- অ্যাশেজ: ছাইভস্ম থেকে অভিজাত টেস্ট সিরিজ হয়ে ওঠার গল্প - November 4, 2020
- ইউরোপ: ভ্রমণপিপাসুদের জন্য শীর্ষ ৭টি স্থান - October 25, 2020
- পেলে: ফুটবল ইতিহাসে কালজয়ী এক সম্রাটের ইতিকথা (শেষ পর্ব) - October 5, 2020
সম্পূর্ণ খেলোয়াড় হিসেবে একমাত্র একজনকেই দেখেছি, তিনি হচ্ছেন পেলে!
ববি মুর, ইংল্যান্ডের বিশ্বকাপজয়ী ফুটবলার
পেলের প্রথম পর্বে আমরা তাঁর ঊর্ধ্বারোহণ সম্পর্কে জেনেছি। এই পর্বে এই কিংবদন্তির বিশ্বকাপের কিছু গল্পের অঙ্কপাত করবো। সাথে থাকবে ক্লাব ফুটবলে তাঁর দিনগুলো এবং অবসরপরবর্তী জীবনের খুচরোখাচরাও।
বিশ্বকাপে পেলে
১৯৫৮ এর বিশ্বকাপ
মাত্র ১৭ বছর বয়সে ফুটবল বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ হয়ে যায় পেলের। গ্রুপ পর্বে অস্ট্রিয়া এবং সোভিয়েত ইউনিয়নকে হারিয়ে কোয়ার্টারে উঠে পেলের ব্রাজ়িল। কোয়ার্টারে ওয়েলসকে ২-০ ব্যবধানে হারিয়ে সেমিতে পৌঁছতে সক্ষম হয় ব্রাজ়িল। সেই ম্যাচে এক গোল করে ফুটবল ইতিহাসে রেকর্ডের খাতায় নাম লেখায় কালো মানিক খ্যাত এই পেলে। মাত্র (১৭ বছর ২৩৯ দিনে) সর্বকনিষ্ঠ ফুটবলার হিসেবে বিশ্বকাপে গোল করে এই বিরল কৃতিত্ব গড়েন পেলে। এরপর, সেমিতে গিয়েও পেলের বাজিমাত দেখে বিশ্ব। সেমিতে, অসাধারণ হ্যাট্রিক নৈপুণ্যে মাত্র (১৭ বছর ২৪৪ দিনে) আরেকটি রেকর্ডের খাতায় নাম লেখান পেলে। সেই ম্যাচে, পেলের কৃতিত্বে ফ্রান্সকে ৫-২ ব্যবধানে পরাজিত করে ফাইনালে উঠে ব্রাজি়ল। ঠিক তখনি চারদিকে সাড়া পড়ে যায় এবং শুরু হয় পেলেকে নিয়ে জোর গুঞ্জন!
জুন ২৯, ১৯৫৮ সাল। রাসুন্দা স্টেডিয়ামে প্রায় পঞ্চাশ হাজার দর্শকের উপস্থিতি। ফাইনালে ব্রাজ়িল বনাম তখনকার চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী সুইডেন। প্রায় ৩০ বছর পর বিশ্বকাপের স্বপ্ন দেখছে ব্রাজ়িল। এবার পেলেকে নিয়ে সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপান্তরে মরিয়া ব্রাজিল। তবে, নিরাশ করেননি পেলে।
তাঁর অসাধারণ দুটি গোল নৈপুণ্যে ফাইনালে সুইডেনকে ৫-২ গোলে রুখে দেয় ব্রাজ়িল। অবশেষে, স্বপ্নের বিশ্বকাপ ঘরে তুলতে সক্ষম হয় ব্রাজ়িল।
প্রথম বিশ্বকাপে বাজিমাত পেলের। এই আসরে ৬ গোল করে জিতে নেন প্লেয়ার অব দ্য টুর্নামেন্ট। তখনই বিশ্ববাসী দেখে নতুন এক ফুটবল জাদুকরকে।
১৯৬২ এর বিশ্বকাপ
এর পরের বিশ্বকাপ অর্থাৎ ১৯৬২ বিশ্বকাপে পেলের জীবনে নেমে আসে এক ঘোর অমানিশা। গ্রুপ পর্বের ম্যাচে চেকোস্লোভাকিয়ার ডিফেন্ডারের বিধ্বংসী ফাউলের ফলে ইনজুরিতে চলে যান পেলে। যার ফলে পুরো বিশ্বকাপে তাঁকে পাশ বেঞ্চে কাটাতে হয়। কিন্তু, সেই বিশ্বকাপটিও ব্রাজ়িল নিজেদের করে নেয়।
১৯৬৬ এর বিশ্বকাপ
এরপর, ১৯৬৬ ইংল্যান্ড বিশ্বকাপে ব্রাজ়িল ছিল হট ফেভারিট হিসেবে। পেলে, গ্যারিনকা, জালমা সান্তোস, যারজিনহো এবং টোস্টাও মতো অসাধারণ ফুটবলার সেই বিশ্বকাপে ব্রাজ়িলের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেন।
কিন্তু সেই বিশ্বকাপে, বেশিদূর যেতে পারেনি ব্রাজ়িল। গ্রুপ পর্বেই আসর থেকে ছিটকে পড়ে তারা।
প্রথম ম্যাচে বুলগেরিয়ার বিপক্ষে ফ্রি-কিকে গোল করে দলকে জয়ের আসনে নিয়ে যায় পেলে। তবে, সেই ম্যাচে বুলগেরিয়ার রক্ষকের ফাউলে পেলেকে আবার কঠিন চোটে পড়তে হয় এবং সাথে সাথে মাঠ ছাড়তে হয়। যার ফলে, হাঙ্গেরির বিপক্ষে পরবর্তী ম্যাচ থেকে ছিটকে যান পেলে। তবে, সেই ম্যাচে হাঙ্গেরিকে রুখতে পারেনি ব্রাজিল। তবে, শেষ ম্যাচে এক ইউসেবি পর্তুগালের বিপক্ষে চোটে পড়া পেলেকে আবারও মাঠে নামায় কোচ। সেই ম্যাচেও রক্ষা হয়নি পেলের। সেই ম্যাচে এতটাই খেলোয়াড়দের বিশেষ করে পেলেকে ফাউলের সম্মুখীন হতে হয় যে তাকে অসুস্থ হয়ে মাঠ ছাড়তে হয়। পরবর্তীতে, অবসর নেওয়ার ঘোষণা দেন পেলে। তবে, পরবর্তীতে পর্তুগিজ় টিম এ ম্যাচের জন্য ক্ষমাও চেয়েছিল।
১৯৭০ এর বিশ্বকাপ
১৯৭০ বিশ্বকাপে ব্রাজ়িল নবমবারের মতো ফেভারিট হিসেবে বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করে।
১৯৬৪ বিশ্বকাপে যদিও অবসরের ঘোষণা দেন পেলে। তবে, পরবর্তীতে আবারও অবসর কাটিয়ে দুর্দান্তভাবে ফিরে আসেন এই কিংবদন্তি।
মোট ৪টি গোল, ৭ টি অ্যাসিস্ট এবং ফাইনালে ইতালির বিপক্ষে অসাধারণ গোলটি করে বিশ্বকাপ জয়ে অসামান্য ভূমিকা রাখেন।
সেই বিশ্বকাপে, আবারও প্লেয়ার অব দ্য টুর্নামেন্ট নির্বাচিত হন পেলে।
পেলে একমাত্র খেলোয়াড় যে কিনা পরপর চারটি বিশ্বকাপের স্কোরার। মাত্র ১৭ বছর বয়সে বিশ্বকাপ খেলতে এসে বিশ্বকাপ নেওয়াটা অতটা সহজ ছিল না।
ক্লাব ফুটবলে পেলে
সান্তোস ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রের ক্লাব নিউইয়র্ক কসমসের হয়ে খেলেছিলেন কয়েক বছর। ক্লাব ফুটবলে পেলের অবদান ছিল দেখার মতো।
সান্তোসের হয়ে পেলে
পেলে মাত্র ১৫ বছর বয়সে তখনকার ব্রাজিল তথা বিশ্বের অন্যতম নামী ক্লাব সান্তোসের হয়ে খেলার সৌভাগ্য অর্জন করেন।
পেলে ছিল সান্তোসের টপ স্কোরার। সান্তোস ক্লাবের হয়ে ট্রফি জেতেননি পেলে এমনটি কখনও হয়নি। সান্তোসের হয়ে পেলে ৬৫৬ ম্যাচে ৬৪৩ টি গোল করেন।
ট্রপি | সংখ্যা | সাল |
ক্যাম্পিওনেটো ব্রাজিলেরো | ৬ | ১৯৬১, ১৯৬২, ১৯৬৩, ১৯৬৪, ১৯৬৫, ১৯৬৮ |
ক্যাম্পিওনেটো পলিস্তা | ১০ | ১৯৫৮, ১৯৬০, ১৯৬১, ১৯৬২, ১৯৬৪, ১৯৬৫, ১৯৬৭, ১৯৬৮, ১৯৬৯, ১৯৭৩ |
কোপা লিবার্তাদেরেস | ২ | ১৯৬২, ১৯৬৩ |
ইন্টারকন্টিনেন্টাল কাপ | ২ | ১৯৬২, ১৯৬৩ |
ইন্টারকন্টিনেন্টাল সুপার কাপ | ১ | ১৯৬৮ |
নিউইয়র্ক কসমসের হয়ে পেলে
জাতীয় দল থেকে অবসর গ্রহণের পর সান্তোসের হয়ে খেলা চালিয়ে যায় পেলে। পরবর্তীতে ১৯৭৫ সালে ১০ ই জুন রেকর্ড ট্রান্সফার ফিতে (২.৮ মিলিয়ন) উত্তর আমেরিকার ক্লাব নিউইয়র্ক কসমসে যোগদান করে।
পেলে নিউইয়র্ক কসমসের হয়ে ১০৭ টি ম্যাচে ৬৪ টি গোল করেন এবং দুটি ট্রফি জয়ে ভূমিকা রাখে।
ট্রফি | সংখ্যা | সাল |
উত্তর আমেরিকান সকার লিগ আটলান্টিক কনফারেন্স | ১ | ১৯৭৭ |
উত্তর আমেরিকান সকার লিগ সকার বল | ১ | ১৯৭৭ |
অবসর গ্রহণের পর পেলে, অজানা কিছু উদ্যোগ এবং কৃতিত্ব
পেলে, প্রধানত বাবার পরামর্শ অনুযায়ী ১৯৭১ সালে অর্থাৎ তৃতীয় বিশ্বকাপ জয়ের এক বছর পর জাতীয় দল থেকে অবসর নিয়েছিলেন। তবে, পরবর্তীতে নিউইয়র্কে কসমসের সাথে মিলিয়ন ডলারের চুক্তিবদ্ধ হয়। ১৯৭৭ সালে স্থায়ীভাবে ফুটবল থেকে অবসর নেন ফুটবলের এই সম্রাট।
অবসরের পরেও পেলের খ্যাতি, অবদান কোনোটিরই কমতি হয়নি।
- ১৯৭৭ সালের ১লা অক্টোবর সান্তোস এফসি এবং নিউইয়র্ক কসমসের হয়ে একটি প্রদর্শনী ম্যাচের মাধ্যমে পেলে ফুটবল থেকে পুরোপুরি অবসর গ্রহণ করেন। সেই ম্যাচে নিউইয়র্ক কসমসের হয়ে প্রথমার্ধ এবং সান্তোসের হয়ে দ্বিতীয়ার্ধ খেলেন পেলে।
- ১৯৭৮ সালে পেলে আন্তর্জাতিক শান্তি পুরস্কার লাভ করেন।
- ১৯৯৩ সালে পেলেকে মার্কিন ন্যাশনাল সকার হল অফ ফেমে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
- পেলে, ১৯৯৫ সালে “ব্রাজিলের ক্রীড়ামন্ত্রী” হিসেবে নিয়োগ পায় এবং ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করে।
- ১৯৯৭ সালে সম্মানজনক ব্রিটিশ “নাইটহুড উপাধিতে” ভূষিত করা
- ১৯৯৯ সালে আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি (IOC) আয়োজিত ভোটে শতকের “সেরা অ্যাথলেট” হিসেবে নির্বাচিত হয় পেলে।
- ফিফা ২০০০ সালে পেলে এবং ম্যারাডোনাকে শতকের সেরা খেলোয়াড় হিসেবে অভিহিত করে।
- ২০০৫ সালে পেলেকে বিবিসি “পার্সোনালিটি অব দ্য ইয়ার” নামক এই কৃতিত্ব প্রদান করে।
- ২০০৬ সালে পেলে বিবিসির “স্পোর্টসম্যান অফ দ্য সেঞ্চুরি” এর দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছিলো। প্রথম হয়েছিলেন বিশ্ববিখ্যাত বক্সার মোহাম্মদ আলি।
- ২০১০ সালের পহেলা আগস্ট তাঁর পুরনো ক্লাব নিউইয়র্ক কসমসের “প্রেসিডেন্ট” নির্বাচিত হয়েছিলেন।
- ব্রাজ়িলীয় ফুটবল ক্লাব সান্তোস পেলের সাথে আজীবন চুক্তি করে।
- ২০১৮ সালের ১৩ ই সেপ্টেম্বর “দ্য পেলে” নামক একটি দাতব্য সংস্থা চালু করে। যেখানে, দারিদ্রপীড়িত অসহায়, দুস্থ শিশুদের শিক্ষা এবং অন্যান্য সেবামূলক কার্যক্রমে সর্বদা পাশে থাকবে।
পেলের জানা-অজানা অনেক কৃতিত্ব অর্জন করেছিলেন ফুটবল থেকে অবসর নেওয়ার পর।
শেষকথা
পেলে, ফুটবল খেলার অনন্য এক দৃষ্টান্ত। এমন কোনো রেকর্ড নেই যা তিনি করেননি। খেলাধুলা ছাড়া অন্যান্য কাজে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। তিনি তাঁর বেতনের অর্থ অনেক দাতব্য কাজে বিলি করেছেন। এছাড়াও তাঁর জনপ্রিয়তা ছিল আকাশচুম্বী। একবার, পেলে নাইজেরিয়া খেলতে আসবেন শুনে সেখানকার যুদ্ধে লিপ্ত দলগুলো কয়েক ঘণ্টা যুদ্ধ বন্ধের ঘোষণা দেয় শুধু তাঁকে দেখার জন্য।
তবে পেলে সম্পর্কে সবচেয়ে মনোমুগ্ধকর কথাটি বলেছেন হাঙ্গেরিয়ান লিজেন্ড ফেরেঙ্ক পুসকাস। তাঁর মতে,
সর্বকালের সেরা খেলোয়াড় হচ্ছেন আলফ্রেডো ডি স্টেফেনো। আমি পেলেকে এই তালিকার বাইরে রাখছি। কারণ, তিনি এসবের ঊর্ধ্বে।
ফিচার ছবি: Wikimedia Commons
তথ্যসূত্র: