- নানচিং গণহত্যা: মানবতার চরম ভুলুণ্ঠন, শেষ পর্ব - September 10, 2020
- নানচিং গণহত্যা: মানবতার চরম ভুলুণ্ঠন, পর্ব ২ – মূল অপরাধযজ্ঞ - September 7, 2020
- নানচিং গণহত্যা: মানবতার চরম ভুলুণ্ঠন, পর্ব ১ – উপক্রমণিকা - September 5, 2020
মানব সভ্যতার বয়স ছয় হাজার বছরের মত। সভ্যতার এই সুবিশাল পথ পরিক্রমায় বহু ঘটনার সাক্ষী হতে হয়েছে মানুষকে। সেসব ঘটনার অনেকগুলোই বিভৎস, বিশ্রী, বর্বর অত্যাচারে ভরা। উদাহরণস্বরূপ রোমানদের কার্থেজ আক্রমণ (মৃত সংখ্যা আনুমানিক দেড় লাখ) কিংবা খ্রিষ্টান সেনা কর্তৃক স্প্যানিশ গণহত্যা কিংবা দিল্লিতে তৈমুর লং এর কারাবন্দী নিধন (মৃতের সংখ্যা আনুমানিক এক লাখ)। নানচিং গণহত্যা তেমনই এক হত্যাকাণ্ড, যা বিশ্ব বিবেককে আজও নাড়া দেয়।
এই শতাব্দীর শুরুতে ঘটে যাওয়া এই বর্বরচিত ঘটনা নিয়েই আজকের নিবন্ধ। সেই বর্বরতায় প্রাণহানির পরিমাণ উপরের বর্ণিত অন্য ঘটনাগুলোর থেকেও ঢের বেশি। ইতিহাস এটির অন্য নাম রেইপ অব নানচিং (Rape of Nanking) বা নানচিং হত্যাকাণ্ড (Nanjing Massacre)।
মাত্র ছয় সপ্তাহ সময়ের মধ্যে ইতিহাসের অন্যতম বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ড ধেয়ে আসে চীনের প্রাক্তন রাজধানী, নানচিং (অথবা নানকিং) এর জনমানুষের নিয়তিতে। সুন্দর- শান্ত, প্রাচীন এই শহরের বুকে যেন যম নেমে এসেছিল ১৯৩৭ সালের ডিসেম্বরে। সেই তাণ্ডবে প্রাণহানির পরিমাণ হিরোশিমা কিংবা নাগাসাকির থেকেও বেশি। যেখানে তিন থেকে চার লক্ষ বেসামরিক মানুষদের হত্যা করা হয় নৃশংস ভাবে; উন্মাদ ধর্ষণ, হত্যা, লুটতরাজের প্রতিযোগিতায় মেতে উঠে অপ্রতিরোধ্য জাপানি সৈন্যবাহিনী। রচিত হয় ইতিহাসের আরেকটি কলংকজনক অধ্যায়। নানচিং ম্যাসাকারের বিশেষত্ব শুধু হত্যাকাণ্ডের বিশালতাই না, নিষ্ঠুর বর্বরতাও। কিন্তু কেন যেনো এই গণহত্যা এতটা পরিচিত না সবার মধ্যে।
কিন্তু ইতিহাস কিছু ভোলে না। আজ তুলে ধরার চেষ্টা আলোচনা করবো সেই ইতিহাসের কিছু অংশকে।
প্রাক-কথন
ঘটনাপ্রবাহের শুরু জানতে হলে তৎকালীন চীন-জাপানের রাজনৈতিক অবস্থা, ইতিহাস এবং তাদের মধ্যকার সম্পর্ক নিয়ে জানতে হবে। ১৮৫৩ সালের আগ পর্যন্ত জাপান ছিলো আন্তর্জাতিক সম্পর্কহীন একাকী সার্বভৌম দ্বীপরাষ্ট্র। ১৮৫৩ সালে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় তাদেরকে অনেকটা বাধ্য করে যুক্তরাষ্ট্র (USA)। খোলস ছেড়ে বের হয় জাপান। চোখ তুলে দেখে সারা পৃথিবী কতটা এগিয়ে গেছে। ১৮৬৮ সালে মেইজি রেস্টোরেশনের (Meiji Restoration) মাধ্যমে জাপান একীভূত সাম্রাজ্যব্যবস্থা (ইম্পেরিয়ালিজম) স্থাপন করে এবং বিশ্বের অন্যান্য প্রান্ত থেকে জ্ঞান অর্জনের ব্রত নেয়।
জাতীয়তাবাদের (Nationalism) স্লোগানে মুখরিত হতে থাকে জাপান ( যেমন ‘Revere the emperor, expel the barbarians’, ‘Rich country, strong army’)।
উন্নয়নের কাল
শুরু হয় আর্থসামাজিক উন্নয়ন; জ্ঞান বিজ্ঞান, সামরিক ক্ষমতায় এগিয়ে যেতে থাকে জাপান। এদিকে চীন পুর্ব এশিয়ায় আধিপত্য বিস্তারকারী সুবিশাল একটি দেশ। ১৮৯৪ সালে চীনের সাথে জাপানের যুদ্ধ হয় যেটি Sino-Japanese war নামে পরিচিত। কোরিয়ার ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠাকে কেন্দ্র করে প্রথম চীন-জাপান যুদ্ধে (Sino-Japanese war) জয়ী হয় জাপান। এ যুদ্ধে জাপানের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিলো বিশ্বদরবারে নিজেদেরকে পরাশক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা। ১৯০৫ সাল রুশ-জাপান যুদ্ধে জয়ী হয়ে নিজেকে প্রমাণ করে জাপান (মোঙ্গোলদের পর প্রথম পরাশক্তি যারা ইউরোপীয়দের হারাতে সক্ষম হয়)।
কিন্তু ১৯৩০ এর দশকে সুদিন হারাতে থাকে জাপান; ধ্বস নামে অর্থনীতিতে। গ্রেট ডিপ্রেশনের (The great depression, 1929) পর এই অবস্থা আরো খারাপ হয়। বিশাল জনসংখ্যার জন্য পর্যাপ্ত খাদ্য সংস্থানে পর্যন্ত হিমশিম খেতে থাকে। বিপুল জনসংখ্যার জন্য পর্যাপ্ত কর্মসংস্থানের যোগান দেওয়া, নিজেদের পরাশক্তির প্রমাণ দেওয়ার মত আরো নানা কারণে সাম্রাজ্য বিস্তারের চিন্তা আসে জাপানের।
জাপানিদের কাছে চীনদের পুর্ব থেকেই একটু নিচু, দুর্বল করে দেখার অভ্যাস ছিলো। জাপানের স্কুলে স্কুলে ঘোর-জাতীয়তাবাদের (Ultra-nationalism) দীক্ষা দেওয়া শুরু হয়। মিলিটারি নিয়োগ করে শিশুদের ট্রেনিং দেওয়া, তাদের মনে অতি-আনুগত্যের বীজ বপন করা শুরু হয়। এক্ষেত্রে বলে রাখা দরকার, জাপানি জাতীয়তাবাদ অনুসারে আনুগত্য গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। সামুরাইদের নীতি Bushido অনুসারে সমর্পণের চেয়ে আনুগত্য সহকারে মৃত্যুও অনেক সম্মানের। নীতি অনুসারে সাম্রাজ্যের জন্য মৃত্যুবরণ করতে তারা এক মুহুর্তও দ্বিধা করবে না। যেমন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের কামিকাজে (কামিকাজি) এর মত আত্মঘাতী আক্রমণগুলো তাক লাগিয়ে দিয়েছিল গোটা পশ্চিমা বিশ্বকে।
অন্যদিকে চীন আয়তনে বিশাল হলেও অনেকগুলা ছোট সাম্রাজ্যে (Clique) বিভক্ত ছিলো যারা নিজেরাই গৃহযুদ্ধে লিপ্ত ছিল। সার্বভৌম কোনো কেন্দ্রীয় শক্তির অধীনে তারা ছিল না।
তাই জাপানের জন্য চীনের কোন প্রদেশ দখল করা তুলনামুলক সোজা ছিলো। কিন্তু বিগত দুই দশক ধরে বংশশাসিত আলাদা আলাদা সাম্রাজ্যকে (Clique) একীভুত গণতন্ত্র প্রতীষ্ঠা করার জন্য লড়াই করে চীন। ১৯২০ এর দশকে Chiang Kai-shek এর নেতৃত্বে সফলও হয়।
এতদিন জাপানের গোপন পরিকল্পনা ছিল Manchuria দখলের, যা এখন ধীরে ধীরে ভেস্তে যাওয়ার পথে। অতঃপর Manchuria এর শাসক Chang Tsolin কে গুপ্তহত্যা করে জাপান। ফলস্বরুপ চীনের সাথে সম্পর্ক ক্রমেই খারাপ হতে থাকে। ১৯৩১ থেকে অঘোষিত যুদ্ধ শুরু হয়, বিভিন্ন প্রপাগান্ডার আশ্রয়ে জাপান Manchuria দখল করতে সফল হয়, ১৯৩২ সালে সাংহাইয়ে ১০ হাজার মানুষকে হত্যা করে এবং পরিশেষে আন্তর্জাতিক চাপের মুখে ১৯৩৩ সালে লীগ অব ন্যাশনস থেকে নাম প্রত্যাহার করে নেয়। অনিবার্য যুদ্ধকে সামনে রেখে জাপান সামরিক শক্তিতে আরো বলীয়ান হতে থাকে।
আরও পড়ুন: নেতাজি: এক মহানায়কের জীবনকথা এবং মৃত্যু
দ্বিতীয় চীন-জাপান যুদ্ধ
অবশেষে ১৯৩৭ সালে সুযোগ আসে জাপানের কাছে। Marco Polo Bridge Incident কে কেন্দ্র করে জাপান, চীনের ওপর আক্রমণ করে। জুন নাগাদ Teintsin-Peeking অঞ্চল জাপানের কুক্ষিগত হয়ে যায়। পরাস্ত হয় চীনের সামরিক বাহিনী। শুরু হয়ে যায় দ্বিতীয় চীন-জাপান যুদ্ধ (Second Sino-Japanese war)। কিন্তু চীন জয় করা জাপানের জন্য বেশ কষ্টসাধ্য। কারণ চীনের সেনাসংখ্যা বেজায় বেশি। কিন্তু সামরিক শক্তির দুর্দান্ত বলে জাপান সক্ষম হয় সাংহাই জয় করতে। তাও মাত্র তিন মাসেই। এরপর শক্তিতে বলীয়ান Devil’s Army অগ্রসর হয় রাজধানী নানচিং এর পথে।
এবার নানকিং অথবা নানচিং নিয়ে হালকা কথা বলা যাক। চীনের প্রাক্তন রাজধানী নানচিং। লম্বা সময় ধরে এটি চীনের জ্ঞান-বিজ্ঞান, সাহিত্য-কলা এবং রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু ছিলো। ইতিহাসের বড় সময় ধরে এ শহর আগেও দুইদফা চীনের রাজধানী ছিলো। চীনা ভাষার চার স্বরের (Four tone system of chinese language) উদ্ভব, চীনা ক্যালিগ্রাফি, রাজপ্রাসাদ, সমাধীসহ অজস্র ইতিহাস আর ঐতিহ্যে ভরা এই শহর। কিন্তু এই শহরের কপালে লেখা ছিলো এক নিদারুণ গল্প। সেই গল্পের খলনায়করা ধেয়ে আসছিলো এই শহরের দিকে।
সাংহাই ধুলিস্মাৎ করে জাপান অগ্রসর হয় নানকিং এর দিকে। চীনের এই রাজধানী দখল করতে পারলে সামরিকভাবে আরো শক্তিশালী প্রমাণিত হবে জাপান। মানচিত্রে নানকিং দুই দিকে পানিবেষ্টিত, ইয়াংজি নদী (Yangtei River) যেন এই শহরের দুর্গপ্রাচীর। কিন্তু এই দুর্গ জাপানের আক্রমণের জন্য শাপে-বর হয়ে যায় ।
মিলিটারির একটি অংশ পশ্চিম দিক দিয়ে অগ্রসর হয়, সেই অংশের পরিচালক ছিলেন নাকাজিমা (Kesago Nakajima)। নাকাজিমার সম্পর্কে লেখকগণ লিখেছিলেন “A sadist who picked up his journey to Nanking special oil only to burning body”। অন্যান্য বাহিনীরাও নিজেদের মত অগ্রসর হচ্ছিল। জেনারেল মাতসুই (Matsui Iwane) এর নেতৃত্বে জাপান এগিয়ে আসছিলো।
ভয়াবহ সেই দিনের শুরু
কিন্তু এদিকে সাংহাইয়ের পতনের খবর শোনার পর Chiang Kai-shek হয়তো সবচেয়ে বাজে সিদ্ধান্তটা নিয়ে ফেললেন। তিনি হয়তো ভেবেছিলেন নানকিং এ প্রতিরোধ না গড়ে আরো শক্তিশালী হয়ে হয়তো আক্রমণ করে রুখে দেওয়া যাবে জাপানকে। তিনি কোনো ধরনের প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা না করে উল্টো Officer Tang সহ সকল অফিশিয়ালদের নানকিং ছাড়তে নির্দেশ দেন, ধণিক শ্রেনিও শহর ছেড়ে চলে যায়। ফলাফল একঝাঁক নেতৃত্বহীন সৈন্য এবং বেসামরিক শহরবাসী পরে থাকে জাপানিজ সৈন্যদের ক্ষমার ভরসায়। এদিকে কিছুটা সুহৃদ Genaral Matsui Iwane অসুস্থ হয়ে পরলে তিনি চীন ত্যাগ করেন, দায়িত্বে আসেন যুবরাজ Asaka Yasuhiko যিনি সম্রাট হিরোহিতোর আত্মীয়।
শক্তিতে বলীয়ান জাপানদের প্রতিরোধ করতে ব্যর্থ হয় নানকিং এর অবশিষ্ট সৈন্য। অনেক সৈন্য ধরা পরার হাত থেকে বাঁচতে দোকান/বাসাবাড়ি লুট করে বেসামরিক পোশাকের জন্য, নিজের পোশাক ছিঁড়ে ফেলে জনমানুষের ভিড়ে হারিয়ে যাবার চেষ্টা করে। পরিশেষে ১২ ডিসেম্বরের মধ্যে বিশাল সংখ্যক সৈন্য আত্মসমর্পণ করে এবং বন্দী হয় জাপানিদের দয়ার আশায়।
চলবে … … …
- দ্বিতীয় পর্ব পড়ুন এখানে : নানচিং গণহত্যা: মানবতার চরম ভুলুণ্ঠন, পর্ব ২ – মূল অপরাধযজ্ঞ
- তৃতীয় পর্ব পড়ুন এখানে : নানচিং গণহত্যা: মানবতার চরম ভুলুণ্ঠন, শেষ পর্ব
তথ্যসূত্র:
ফিচার ইমেজ : নানকিং ম্যাসাকার মেমরিয়াল হল। সূত্র: Wsimag
সম্পর্কিত নিবন্ধসমূহ: