- অ্যাশেজ: ছাইভস্ম থেকে অভিজাত টেস্ট সিরিজ হয়ে ওঠার গল্প - November 4, 2020
- ইউরোপ: ভ্রমণপিপাসুদের জন্য শীর্ষ ৭টি স্থান - October 25, 2020
- পেলে: ফুটবল ইতিহাসে কালজয়ী এক সম্রাটের ইতিকথা (শেষ পর্ব) - October 5, 2020
“ফুটবল” নামটি যতটা পরিচিত পুরো বিশ্বে, “পেলে” নামটি ঠিক ততটাই বোধহয় পরিচিত! আর, হবেই না বা কেন? ফুটবল যদি হয় গহীন কোনো বন, তাহলে সেই বনের রাজার আসনে অধিষ্ঠিত হয়ে আছেন পেলে। ফুটবল নামটির সাথে পরিচিত কিন্তু পেলেকে চিনেন না, এমন মানুষ বোধহয় পৃথিবীতে খুঁজে পাওয়া রীতিমতো দুষ্কর। কারণ, ফুটবল মানেই পেলে আর পেলে মানেই ফুটবল! আঠারো-উনিশ শতকে এমন মহাতারকা আর যে দেখেনি বিশ্ব। হয়তো তার সমান্তরাল প্রতিভার অধিকারী গুটিকয়েক ফুটবলার দেখেছেন ফুটবলপ্রেমীরা, তবে তার খ্যাতি ও দক্ষতাকে ছাড়িয়ে গেছে এমন ফুটবলার আদৌ দেখেনি বিশ্ব। সর্বকালের সেরা দশ ফুটবলারের তালিকায় প্রথম স্থানটি যে পেলের জন্য বরাদ্দ, সেটা না মানার অবকাশ নেই। প্রথম স্থানটি নিয়ে সকল কিংবদন্তি কোচ, ফুটবলার, বিশ্লেষক, সাংবাদিক সবাই এককাট্টা! দ্বিতীয় থেকে দশম পর্যন্ত স্থানটি পরিবর্তনযোগ্য। এখন প্রশ্ন হতে পারে, পেলে যদি হয় ফুটবলের মহাতারকা তাহলে ম্যারাডোনা কী? পেলে হলো ফুটবলের সম্রাট আর ম্যারাডোনা ফুটবলের জাদুুকর। একবার তো এক সংবাদমাধ্যমে পেলে নিজের গুণকীর্তন করতে গিয়ে বলেই ফেললেন,
এখনকার সময়ে যদি আমি খেলার সুযোগ পেতাম, তাহলে ২০০০ গোলের মাইলফলক ছুঁতে পারতাম।
“কালো মানিক” খ্যাত এই ফুটবলার সবরকম রেকর্ড ছুঁয়ে গেছেন এবং নিজেকে নিয়ে গিয়েছেন অনন্য এক আসনে।
আজকের আলোচনা তাঁর এই কিংবদন্তি হওয়ার পথের যাত্রার প্রারম্ভেই সীমাবদ্ধ থাকবে।
পেলের পরিচিতি
৩রা অক্টোবর, ১৯৪০ সালে ব্রাজিলের মিনাস গেরেইসের ট্রেস কোরাগায়েস শহরে অত্যন্ত দরিদ্র পরিবারে ফুটবলের এই জাদুকর জন্মগ্রহণ করেন। তার পুরো নাম ছিলো এডসন অ্যারান্তেস দে ন্যাসিমেন্টো। বিখ্যাত বিজ্ঞানী টমাস আলভা এডিসনের নামের সাথে মিল রেখে বাবা-মা এই নামটি রাখেন। তবে, সবাই তাকে ডিকো বলেই ডাকতো।
বাবা জোয়া রামোস ছিলেন একজন ফুটবলপ্রেমী এবং সাবেক ফুটবলার। তবে বারবার ইনজুরিজনিত কারণে বড় কোন মঞ্চে খেলার সুযোগ হয়নি তার। বাবার দেখাদেখি পেলের ফুটবলের প্রতি ভালোবাসা জন্মে। তবে ,ছোটবেলায় অভাব-অনটনের কারণে ফুটবলের মুখ দেখার সৌভাগ্য হয়নি তাঁর।
পেলের বয়স যখন ছয় বছর, তখন তাঁর বাবা-মা ব্রাজিলের বৃহত্তর শহর বাউরুতে চলে আসে। আর্থিক দৈন্যতার জন্য শিক্ষাজীবন সমাপ্ত করতে পারেননি পেলে। এতটাই আর্থিক দুরবস্থায় ছিলো তাদের পরিবার যে, মাঝেমাঝে তাঁকে চায়ের দোকানে, রেললাইনে কিংবা মুচির কাজ করতে হতো।
এই বস্তিতে বেড়ে উঠা ছেলেটিই একসময় জাতীয় দলের হয়ে তিনটি বিশ্বকাপ জয়ে ভূমিকা রাখে। এছাড়া, সান্তোস এবং নিউইয়র্ক কসমসের মতো ক্লাবের হয়ে অসাধারণ সব রেকর্ডের জন্ম তাঁর হাত ধরেই।
আরও পড়ুন: মেসি নাকি রোনালদো, শ্রেষ্ঠত্বের প্রতিযোগিতায় কে এগিয়ে?
দরিদ্র পরিবার থেকে ফুটবল আঙ্গিনায় উঠে আসার গল্প
অতি হতদরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন পেলে। ছোটবেলা থেকে এতটাই দরিদ্র ছিলেন যে, ফুটবল কেনার সামর্থ্য না থাকার কারণে মোজার ভিতরে কাগজ ভর্তি করে তাঁকে ফুটবল হিসেবে ব্যবহার করতে হত। ফুটবলের প্রতি তাঁর এতটাই ঝোঁক ছিল যে, চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ার সময় ফুটবল খেলার কারণে প্রধান শিক্ষক তাঁকে বিদ্যালয় থেকে বরখাস্ত করেন। তবে, পরবর্তীতে বিধাতা তাঁর প্রতি সহায় হন। তাঁর বয়স যখন ১১, তখনকার সময়ের ব্রাজিলের অন্যতম গ্রেট খেলোয়াড় ডি ব্রিটোর নজরে আসেন তিনি। পরবর্তীতে, তার অধীনে প্রশিক্ষণ নেওয়ার সুযোগ হয় পেলের। প্রশিক্ষণ নেবার কিছুদিন পর, স্থানীয় ক্লাব বাকুইনহোতে সুযোগ পান পেলে এবং প্রথম ইউনিফর্ম গায়ে দেবার সৌভাগ্য হয়। এতে পেলে এতটাই আনন্দে আত্নহারা হয়ে উঠেন এই ভেবে যে, সে নিজের বাবার মতই একজন সত্যিকারের ফুটবলার হতে যাচ্ছে!
ঠিকই মাত্র ১৫ বছর বয়সে ব্রাজিলের গ্রেট ফুটবলার ডি ব্রিটো তাঁকে সে সময়কার বিশ্বের অন্যতম সেরা ক্লাব সান্তোসের পরিচালকের কাছে নিয়ে যান এবং আত্মবিশ্বাসের সাথে সেদিন বলেছিলেন যে,
এই ছেলেটি একদিন বিশ্বের সেরা খেলোয়াড় হবে!
বস্তুতই তার কথা সত্যি হয়ে উঠল, ঐ বছরই পেলে সান্তোসের ‘বি’ টিমে সুযোগ পেয়ে যান এবং ঠিক পরের বছরই সান্তোসের মূল দলে তাঁর জায়গা হয়ে যায়।


এরপর থেকে তাঁকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয় নি! খুব অল্পসময়ের মধ্যে ব্রাজিলের জাতীয় দলে জায়গা পেয়ে যান এবং অল্প বয়সে অসাধারণ কীর্তি গড়তে সক্ষম হন।
তবে সবচেয়ে মজার তথ্য হলো, পেলে নামটা মূলত তাঁর ছিল না। একটা রূপকথার গল্পের মতো নামটি তাঁর সাথে জুড়ে যায়। তাই আমরা রহস্যজনক নামটির পিছনের গল্প জানবো।
পেলে নামটির নেপথ্যের গল্প
ডিকো নামে বেড়ে উঠা ছেলেটি একসময় পেলে নামে পুরো বিশ্বে পরিচিত হয়ে যায়। তবে, নামটির পেছনের প্রেক্ষাপট বেশ চমৎকার।
ব্রাজিলিয়ানরা মূলত ডাকনামে ডাকতে অধিক পছন্দ করে। যে কারণে, এডসন অ্যারান্তেস দে ন্যাসিম্যান্টো থেকে তার মা তাকে ডিকো নামে ডাকতো। পেলের বয়স যখন তিন কিংবা চার, তখন তার বাবা তাঁকে ভাস্কো প্রশিক্ষণ সেশনে সাথে নিয়ে যেতেন। ফলশ্রুতিতে সেখানে মাঝেমাঝে ফুটবল খেলা দেখা এবং খেলার সুযোগ হতো তাঁর । সেই প্রশিক্ষণকেন্দ্রে তার বাবার সহকর্মী ছিলেন। তিনি ভাস্কো ডি সাও লরেনকোর হয়ে খেলতেন। তাঁর আসল নাম ছিল জোস লিনো কিন্তু স্বভাবগত কারণে তিনি ‘বিলে’ নামে পরিচিত ছিলেন।
যখনই পেলে যেকোন শর্ট দুর্দান্ত ভাবে ফিরিয়ে দিতেন, তখনই নিজে নিজে চিৎকার করে বলতেন ‘গুড সেভ বিলে’! খুব ছোট হওয়ার কারণে একবার সেখানে বলেছিলেন, আমি পিলির মত গোলকিপার হতে চাই। এই কথাটি তাঁর বন্ধুরা শুনে ফেলে। পরবর্তীতে যখন বাউরুতে চলে আসেন, তখন নামটি কথাচ্ছলে পরিবর্তিত হয়ে পেলে হয়ে যায়। এরও একটি কারণ ছিল, পেলের মতে বাউরুতে সবাই তাঁর কথার বিপরীতটিই বুঝতো।
এতে প্রথমে তাঁর খুব খারাপ লাগতো। কারণ, তাঁর কাছে এডসন নামটি গর্ব করার মতো ছিলো। এজন্য তিনি পেলে নামটি শুনলে রেগে যেতেন। সেসময় তাঁর কাছে নামটি এতটাই খারাপ লেগেছিল যে, একটা সময় তাঁর এক সহপাঠীকে ঘুষি মেরেছিলেন পেলে নামে ডাকার কারণে। এজন্য, পরবর্তীতে তাকে দুদিনের জন্য ক্লাস থেকে বরখাস্ত হতে হয়েছিল।
তবে, পরবর্তীতে যখন পেলে নামটি চারদিকে সাড়া পেতে শুরু করে তখন পেলে তার নামটি অধিক আনন্দের সাথে উপভোগ করতেন।
আন্তর্জাতিক ফুটবলে পেলে
পেলের আন্তর্জাতিক ফুটবলে অভিষেক হয় মাত্র ১৬ বছর বয়সে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী আর্জেন্টিনার বিপক্ষে রিও ডি জেনোরিওতে। প্রথম ম্যাচে তাঁর দল ব্রাজিল ২-১ ব্যবধানে হারলেও পেলে প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচে গোল করে এক বিরল রেকর্ড করে বসেন। মাত্র ১৬ বছর ৯ মাস বয়সে সর্বকনিষ্ঠ ফুটবলার হিসেবে আন্তর্জাতিক ফুটবলে গোল করার কীর্তি গড়েন পেলে। এরপর, তাঁকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। তাঁর অসাধারণ ফুটবল দক্ষতা দিয়ে ক্যারিয়ারে নিজেকে এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছতে সক্ষম হন। পুরো ক্যারিয়ারে পেলে ১৩৬৩ ম্যাচে ১২৮৯ টি গোল করার রেকর্ড গড়েন। যা এখন পর্যন্ত ফুটবল বিশ্বে একক ফুটবলার হিসেবে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক গোলের মাইলফলক। এর মাধ্যমে পেলে গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে নাম লিখান। তবে, RSSSF এর রিপোর্ট অনুযায়ী পেলের মোট অফিসিয়াল গোল সংখ্যা ৮৩১ ম্যাচে ৭৬৭ টি। বাকিগুলো সব আনঅফিসিয়াল।
এছাড়া, জাতীয় দলে ৯২ টি ম্যাচে ৭৭ টি গোল করার রেকর্ড গড়েন পেলে। যা দক্ষিণ আমেরিকার একক ফুটবলার হিসেবে জাতীয় দলের হয়ে সর্বোচ্চ গোলের রেকর্ড। পেলে তার ফুটবল ক্যারিয়ারে (ক্লাব এবং জাতীয় দল মিলিয়ে) ৯২ টি হ্যাটট্রিক, ৩১ বার চারটি, ৬ বার পাঁচটি এবং ১ বার আটটি গোলের মাইলফলক স্পর্শ করেন।
পেলের যুগে ইউরোপিয়ান নয়, এমন খেলোয়াড়দের ব্যালন ডি’অর দেওয়ার কোন নিয়ম ছিলনা। তবে, ২০১৬ সালে ফিফা এবং ফ্রান্স ফুটবল নতুন একটি উদ্যোগ নেয়। ১৯৯৫ সালের আগে নন-ইউরোপিয়ান খেলোয়াড়দের বিবেচনায় এনে ব্যালন ডি’অরের তালিকা প্রকাশ করা হয় । সেখানে মোট ৩৯ টি ব্যালন ডি’অরের ১২ টি পরিবর্তন হয়। সেখানে পেলেকে ১৯৫৮, ১৯৫৯, ১৯৬০, ১৯৬১, ১৯৬৩, ১৯৬৪ এবং ১৯৭০ এর ব্যালন ডি’অর জয়ী ঘোষণা করা হয়। পেলে ছাড়াও সেখানে পূর্ববর্তী অন্য খেলোয়াড়দের নাম ছিল।
ফুটবল ক্যারিয়ারে পেলে সবচেয়ে বেশি সাড়া জাগিয়েছিলেন ব্রাজিলের হয়ে তিনটি বিশ্বকাপ জয়ের কীর্তি গড়ার পর। ১৯৩০ সালের পর থেকে ব্রাজিল পরবর্তী ২৪ বছর পর্যন্ত ফেবারিট হয়েও বিশ্বকাপ জিততে পারেনি। পরবর্তীতে পেলের সময়কালে তিনটি বিশ্বকাপ অর্জন করতে সক্ষম হয়, যা এখন পর্যন্ত একক ফুটবলার হিসেবে সর্বোচ্চ বিশ্বকাপ জয়ের মাইলফলক।


বিশ্বকাপ ফুটবল আসর | খেলোয়াড় হিসেবে পেলের সর্বোচ্চ অর্জন |
১৯৫৮ বিশ্বকাপ | বিশ্বকাপ ট্রফি |
১৯৬২ বিশ্বকাপ | বিশ্বকাপ ট্রফি |
১৯৭০ বিশ্বকাপ | বিশ্বকাপ ট্রফি |
পরের পর্বে পেলের বিশ্বকাপ জয়ের গল্প, ক্লাবের হয়ে তাঁর অবদান, ট্রফি জয় এবং অবসর গ্রহণের পর কম আলোচিত কিছু অর্জন সম্পর্কে আলোচনা করা হবে।
… … …
(চলবে)
ফিচার ছবিসূত্র – Wallpaper Access
তথ্যসুত্র:
পড়ে ভালো লাগলো,,
পড়ার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ! ❣