- দ্য স্পাই ইন ইয়োর ফোন: এনএসও কর্তৃক তথ্যের বিপজ্জনক ব্যবহার - January 22, 2021
- এক পৃথিবী, এক রাষ্ট্র: বাস্তব নাকি কেবলই ধূসর কল্পনা - January 18, 2021
- সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়: বাংলা চলচ্চিত্রের মুকুটহীন মহারাজ (তৃতীয় পর্ব) - December 27, 2020
ভারত আমাদের ডাকছে, রক্ত দিয়ে রক্তকে ডাকছে, আর সময় নেই অস্ত্র তোলো, হয় আমরা শত্রুসেনাদের মাঝে দিয়ে আমাদের বিজয়ের পথ অঙ্কন করবো, অথবা ঈশ্বর চাইলে শহিদের মৃত্যু বরণ করে নেব আমরা।
নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু
নেতাজি হলেন সেই সিংহপুরুষ, যার মুখ দিয়ে উচ্চারিত হয়েছিল ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে নিজ দেশবাসীর প্রতি সেই গর্জন ‘চলো দিল্লি, দিল্লি চলো’। তিনি অবিভক্ত ভারতবর্ষের সর্বাধিক জনপ্রিয় বিপ্লবী নেতা, সকলের পরম শ্রদ্ধেয় নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। আজন্ম বিপ্লবী চেতনার এই মহান বীরের জন্ম হয়েছিল যে এই বাংলায়, তা প্রত্যেক বাঙালির জন্য গর্বের, গৌরবের।
নেতাজি ও ২৯ এপ্রিল, ১৯৩৯
কংগ্রেসের হেডকোয়ার্টারের একপ্রান্তের একটি রুমে বাপু মহাত্মা গান্ধী এবং জওহরলাল নেহেরু বসে আছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তাদের অবস্থান কীরূপ হওয়া উচিত, তা নিয়ে কথা বলছিলেন তাঁরা দুইজন। এমন সময়ে সেই কক্ষে প্রবেশ করলেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু।
কিছুদিন আগেই দলের প্রেসিডেন্ট হিসেবে পুনঃনির্বাচিত হওয়ার জন্য মহাত্মা গান্ধী এবং জওহরলাল নেহেরু উভয়েই নেতাজিকে শুভেচ্ছা জানালেন। কিন্তু ভেতরে ভেতরে অন্তর্দ্বন্দ্ব ঠিকই চলছিল নেতাজি এবং গান্ধিজির মধ্যে। কেননা তার পূর্ববর্তী প্রেসিডেন্সিতে তিনি গান্ধিজির অহিংসা আন্দোলনের পরিবর্তে কংগ্রেসকে একটি উপনিবেশবাদ বিরোধী দল হিসেবে পরিচালনা করেছিলেন। যা প্রকারান্তরে তাঁর নিজের প্রস্তাবিত অসহযোগ আন্দোলনেরই প্রতিচ্ছবি। আর জওহরলাল নেহেরুও গান্ধিজির পক্ষ নেওয়ার কারণে তাঁর সাথেও নেতাজির দূরত্ব বেড়ে চলেছিল। ১৯৩৯ সালের কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় গান্ধিজি সমর্থন করেছিলেন পট্টভি সীতারমণকে। কিন্তু দক্ষিণ ভারতের প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ মুথুরামালিঙ্গম থেভার এর সমর্থন ছিল নেতাজির অসহযোগ আন্দোলনের প্রতি। তাই তাঁর প্রত্যক্ষ সমর্থনে নেতাজি দক্ষিণ ভারত থেকে নিরঙ্কুশ ভোট পান, পাশাপাশি সম্পূর্ণ বঙ্গপ্রদেশের সমর্থন ছিল নেতাজির প্রতি। তাই বিপুল ভোটের ব্যবধানে তিনি বিজয়ী হন। তাই এই বিশেষ একান্ত আলোচনাসভায় তিনজনই বেশ বিব্রতবোধ করছিলেন। সব মিলিয়ে আলোচনা শুরু হলো।
ভারতীয় সেনাদের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণের ঘোর বিরোধী ছিলেন নেতাজি। তিনি কোনোভাবেই সৈন্যদের এই মহাযুদ্ধে ঠেলে দিতে রাজি নন।
বরং তাঁর মতামত হলো, ভারতীয় সৈনিকেরা কেবল তাদের মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্যই লড়াই করবে। অন্যদিকে গান্ধিজির মতামত হলো, যদি ভারতীয় সেনারা ব্রিটিশদের এই দুঃসময়ে তাদের সাহায্য করে, তবে অবশ্যই ইংরেজ সরকার তাদের স্বাধীনতার ব্যাপারে চিন্তা করবে। তখন নেতাজি গান্ধিজির উদ্দেশ্যে বললেন ,
স্বাধীনতা কোনো ভিক্ষালব্ধ জিনিস নয়, স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনতে হয়।
সবমিলিয়ে নেতাজি এবং গান্ধিজির মনোমালিন্য চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গেলো। তাই তাঁদের মধ্যেকার এই বিরোধ যাতে আর না বাড়ে, তাই নেতাজি তাঁর প্রেসিডেন্ট পদ থেকে পদত্যাগ করলেন এবং গান্ধিজির থেকে আশীর্বাদ নিয়ে বললেন যে, তাদের উভয়ের জীবনের মূল লক্ষ্য ভারতের স্বাধীনতা অর্জন কিন্তু রাস্তা ভিন্ন। নিশ্চয়ই তারা স্বাধীন ভারতে আবার মিলিত হবেন। এই বলে তিনি বের হয়ে গেলেন, কেবল কংগ্রেসের সেই কক্ষ থেকে বা কংগ্রেস থেকে নয়; বরং গান্ধিজির আরোপিত আদর্শের কারণে তার নিজের আদর্শের বাস্তবায়নে তার যে বাঁধা ছিল, তা থেকেও বের হয়ে গেলেন।
নেতাজি ও ২৯ মে, ১৯৪২
নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু কিছুটা উদ্বিগ্ন এবং চিন্তিত। বহু চেষ্টা করে হিটলার এর সাথে এই সাক্ষাতের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এটিই বর্তমান অবস্থায় একমাত্র সুযোগ অক্ষশক্তি এর সাথে সন্ধি করার।তবে এখন পর্যন্ত জার্মানদের মনোভাব ভালোই মনে হচ্ছে। তাদের আর্থিক এবং কারিগরি সহযোগিতায় আজাদ হিন্দ রেডিও প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে যা বর্তমানে বহির্বিশ্বে তাঁর কার্যক্রমের প্রচারণার একমাত্র উপায়। তাছাড়া এখন পর্যন্ত জাপানের থেকে কোনো সদুত্তর আসে নি যাতে করে এরুপ বোঝা যায় যে, তারা তাদের উভয়ের কমন শত্রু ব্রিটিশের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লড়তে প্রস্তুত। বড় আশা করে তিনি জার্মানি ছুটে এসেছেন যাতে করে তিনি হিটলারের কাছ থেকে সৈন্য সংগ্রহ করে নিজের সেনাবাহিনী প্রস্তুত করতে পারেন।
হিটলারের সাথে আলোচনা সব মিলিয়ে ফলপ্রসূ হিসেবে প্রমাণিত হয়। যুদ্ধবন্দী হিসেবে আটককৃত প্রায় ৪০০০ জনকে হিটলার নেতাজির অধীনে সমর্পণ করেন। নেতাজি এবং হিটলারের মধ্যে চুক্তি সাক্ষরিত হয় যাতে নেতাজি হিটলারকে ভারতীয় সৈন্যদের (যারা পূর্বে ছিল ব্রিটিশ ভারতীয় সৈন্য এবং বর্তমানে জার্মানদের হাতে যুদ্ধবন্দি) সর্বাধিনায়ক হিসেবে মেনে নেন এবং নেতাজি নিজেকে তাদের অধিনায়ক হিসেবে স্বীকৃতি দেন। এর ফলে, ১৯৪১ সাল থেকে জার্মানিতে তাঁর অবস্থান অর্থপূর্ণ হয়ে উঠলো। এখানে প্রাপ্ত ৪০০০ সৈন্য এবং তাঁর সাথে পূর্বে থেকে অবস্থানকারী আরো কিছু মানুষ মিলে সব মিলিয়ে প্রায় ৪৫০০ জনের প্রথম সেনাবাহিনী গঠন করেন যা ছিল ভারতের নিজস্ব প্রথম সেনাবাহিনী; ইতিহাসে যার নাম ছিল আইএনএ, যার পূর্ণরূপ ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি এবং সাধারণভাবে তা আজাদ হিন্দ ফৌজ নামে পরিচিত।
নেতাজি ও ২১ অক্টোবর,১৯৪৩
আজ নেতাজির জীবনের অনেক বড় আনন্দের দিন। এতদিন পর্যন্ত তাঁর হাতে ছিল কেবল এক সেনাবাহিনী, কিন্তু ছিল না নিজস্ব কোনো রাষ্ট্র। আজ সেই অভাবও মিটে গেলো। আনুষ্ঠানিকভাবে এই রাষ্ট্রের নাম আর্জি হুকুমত আজাদ এ হিন্দ যা সংক্ষেপে আজাদ এ হিন্দ নামে পরিচিত হবে।
আর সেই রাষ্ট্রের মূল ভূখণ্ড হলো এতদিন পর্যন্ত জাপান অধিকৃত আন্দামান এবং নিকোবোর দ্বীপপুঞ্জ। এই শুভক্ষণে এতদিন পর্যন্ত ভারতমাতার জন্য প্রাণ উৎসর্গকারী সকল শহিদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা রেখে তিনি আন্দামান দ্বীপের নাম রাখলেন শহিদ দ্বীপ এবং নিকোবোর দ্বীপের নাম রাখলেন স্বরাজ দ্বীপ। তাঁর এই রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রি এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রি তিনি নিজেই। সুব্বিয়ার আপ্পাদুরাই আইয়ার নিযুক্ত হলেন প্রচারণামন্ত্রি হিসেবে। সেই ১৯৪০ সাল থেকেই নেতাজির সাথে আছেন তিনি। ৪ বছর ধরে তিনি আজাদ হিন্দ রেডিওর মুখ্য ব্যবস্থাপক হিসেবে কর্মরত আছেন। নেতাজির এই সরকারের মূলমন্ত্র হলো ইত্তেহাদ, ইতমাদ অউর কুরবানি; উর্দু এই শব্দবন্ধের বাংলা অর্থ হলো ঐক্য, বিশ্বাস এবং আত্মত্যাগ।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ভারত ভাগ্য বিধাতা গান তাঁর অসম্ভব পছন্দের। কিন্তু এই গানটি বাংলা ভাষায় লিখিত আর তার অধিকাংশ সেনা এবং মন্ত্রিপরিষদের সদস্যরা অবাঙালি। তাদের সবাই নিজের মাতৃভাষা ছাড়াও হিন্দি ভাষায় পারদর্শী। তাই তিনি আজাদ হিন্দ ফৌজ এর অফিসার আবিদ হাসান কে নির্দেশ করেন যাতে তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ভারত ভাগ্য বিধাতা এর অনুকরণে একটি সঙ্গীত রচনা করেন। ক্যাপ্টেন আবিদ হাসান তখন শুভ সুখ চ্যায়ন নামের সঙ্গীত রচনা করেন, এটিই আজাদ হিন্দ এর জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে পরিচিত হবে। এছাড়াও আজাদ হিন্দ সরকারের পক্ষ থেকে ডাকটিকেট ইস্যু করা হবে।
আজ আনুষ্ঠানিকভাবে আজাদ হিন্দ ফৌজের সেনারা শপথ নিবে মাতৃভূমির উদ্দেশ্যে জান-প্রাণ দিয়ে লড়বার।
নেতাজি ও ১১ জুলাই, ১৯৪৪
সর্বশেষ মোঘল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর এর কবর, রেঙ্গুন। সম্রাটের সৌভাগ্য হয়নি নিজের ভূমিতে দাফন হওয়ার। নিজেই লিখেছিলেন সেই কষ্টের কথা এভাবে ফারসিতেঃ
কিতনে হ্যাঁয় বদনসিব জাফর, দাফনকে লিয়ে;
দো গজ জমিন ভি নেহি মিলি, কু এ ইয়ার মে।
বাংলায় যার অর্থ হলো –
কত বড় দুর্ভাগ্য এই জাফরের দাফন হওয়ার জন্য যে,
নিজের মাতৃভূমিতে সে সাড়ে তিন হাত জমিও পেলো না
ভারতের সম্মিলিত সর্বশেষ আন্দোলন ছিল সিপাহি বিপ্লব, তাতে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর। ব্রিটিশদের কাছে সেই অপরাধের জন্য তিনি নির্বাসনের সাজা পান। চলে যেতে হয় নিজের আবাসস্থল লালকেল্লা, নিজের শহর দিল্লি ছেড়ে বহুদূরে বার্মার রেঙ্গুনে। সেখানেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ তাকে দিল্লিতে দাফন করার অনুমতি পর্যন্ত দেয়নি। ১৮৫৭ এর সিপাহি বিদ্রোহের পর থেকে ভারতবাসীকে ব্রিটিশরা দমবন্ধ অবস্থায় রেখেছিল। তাই, আজ যখন ১৯৪৪ সালের এই শুভদিনে তিনি যখন তাঁর সৈন্যবাহিনী নিয়ে ভারতবর্ষের প্রিয় ভূমিতে পদার্পণ করতে যাচ্ছেন, তিনি তাঁর সৈন্যবাহিনী এবং মন্ত্রিসভার সদস্যদের নিয়ে সাথে সাথে হাজির হয়েছেন সিপাহি বিপ্লবের সেই মহান সিংহপুরুষের সমাধিতে শ্রদ্ধা জানাতে। সেখানে দাঁড়িয়ে তিনি শপথ নেন-
যদি মানুষ হই, তবে ব্রিটিশদের হাতে অকথ্যভাবে নির্যাতিত বীরদের অকালমৃত্যুর প্রতিশোধ মোরা নেবোই। যে ব্রিটিশ আমাদের স্বাধীনতাকামী বীরদের রক্তপাত ঘটিয়েছে, তাদের উপরে অমানুষিক অত্যাচার চালিয়েছে, সেই ব্রিটিশকে তার ঋণ পরিশোধ করতেই হবে। (১)
নেতাজি ও ১১আগস্ট, ১৯৪৫
আগের দিন রাত ১০ টায় নেতাজি খবর পেয়েছেন যে নাগাসাকি শহর ৯ তারিখ আক্রান্ত হয়েছে। ইতোপূর্বেই ৬ তারিখ হিরোশিমা শহর আক্রান্ত হয়েছে। কিন্তু আজ মধ্যরাতের পর থেকেই তাঁর কাছে বেশ কিছু ফোন আসছে। কেউই তাকে ফোনে কোনো ব্যাপারেই বিস্তারিত বলছেন না। বরং বলছেন যে, তারা বিস্তারিত কথা সাক্ষাতে বলবেন। নেতাজি কিছুটা উদ্বিগ্ন বোধ করছেন। সবার প্রথমে ফোন আসলো মেজর জেনারেল এম. জেড. কিয়ানি থেকে। তিনি ফোন করে জানালেন যে, জাপানের সাথে থাকা অনাক্রমণ চুক্তি ভঙ্গ করে রাশিয়া জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে।
তারপরেই ডঃ লক্ষণাইয়া এবং শ্রীগণপতি এর ফোন। তারা এই রাতের মাঝেই আসতে চান নেতাজির কাছে। কারণ জিজ্ঞেস করা হলে, কেউই কিছু বলতে চাইছেন না। দুইজনেরই মতামত হলো, তারা সাক্ষাতে নেতাজিকে বিস্তারিত বলবেন। নেতাজিও পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুধাবন করে তাদের আসার অনুমতি দিলেন। রাত ৪টার দিকেই তারা নেতাজির কাছে এসে পৌঁছালেন। তাদের কাছ থেকে নেতাজি বজ্রপাতের মত শুনলেন সেই অশুভ সংবাদ,
জাপান আত্মসমর্পণের জন্য তৈরি, যেকোনো মুহূর্তেই তারা আত্মসমর্পণ করতে পারে।
নেতাজি ও ১৭ আগস্ট, ১৯৪৫
সাইগন এয়ারপোর্ট। নেতাজি, কর্নেল হাবিবুর রহমান, প্রিতম সিং, সুব্বিয়ার আপ্পাদুরাই আইয়ার, গুলজার সিং, আবিদ হাসান এবং দেবনাথ দাস অপেক্ষা করছেন। এমন সময় হঠাৎ করে জাপানি সেনা অফিসার মি. কিয়োনো এসে জানালেন, মাত্র দুইটি সিট খালি আছে। নেতাজি তাঁর সাথে কেবল একজন মাত্র সহযাত্রী নিতে পারবেন। এই কথা শুনে, নেতাজির সাথে থাকা ছয়জনই খুবই রাগান্বিত হয়ে গেলেন। কেননা, পূর্বে থেকে এমন কোনো কথা ছিল না। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই সবাই ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করা শুরু করলেন। সবশেষে ঠিক হলো, নেতাজির ব্যক্তিগত সচিব কর্নেল হাবিবুর রহমান নেতাজির সাথে যাবেন।
এমনকি এই প্লেনের গন্তব্যস্থল নিয়েও ধোঁয়াশা আছে। সেনা অফিসার মি. কিয়োনো কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলছেন যে, তিনি জানেন না। আরেকবার শোনা যাচ্ছে, গন্তব্য মাঞ্চুরিয়া। কেউ আবার বলছে যে, গন্তব্য টোকিয়ো, সেখানে সম্রাট হিরোহিতো এর সাথে সাক্ষাৎ করে তিনি পরবর্তী লক্ষ্য বাছাই করবেন। সমস্ত কিছু হয়ে গেলে, নেতাজি সবার থেকে আনুষ্ঠানিক বিদায় নিলেন এবং সবাইকে অভিবাদন জানালেন, ‘জয় হিন্দ’। তারপরে নেতাজি এবং কর্নেল হাবিবুর রহমান প্লেনের অভ্যন্তরে চলে গেলেন। বেলা ৫টা ১৫মিনিটে নেতাজিকে নিয়ে প্লেন উড়ে গেলো। তিনি বিদায়বাণী হিসেবে সিঙ্গাপুরবাসীর জন্য (যেখানে ছিল আজাদ হিন্দ সরকারের বৈদেশিক কেন্দ্র) নিম্নোক্ত লেখা লিখে দিয়ে যান –
ভাই ও ভগিনীগণ, … … … আজাদ হিন্দ ফৌজ ও ঝাঁসির রাণীবাহিনীতে শিক্ষা গ্রহণ করার জন্য আপনারা আপনাদের সন্তানদের পাঠিয়েছিলেন। আজাদ হিন্দ সরকারের যুদ্ধ-ভাণ্ডারে আপনারা মুক্তহস্তে দান করেছিলেন অর্থ ও অন্যান্য সামগ্রী। এককথায় বলতে গেলে, সত্যিকারের ভারত-সন্তানদের মতই আপনারা আপনাদের কর্তব্য করেছিলেন।
আরও পড়ুনঃ প্রথম বিশ্বযুদ্ধ এবং নকল প্যারিস
নেতাজি ও ১৮ আগস্ট, ১৯৪৫
মধ্যদুপুরে তাইহোকু বিমানবন্দরে এসে থামলো নেতাজি, কর্নেল হাবিবুর রহমান এবং অন্যান্য জাপানি অফিসারদের বহনকারী স্যালি ৯৭.২ মডেলের বোমারু বিমানটি। বিমানে তেল ভরে নেওয়ার জন্য বিমানটি থেমেছে। এই সুযোগে যাত্রীরা সবাই বিমান থেকে নেমে এসে হালকা খাবার খেয়ে নিলেন। তারপরে আবার সবাই প্লেনে উঠে গেলেন। দুই কি তিন মিনিট পরের কথা, হঠাৎ করে বিকট শব্দে কেঁপে উঠলো বিমান। সবার মনে শঙ্কা, মিত্রশক্তির বিমান আবার আক্রমণ করে বসলো না তো! সাথে সাথে একটা প্রচণ্ড বিস্ফোরণের শব্দ। মাত্র দু’শ বা তিন’শ ফুট উচ্চতা থেকে ভুপাতিত হলো বিমান। বিমানবন্দর থেকে বেশি দূরে যাওয়া হয়নি বিধায়, মিলিটারি এ্যাম্বুলেন্স এ করে দ্রুত নেতাজিকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করা হলো। পুরোটা সময় ব্যক্তিগত সচিব কর্নেল হাবিবুর রহমান তাঁর সাথেই ছিলেন। রাত আনুমানিক ১০টা নাগাদ তিনি মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর পূর্বে হাবিবুর রহমানকে বলা তাঁর সর্বশেষ নির্দেশ ছিল এরুপ-
আমার মৃত্যু আসন্ন। সারাজীবন আমি দেশের স্বাধীনতার জন্যই লড়াই করে এসেছি। আজ স্বাধীনতার জন্যই আমি মৃত্যুকে বরণ করে নিলাম। ফিরে গিয়ে দেশবাসীকে বলো, তারা যেন সংগ্রাম চালিয়ে যায়। ভারতবর্ষ স্বাধীন হবে, অচিরেই হবে। (২)
তারপরে তিনি হাবিবুর রহমানকে কাছে ডেকে বলেন,
এবার আমি ঘুমাবো। (৩)
আর এইভাবেই ভারতের বীর সন্তান নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু দেশমাতৃকার জন্য নিজের প্রাণের আহুতি দিলেন। হাজার হাজার বীর-যুবার নায়ক, আজাদ হিন্দ ফৌজের সর্বাধিনায়ক এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অন্যতম এই কেন্দ্রস্থিত নেতা আজীবন ছিলেন অসহযোগ আন্দোলনের পক্ষে। কেউ যদি এক গালে আঘাত করে, তবে তার কাছে আরেক গাল বাড়িয়ে দিয়ে নয়, বরং জালিমের উভয় গালেই চপেটাঘাত করার শিক্ষা দিয়েছিলেন তিনি। তবে, এটাও ঠিক যে, নেতাজি এর মৃত্যু নিয়ে নানাবিধ লোককথা প্রচলিত। অনেকেরই মতে, তাঁর সেইদিন মৃত্যু হয়নি। এমনকি গান্ধিজি পর্যন্ত নেতাজি এর দাদা শরৎ বসুকে পত্র দিয়েছিলেন, যাতে তাঁর পারলৌকিক কার্যাদি পরে সম্পাদন করা হয়। তবে যাই হোক না কেন, সমস্ত ভারতবর্ষের মানুষের কাছে তিনি যে শ্রদ্ধার আসনে সমাসীন, তাঁর মৃত্যু কখনোই সেই আসন থেকে টলাতে পারবে না, আজীবন সেইভাবেই তিনি থাকবেন। ঠিক যেমন করে তিনি বলেছিলেন,
আমাদের লক্ষ্য এক ছিল, এক আছে এবং এক থাকবে।
তথ্যসূত্র:
গ্রন্থসূত্র:
- আমি সুভাষ বলছি (৩য় খণ্ড); ISBN: 818756315X; লেখক – শৈলেশ দে; বিশ্ববাণী প্রকাশনী, কলকাতা; সপ্তম সংস্করণ, ১৩৯৮ বঙ্গাব্দ; পৃষ্ঠা – ১৪৫
- আমি সুভাষ বলছি (৩য় খণ্ড); ISBN: 818756315X; লেখক – শৈলেশ দে; বিশ্ববাণী প্রকাশনী, কলকাতা; সপ্তম সংস্করণ, ১৩৯৮ বঙ্গাব্দ; পৃষ্ঠা – ২৪৪
- আমি সুভাষ বলছি (৩য় খণ্ড); ISBN: 818756315X; লেখক – শৈলেশ দে; বিশ্ববাণী প্রকাশনী, কলকাতা; সপ্তম সংস্করণ, ১৩৯৮ বঙ্গাব্দ; পৃষ্ঠা – ২৪৪
ফিচার ছবিসূত্র: The Daily Star
আমি নিজে এক গালে চড় খেলে আরেক গাল এগিয়ে দেওয়ার মানসিকতা ধারণ করি। তবুও মাঝে মধ্যে মনে হয় আমি ভুল। যাইহোক, বেশ তথ্যবহুল লেখা ছিল।
অবশ্য জীবনে দুই ধরনের মানসিকতার প্রয়োজন আছে। কিন্তু আমি এখানে আসলে গান্ধিজির অহিংসা আন্দোলনের সমালোচনা করেই এই কথাটি বলেছি।মন্তব্য এর জন্য ধন্যবাদ।
[…] […]
[…] […]