প্যারালাল ইউনিভার্সের অস্তিত্ব সম্ভব?
কেন অসংখ্য মহাবিশ্ব (মাল্টিভার্স) অথবা প্যারালাল ইউনিভার্সের অস্তিত্ব সম্ভব এই সম্পর্কে পাঁচটি তত্ত্ব রয়েছে।
১/ Infinite Universes (অসীম মহাবিশ্ব):
বর্তমান প্রযুক্তির ব্যাপক উন্নতির পরেও আমরা ঠিক জানতে পারিনি যে, স্পেস টাইম বা মহাকাশকাল এর আকৃতি ঠিক কেমন। একটি বিশেষ তত্ত্ব বলে, এটি সমতল এবং চিরকাল ধরে চলে, যা আমাদের মহাবিশ্ব ছাড়াও বহু মহাবিশ্বের অস্তিত্বের একটি সম্ভাবনাকে প্রকাশ করে।
২/ Bubble Universes (বুদবুদ মহাবিশ্ব):
টাফটস ইউনিভার্সিটির মহাবিশ্বতত্ত্ববিদ আলেকজান্ডার ভিলেনকিনের গবেষণার ভিত্তিতে প্যারালাল ইউনিভার্সের সম্ভাবনা সম্পর্কে একটি তত্ত্ব উঠে এসেছে যাকে বলা হয় ‘চিরন্তন স্ফীতি’ (Eternal Inflation)। স্পেস টাইম বা মহাকাশকালকে যদি সামগ্রিকভাবে দেখা যায়, তাহলে দেখা যাবে মহাকাশের কিছু অংশের স্ফীতিকরণ বন্ধ হয়ে গেছে এবং কিছু অংশের স্ফীতিকরণ চলছে (বিগ ব্যাং যেমন আমাদের মহাবিশ্বকে স্ফীত করেছে)। যদি আমাদের মহাবিশ্বকে একটি বুদবুদ মনে করি তবে মহাকাশের অসংখ্য বুদবুদের নেটওয়ার্কের মধ্যে আমাদের বুদবুদের মতো মহাবিশ্বটি অবস্থিত। তবে মজার ব্যাপার হলো, যেহেতু আমাদের এই মহাবিশ্বগুলোর মধ্যে কোনো সম্পর্ক নেই তাই এক মহাবিশ্বের পদার্থবিজ্ঞানের সূত্রের সাথে অন্য মহাবিশ্বের পদার্থবিজ্ঞানের সূত্রের মিল নাও থাকতে পারে।
৩/ Daughter Universes (কন্যা মহাবিশ্ব):
প্যারালাল ইউনিভার্স সম্ভবত কন্যা মহাবিশ্বের তত্ত্বের অংশ হিসেবে কোয়ান্টাম বলবিদ্যার তত্ত্বকে অনুসরণ করতে পারে (কীভাবে অতিপারমানবিক কণাগুলো আচরণ করে)। সম্ভাবনার নীতি অনুসরণ করে বলা যায়, আপনার যে কোনো সিদ্ধান্ত থেকে যেকোনো ফলাফল আসতে পারে এবং তার জন্য বিভিন্ন মহাবিশ্বের বিস্তৃতি হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, আপনি এই পৃথিবীতে বার্গার খেতে চিলক্সে গেলেন কিন্তু অন্য পৃথিবীতে সিদ্ধান্ত নিলেন টেক আউটে যাওয়ার; আবার আরেকটি পৃথিবীতে হয়তো রেস্তোরাঁয় যাওয়ার পথে দুর্ঘটনায় পতিত হয়ে যেতে হল হাসপাতালে!
৪/ Mathematical Universes (গাণিতিক মহাবিশ্ব):
গাণিতিক মহাবিশ্ব নিয়ে একটি বিশেষ অনুসন্ধান এমন ব্যাখা দেয় যে, আপনি কোন মহাবিশ্বে বাস করেছেন তার উপর গণিতের কাঠামো নির্ভর করে।
২০১২ সালে ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজির একজন তত্ত্ব-প্রস্তাবক ম্যাক্স টেগমার্ক বলেন,
গাণিতিক কাঠামো এমন একটি ধারণা, যাকে মানবসমাজ ছাড়াই সম্পূর্ণ স্বতন্ত্রভাবে ব্যাখা করা যায়। আমি সত্যিই বিশ্বাস করি, স্বাধীনভাবে এবং শুধুই আমার জন্য, এমন কোনো গাণিতিক মহাবিশ্ব যেমন থাকতে পারে; তেমনি কোনো মানুষ ছাড়াই এর অস্তিত্ব থাকাটাও বিচিত্র কিছু নয়!
৫/ Parallel Universes (সমান্তরাল মহাবিশ্ব):
যেহেতু মহাকাশকাল অথবা স্পেস টাইম সমতল এবং একাধিক মহাবিশ্বের সম্ভাব্য কণার কনফিগারেশনগুলোর সংখ্যা ১০^১০^১২২ স্বতন্ত্র সম্ভাবনার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে সুতরাং, অসীম সংখ্যার কসমিক প্যাচগুলির সাথে তাদের মধ্যে কণার ব্যবস্থার পুনরাবৃত্তি করতে হবে বহুবার। এর অর্থ এখানে অনেকগুলো সমান্তরাল মহাবিশ্ব রয়েছে।
প্যারালাল ইউনিভার্স বিষয়ে স্টিফেন হকিং
বিশ্ববিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং তাঁর মৃত্যুর আগের শেষ গবেষণাটি করেছিলেন মাল্টিভার্স নিয়ে। তাঁর মৃত্যুর কয়েক মাস পরে ২০১৮ সালের মে মাসে এই গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়। দ্য ওয়াশিংটনে প্রকাশিত হওয়া ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটির এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন –
আমরা একটি একক, অনন্য মহাবিশ্বের অংশ নই। কিন্তু আমাদের আবিষ্কারগুলো মাল্টিভার্সের সম্ভাব্যতাকে উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করে ক্ষুদ্র পরিসরের সম্ভাব্য কতগুলো মহাবিশ্বের উপস্থিতির ইঙ্গিত দেয়।
তাছাড়া কিছুদিন আগে নোবেলজয়ী একজন পদার্থবিজ্ঞানী স্যার রজার পেনরোজ বলেছেন, বিগ ব্যাং-এর আগেও একটি মহাবিশ্ব ছিল, যার অস্তিত্বের প্রমাণ এখনো ব্ল্যাক হোলে পাওয়া যায়।
হকিং রেডিয়েশনের পর্যবেক্ষণ থেকে দাবি করা যায় যে, বিগ ব্যাং সবকিছুর শুরু নয়। বিগ ব্যাং এর আগেও কিছু ছিল এবং সেটিই হল আমাদের মহাবিশ্বের ভবিষ্যতের অবস্থা।
প্যারালাল ইউনিভার্সের অস্তিত্ব নিয়ে দ্বিমত:
অনেক বিজ্ঞানী আবার প্যারালাল ইউনিভার্সের তত্ত্বের সাথে একমত নন। এথান সিগাল নামের একজন জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানী ২০১৫ সালে প্রকাশিত এক নিবন্ধে বলেন –
আমি একমত এই ব্যাপারে যে তাত্ত্বিকভাবে স্পেসটাইম চিরকাল ধরে চলতে পারে কিন্তু এই ধারণায় সীমাবদ্ধতা রয়েছে।
আমাদের মহাবিশ্বের বয়স ১৪ বিলিয়ন বছরের কাছাকাছি। সুতরাং মহাবিশ্বের বয়স স্পষ্টতই অসীম নয়, একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ। সহজভাবে বলা যায় এটি কণাগুলোর পুনরায় সাজানোর সম্ভাবনাকে সীমাবদ্ধ করে দেবে। একারণে মাল্টিভার্সের অস্তিত্বের সম্ভাবনা কমে যায়।
সিগাল আরও বলেন,
শুরুতে আমাদের মহাবিশ্বের স্ফীতি ব্যাপকভাবে হয়েছিল; কারণ, তখন মহাকাশের নিজস্ব অন্তর্নিহিত শক্তি অনেক বেশি ছিল। তবে সময়ের সাথে সাথে স্ফীতি হ্রাস পেয়েছে। বিগ ব্যাং এর সময় পদার্থের যে কণাগুলো তৈরি হয়েছিল, সেগুলো এখন আর প্রসারিত হচ্ছে না। এর অর্থ হল মাল্টিভার্সগুলোর স্ফীতির হার এবং স্ফীতির সময় (দীর্ঘ বা সংক্ষিপ্ত) উভয়ই ভিন্ন ভিন্ন। এটা আমাদের মতো অন্যান্য মহাবিশ্বের সম্ভাবনাকে হ্রাস করে।
কল্পকাহিনিতে প্যারালাল ইউনিভার্স
যদি বিজ্ঞানের এতো ব্যাখা কিংবা বাস্তবে প্যারালাল ইউনিভার্স আছে কি নেই এসব নিয়ে মাথাব্যথা না থাকে আর শুধুমাত্র প্যারালাল ইউনিভার্স নিয়ে মুভি আর সিরিজ দেখতে ভালো লাগে, তবে এই তালিকা আপনার জন্য –
- Source Code (2011)
- The Butterfly Effect (2004)
- Mr. Nobody (2009)
- The Chronicles of Narnia (2005)
- Inception (2010)
- Interstellar (2014)
- The Lost Room (2006)
- His Dark Material (2007)
- Midnight in Paris (2011)
- Stranger Things (2016– )
- Travelers (2016–2018)
- Sliding Doors (1998)
- Dark (2017–2020)
- Supernatural (2005–2020)
- Donnie Darko (2001)
তথ্যসূত্র:
ফিচার ছবি সংগ্রহ এবং অলঙ্করণ: লেখিকা
বিজ্ঞানের অজানা বিষয়গুলোকে আরও সহজভাবে তুলে ধরার জন্য ধন্যবাদ!
পরবর্তী লেখা গুলোর অপেক্ষায়🤟❤️