- নানচিং গণহত্যা: মানবতার চরম ভুলুণ্ঠন, শেষ পর্ব - September 10, 2020
- নানচিং গণহত্যা: মানবতার চরম ভুলুণ্ঠন, পর্ব ২ – মূল অপরাধযজ্ঞ - September 7, 2020
- নানচিং গণহত্যা: মানবতার চরম ভুলুণ্ঠন, পর্ব ১ – উপক্রমণিকা - September 5, 2020
নানচিং গণহত্যা বিষয়ক আমাদের চলমান এই ধারাবাহিকের প্রথম পর্বে জাপানের পরাশক্তি হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলা, প্রথম সাইনো-জাপানিজ যুদ্ধের বর্ণনা এবং দ্বিতীয় সাইনো-জাপানিজ যুদ্ধের পটভূমি ফুটে উঠেছে। দ্বিতীয় পর্বে সাইনো-জাপানিজ যুদ্ধের অংশ হিসেবে নানচিং গণহত্যার সূচনা এবং জাপানি সৈন্যবাহিনীর অত্যাচারের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। আজকের নিবন্ধে তথা এই ধারাবাহিকের তৃতীয় এবং শেষ পর্বে এই গণহত্যার সমাপ্তি এবং অন্যান্য বিষয়াবলী নিয়ে আলোচনা করা হবে।
বীভৎসতায় নানচিং
নানচিংয়ের নারকীয় তাণ্ডব যে কাউকে শিউরে তুলতে যথেষ্ট। এই বীভৎসতার কিয়দাংশ বর্ণনাই হাড় হিম করে দিতে পারে আমার আপনার মত সাধারণ মানুষের। জাপানি সৈন্যরা বর্বরতায় পশুকেও ছাড়িয়ে যায়, মানবতা মুখ থুবড়ে পড়ে। তাদের অপকর্মের সামান্য চিত্রায়ন – পরিবারের সামনে ধর্ষণের পর সম্পুর্ণ পরিবারকে মেরে ফেলা হত। অনেক সময় ছুড়ি দিয়ে আঁচড়ে ফেলা হত ধর্ষিতার গোপনাঙ্গ। যোনীপথে ঘাস, লাঠি ইত্যাদি প্রবেশ করিয়ে বর্বর উল্লাসে মেতে উঠতো এই শয়তানের বাহিনী। যোনীপথে বোমা প্রবেশ করিয়ে তা বিস্ফোরণ করানোর মত ঘটনাও ঘটেছিলো এই নানচিংয়ে।
শুধু এসবই নয়। রাইফেলের নিশানায় পিতা-কন্যা কিংবা মা-পুত্রকে যৌন সঙ্গমে বাধ্য করার মত ঘটনাও ঘটে। এগুলো যেন তাদের বিনোদনের খোরাক। জেনারেল Matsui Iwane ফিরে এসে এসব দেখে চিন্তিত হয়ে পড়েন। কিন্তু তার কোন কথাই আর কেউ শুনছিলো না। অবাধ উন্মত্ত নেশায় অমানুষদের তাণ্ডব চলছিলো নানচিংয়ে। এই ছয় সপ্তাহে নানচিং হয়ে ওঠে পৃথিবীর জাহান্নাম, দুঃস্বপ্নের এক শহর।
মৃতের সংখ্যা
কতজন মানুষ মারা গিয়েছিলো সেখানে? বুদ্ধিজীবীদের দাবী ৩,০০,০০০ থেকে ৪,০০,০০০ মানুষ মারা যান এই ঘটনায়। চীনা মিলিটারিদের ভাষ্যমতে ৪,৩০,০০০ মানুষকে মারা হয় এই সম্পূর্ণ ঘটনায়। ১৯৪৬ সালে নানচিং কোর্ট দাবী করে মৃতের সংখ্যা ৩,০০,০০০। নানচিং সেফটি জোন কমিটির নেতা, John Rabe এর ভাষ্যমতে শুধু ফেব্রুয়ারির আগ পর্যন্ত এই সংখ্যা ৫০,০০০ (উল্লেখ্য ডিসেম্বরে শুরু হয়ে ছয় সপ্তাহ ব্যাপী এই ধ্বংসযজ্ঞ চলেছিলো)। কিন্তু জাপান এখনও দাবী করে এই সংখ্যা ৩০০০ এর বেশি না। যদিও কেবল একটি গণকবর থেকেই ৩০,০০০ মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছিলো। জাপানের প্রতিক্রিয়া নিয়ে নিবন্ধের শেষ অংশে আবার আলোচনা আসবে।
মানবতার জয়জয়কার
অস্কার শিন্ডলার নামের জনৈক নাৎসি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ১২ হাজার ইহুদিদের বাঁচিয়েছিলেন। Mies Giep এর নামটাও না নিলেই নয় যিনি অ্যানা ফ্রাংকের পরিবারকে লুকিয়ে রেখেছিলেন।
দুঃসময়গুলো জন্ম দেয় সেরা সেরা মহানায়কদের, ইতিহাস তাদের ভোলে না। নানচিংয়ের দুঃসময়েও কয়েকজন হাজির হয়েছিলেন উদ্ধারকর্তার বেশে।
আক্রমণের শুরুতেই বৈদেশিকরা চলে যান নানচিং ছেড়ে। কিন্তু কেউ কেউ এই করুণ সময়ে নানচিং ছাড়েননি। সুযোগ পেয়েও নিজের প্রাণ বাজি রেখে অনেকে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন ব্যবসায়ী, প্রফেসর, ব্যারিস্টার এবং জন্মসুত্রে আমেরিকান, জার্মান, ড্যানিশ কিংবা রাশিয়ান।
১৬ ডিসেম্বর অনেকটা শুরুতেই এরকম ২২ জন প্রবাসী প্রতিষ্ঠা করেন International Committee for Nanking Safety Zone (ICNSZ)। John Rabe নামের একজন নাৎসি ব্যবসায়ীকে এই কমিটির নেতা বানানো হয় (যেহেতু জার্মানদের সাথে চীনের বন্ধুত্ব ছিলো তাই John Rabe এর নির্বাচিত হওয়াটা ছিলো উপকারী সিদ্ধান্ত)। শুরুতে এই সেইফটি জোনে কোন প্রকার আক্রমণ না করার প্রস্তাব মেনে না নিতে চাইলেও, পরে সুকৌশলে Rabe একে নিউট্রাল হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন।
নানচিং গণহত্যা রোধে সেইফটি জোন
মাত্র ২ বর্গমাইলের এই সেইফটি জোন ছিলো মানুষের জন্য স্বর্গের সমতুল্য। ২,০০,০০০ থেকে ২,৫০,০০০ মানুষ ঠাঁই নিয়েছিলো এই সেইফটি জোনে। এই অঞ্চল দেখাশোনার কাজ করতো ICNSZ এর সদস্যরা। যদিও মাঝেমাঝে এখানেও আক্রমণ করতো জাপানি বাহিনি। কিন্তু এই দুঃস্বপ্নের নগরীতে Nanking Safety Zone বাঁচিয়েছিলো বহু মানুষকে।
John Rabe এর কথা আলাদাভাবে না বললেই নয়। প্রতিষ্ঠার ঠিক পরের দিন, ১৭ ডিসেম্বর, Rabe চিঠি দেন জাপান পররাষ্ট্র দপ্তরে, অভিযোগ করেন এসকল বিশৃঙ্খলার বিরুদ্ধে। তাছাড়াও আমেরিকা এবং জার্মানিতেও তিনি নিয়মিত চিঠি দিতেন (যদিও তার নিজের দেশ কিংবা তার পার্টির হেড-কমান্ডার, হিটলার, তার কোন উপকার করেনি)। সেইফটি জোনকে নিরাপদ বানাতেও কাজ করে যান।
অন্যান্য সদস্যদের সাহায্য নিয়ে তিনি প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষকে নিয়ে আসেন Nanking Safety Zone এ। নাৎসি পার্টির নেতা বিধায় জাপান শুরুতে তাকে অনুরোধ করেছিলো যাতে এই স্থান ছেড়ে অন্য কোনো নিরাপদ স্থানে চলে যান। কিন্তু তিনি যান নি। উল্টো সারা পৃথিবীকে এই বিভৎস আক্রমণের কথা বলে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে Safety Zone কে নিরাপদ করতে সক্ষম হন তিনি (যদিও সময়ে সময়ে সুযোগ পেয়ে সৈন্যরা ঢুকে যেত, অপহরণ করতো মেয়েদের)।
John Rabe গাড়িতে করে শহর ঘুরে বেরাতেন। কোথাও কেউ ধর্ষণের ফলে পড়ে আছে কিংবা কেউ আহত এমন কাউকে পেলে নিয়ে আসতেন। অনেকে ছুটে এসে তাকে বলতো যে কাউকে ধর্ষণ করা হচ্ছে। দৌড়ে যেতেন সেখানে, বাঁচানোর চেষ্টা করতেন। এই অস্ত্রধারী নৃশংস বাহিনীর বিরুদ্ধে তার একটাই অস্ত্র, হাতের স্বস্তিকা (নাৎসিদের চিহ্ন)।
একটি স্বস্তিকা আর বিশাল মনোবল নিয়ে শহরবাসীদের বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন তিনি। যদিও ফেব্রুয়ারিতে সেখান থেকে তাকে ফিরে আসতে হয়।
বলতে হবে Robert Wilson এর কথাও। একমাত্র চিকিৎসক যিনি নিরলস সেবা দিয়ে যাচ্ছিলেন নানচিংয়ে। Wilhelmina Vautrin ও এই গল্পের আরেকজন মহামানবী। এই শিক্ষিকাও সুযোগ পেয়েছিলেন ধ্বংসের শহর ত্যাগ করার। কিন্তু থেকে গিয়েছিলেন, তার স্কুল প্রাঙ্গণ হয়েছিলো অসংখ্য মানুষের একমাত্র আশ্রয়।
ভয়ংকর ছয়টি সপ্তাহ চলে এই তাণ্ডব। জানুয়ারি ১৯৩৮ সালে সেইফটি জোন থেকে সবাইকে ফিরে যাওয়ার আদেশ দেয় জাপান। জাপান থেকে ‘Restoration Order’ আসে। Asaka এবং Matsui কে ডেকে পাঠায় জাপান। Collaborating Government প্রতিষ্ঠা করার পর ফেব্রুয়ারির শেষদিকে (২৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯৩৮) সকল নিষেধাজ্ঞা তুলে দেওয়া হয়। ইমপেরিয়াল আর্মির বর্বরতাও কমে আসে। Rabe চীন ত্যাগ করেন, Matsui কে অব্যহতি দেওয়া হয়। অবশেষে সমাপ্তি হয় Rape of Nanking এর। মানসিক আঘাতে জর্জরিত থাকে নানচিংয়ের বেঁচে যাওয়া মানুষ। রাস্তাঘাটে অবশিষ্ট মৃতদেহ গুলোর অনেকগুলোকে Hui সম্প্রদায় (চীনের মুসলিম নৃ-গোষ্ঠী) ইসলামি পদ্ধতিতে দাফন করে, Red Swastika Society-ও মৃতদেহ সৎকারের ব্যবস্থা করে।
নানচিং গণহত্যা সমাপ্তি এবং পরবর্তী কথা
১৯৪৫ এর জাপানের আত্মসমর্পনের মাধ্যমে দ্বিতীয় Sino-Japan যুদ্ধ এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়। যুদ্ধাপরাধ সংক্রান্ত দুইটি ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয় যেগুলো হচ্ছে International Military Tribunal Far East (এটি টোকিয়ো ট্রায়াল নামে সমাধিক পরিচিত) এবং Nanking War Crime Tribunal।
ট্রাইবুনালের রায় মোতাবেক নানচিং-সাংহাইয়ে গণহত্যা, লুটতরাজ, ধর্ষণ, যুদ্ধবন্দীসহ আরো নানা অপরাধের জন্য Genaral Iwane Matsui, Lieutenant Colonel Tani, Officer Toshiaki Mukai, Officer Tsuyoshi Noda (১০০ জন হত্যার প্রতিযোগিতা যারা করেছিলেন) সহ আরো অনেককে ফাঁসিতে ঝোলানোর নির্দেশ দেওয়া হয়। রাজপরিবারের সদস্য হওয়ায় Prince Asaka বিচার থেকে অব্যাহতি পান।
Nazi-Japanese সম্পর্কে ফাঁটল ধরানোর অভিযোগে John Rabe কে গ্রেফতার করা হয়। এত মানুষের জীবন বাঁচানোর পর শেষ জীবনে করুণ সময়ের মধ্য দিয়ে যেতে হয় তার। একটা সময় তিনি আর্থিক সংকটে পড়ে যান। তার এই সংকটের কথা জানতে পেরে নানচিংবাসীরা অর্থ-সংগ্রহ শুরু করে, এমনকি তার জন্য খাবারও পাঠাতে থাকে। ১৯৪৯ এ চীনের রাজধানী নানচিং থেকে বেইজিংয়ে স্থানান্তরিত করা হয়।
নানচিং গণহত্যা এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক
নানচিং গণহত্যার ঘটনা এখনো চীন-জাপানের মধ্যকার সম্পর্কের অন্তরায়। তবে এই ঘটনা অতিরঞ্জিত করার দাবী করে জাপান। যদিও জাপান স্বীকার করেছিলো বেসামরিক হত্যা, লুট-ধর্ষণের। কিন্তু এই ঘটনা বা তথ্যাদি বা এর বিশালতা যেকোনোটিকে অস্বীকার করা জাপানের উগ্র-জাতীয়তাবাদকেই (Ultra-nationalism) নির্দেশ করে।
জাপান কখনোই লিখিতভাবে নানচিং গণহত্যার জন্য চীনের কাছে দুঃখ প্রকাশ কিংবা ক্ষমা চায়নি। ২০১৫ সালে জাপানি প্রধানমন্ত্রী শিনজো অ্যাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সমাপ্তির ৭০ বছর উপলক্ষ্যে আনুষ্ঠানিক বক্তব্য দেন এবং তাতে চীনে জাপানের এই বর্বরতার বিষয়গুলো এড়িয়ে যাওয়া হয়।
Iris Chang এর মতে জাপানে এই বিষয়ে কোনো গবেষণা, তথ্য, মত প্রকাশ অলিখিতভাবে নিষিদ্ধ। কিন্তু এই ঘটনা ইতিহাসে মানুষের বর্বরতার চিহ্ন রেখে যায়। বিশেষ দ্রষ্টব্য যে, নানচিং গণহত্যার অনেক ভয়াল ছবি এখনও রয়েছে। অনেকগুলো এতটাই বীভৎস যে, এই নিবন্ধে যুক্ত করা সম্ভব হয়নি।
বর্বরোচিত এসব ঘটনার কথা শুনলে মনে হয় মানুষই হয়তো পৃথিবীর সবচেয়ে বাজে সৃষ্টি। কিন্তু Rabe এর মত মানুষেরা বারবার এই মতকে ভুল প্রমাণ করেছেন। এই পৃথিবীর আর কোথাও যেন কখনও নানচিং এর মত বর্বরতা নেমে না আসে। বেঁচে থাকুক John Rabe রা। করুণা, ভালোবাসা আর সহাবস্থান ভরিয়ে দিক সুন্দর পৃথিবীটাকে।
তথ্যসূত্র:
ফিচার ইমেজ : নানকিং ম্যাসাকার মেমরিয়াল হল। সূত্র: Wsimag
সম্পর্কিত নিবন্ধসমূহ: