- মগজের লড়াই: শতরঞ্জ - December 25, 2020
- বদর যুদ্ধ: ইসলামের ইতিহাসে প্রথম গুরুত্বপূর্ণ বিজয় - September 23, 2020
- পিথাগোরাস বনাম আইন্সটাইন: c² তুমি কার? - August 29, 2020
চৌষট্টি খোপে লড়াই, ঘোড়া ছুটছে আড়াই চালে, নৌকা তরতরিয়ে এগোচ্ছে, হাতি বেজায় ছুটছে, চলছে বিপক্ষের রাজাকে কিস্তিমাত করার প্রয়াস! চোখ বন্ধ করে কল্পনা করলে মনে হতেই পারে আমি কোনো রণক্ষেত্রের সার্বিক পরিস্থিতি বলছি। হ্যাঁ, রণক্ষেত্র বটে, তবে এই রণক্ষেত্রে বাহুবলে সামনা-সামনি লড়াই হয়না, আসল লড়াইটা হয় মস্তিষ্ক বনাম মস্তিষ্কে! বলছি দাবা খেলার কথা।
দাবা ফলকের (Chess Board) ৬৪ বর্গক্ষেত্রের লড়াইটা ছাপিয়ে আসল লড়াই তো হয় দুইজন দাবাড়ুর মস্তিষ্কে; প্রতিনিয়ত চলে একে অপরকে কোণঠাসা করে হারাবার প্রতিদ্বন্দিতা। আপনি জানলে কিঞ্চিত অবাক হবেন, এই অনবদ্য খেলাটির সূচনা হয় আমাদেরই উপমহাদেশে, আনুমানিক ষষ্ঠ শতাব্দীতে। দাবা খেলার উৎপত্তি নিয়ে বিতর্ক রয়েছে যথেষ্টই। প্রাচীন মিশরে প্রায় ৩০০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে দাবার মত এক ধরনের খেলার প্রচলন ছিল, যার নাম ছিল শতরঞ্জ। তবে আধুনিক সময়ে যে দাবা খেলা হয়, তার উৎপত্তিস্থল হিসেবে এই উপমহাদেশের ভারতবর্ষকেই গণ্য করা হয়। ঐ সময়ে ভারতের সঙ্গে চীন ও পারস্যের সম্পর্ক দারুণ ছিল। পারস্য ও চীন দেশের নাবিকরা খেলাটিকে বেশ পছন্দ করেছিলেন। উৎসাহী নাবিকেরা নিয়ম-কানুনও শিখে নিয়েছিলেন। পারস্য থেকে ফ্রান্সে, এবং চীন হতে স্পেন ও পর্তুগালে খেলাটি ছড়িয়ে পড়ে। স্পেন, পর্তুগাল, ফ্রান্স – ইউরোপের এই তিনটি দেশে খেলাটি একবার জনপ্রিয় হবার পর, ইউরোপীয়দের মাধ্যমেই সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে এবং ক্রমেই পরিচিতি বাড়ে।


দাবার ফলক (Chess Board)
দাবার ফলকে ছোট ছোট ৬৪ টি বর্গাকৃ্তি ঘর থাকে, যা ৮ টি সারি ও ৮ টি কলামে বিভক্ত। সারি এবং কলামের সমন্বয়ে প্রতিটি বর্গক্ষেত্রকে আলাদা আলাদা নামকরণ করা হয়। নামকরণ বুঝতে নিচের ছবিটি দেখুন।


একটুখানি যাচাই! বলুনতো নিচের ছবিটিতে লাল বর্গক্ষেত্র, সবুজ বর্গক্ষেত্র, হলুদ ও নীল রঙের বর্গক্ষেত্রের নাম কি হবে।


নিজে চেষ্টা করেছেন তো!
লাল বর্গক্ষেত্রের পরিচয় c7.
সবুজ বর্গক্ষেত্রের পরিচয় e2.
নীল বর্গক্ষেত্রের পরিচয় g5.
হলুদ বর্গক্ষেত্রের পরিচয় g6.
একইভাবে প্রত্যেকটি বর্গক্ষেত্রেরই আলাদা আলাদা নামকরণ সম্ভব। আশা করি বুঝতে পেরেছেন।
ঘুঁটি পরিচিতি (Introduction to Pieces)
একজন দাবাড়ুর ১৬ টি করে দুইজনের মোট ৩২ টি ঘুঁটি থাকে। একজনের ১৬ টি ঘুঁটির মধ্যে ৮ টি বোড়ে/সৈন্য, ২টি নৌকা, ২ টি গজ/হাতি, ২ টি অশ্ব/ঘোড়া, ১ টি মন্ত্রী, ১ টি রাজা।


ছবিতে বাম দিক থেকে যথাক্রমে রাজা (King), মন্ত্রী (Queen), হাতি/গজ (Bishop), ঘোড়া/অশ্ব (Knight), নৌকা (Rook), সৈন্য/বোড়ে (Pawn)।
ফলকে ঘুঁটিগুলোকে বিশেষভাবে সাজিয়ে দাবা খেলা শুরু করতে হয়।


আরও পড়ুন: সেরার সেরা দাবাড়ুগণ ২: মিখাইল তাল, দ্য ম্যাজিশিয়ান ফ্রম রিগা ২য় পর্ব
ঘুঁটির বিবরণ
বোড়ে/সৈন্য (Pawn)
যেকোনো বোড়ে কেবলমাত্র নিজের প্রথম চালে উলম্ব বরাবর সামনের দিকে ১ টি অথবা ২ টি বর্গক্ষেত্র যেতে পারবে। একটি বোড়ের প্রথমচাল শেষ হলে, ঐ বোড়েটি পরবর্তীকে কেবলমাত্র ১ টি বর্গক্ষেত্রই সম্মুখে যাবার সুযোগ পাবে। বোড়ে যখন বিপক্ষের ঘুঁটিকে ক্যাপচার (ক্যাপচার করা মানে বিপক্ষের কোনো ঘুঁটি কর্তন করা বা খেয়ে নেয়া, যে ঘুঁটিটি ক্যাপচারড হয় সেটি চেস বোর্ড থেকে বাইরে সরিয়ে রাখা হয়) করে তখন সে কর্ণ বরাবর যায়।




ছবিতে d4 ঘরের সাদা বোড়ে দিয়ে, c5 অথবা e5 ঘরের কালো বোড়ে ক্যাপচার করা যেতে পারে।
নৌকা (Rook)
নৌকা কেবলমাত্র উলম্ব বরাবর এবং আনুভূমিক বরাবর চলতে পারবে। অনুভুমিক ও উলম্ব বরাবর যতগুলো খালি বর্গক্ষেত্র থাকে তন্মধ্যে যেকোনো একটিতে নৌকাকে স্থাপন করা যাবে।


নৌকা যখন বিপক্ষের কোনো ঘুঁটিকে ক্যাপচার করবে তখনও সে এই অনুভুমিক বা উলম্ব দিকেই চলবে (বোড়ের মতো কর্ণ বরাবার ক্যাপচার করে না।)
হাতি/গজ (Bishop)
গজ বা হাতি কেবলমাত্র কর্ণ বরাবর চলতে পারে। নিচের ছবিটি দেখো।


মন্ত্রী (Queen)
দাবা খেলাতে সবথেকে শক্তিশালী ঘুঁটি হিসেবে বিবেচনা করা হয় এই মন্ত্রীকে। দাবা ফলকে মন্ত্রীর প্রভাব অনেক বেশি। মন্ত্রী উলম্ব বরাবর উপরে ও নীচে, অনুভুমিক বরাবর ডানে ও বামে আবার কর্ণ বরাবরও চলতে পারে। আরেকভাবে বলা যায়, নৌকা ও হাতি এদের সম্মিলিত চলাচল একটি মন্ত্রীর চলাচলের অনুরূপ।


ঘোড়া/অশ্ব (Knight)
দাবার ঘুঁটিগুলোর মধ্যে কেবল এই ঘোড়ার চলাচল বুঝতে একটু সময়ের প্রয়োজন হয়। ঘোড়া নিজের এবং বিপক্ষের যে-কোনো ঘুঁটি ডিঙিয়ে অপর ঘরে যেতে পারে, যা অন্য কোনো ঘুঁটির পক্ষে সম্ভব না।
ঘোড়ার চলাচল ২ টি উপায়ে সম্পূর্ণ করা যায় –
১ম উপায় – ২ টি বর্গক্ষেত্র অনুভুমিক দিকে এবং ১ টি বর্গক্ষেত্র উলম্ব দিকে।
২য় উপায় – ২ টি বর্গক্ষেত্র উলম্ব দিকে এবং ১ টি বর্গক্ষেত্র অনুভুমিক দিকে।
এই দুটি উপায়ের যেকোনো একটি অবলম্বন করেই ঘোড়ার চাল সম্পূর্ণ করা যায়। আরও বুঝতে নিচের ছবিটি দেখুন,


রাজা (King)
রাজার চলাচল খুবই সাদামাটা। রাজা সকল দিকে (ডানে-বামে, উপরে-নিচে, কর্ণ বরাবর) চলতে পারে কিন্তু তা একইসাথে কেবল একটি বর্গক্ষেত্র।




দাবা খেলায় জয়-পরাজয়ের সাথে সরাসরিভাবে যেই ঘুঁটিটি জড়িত তা হলো এই রাজা। রাজা যদি বিপক্ষের কোনো ঘুঁটির সরাসরি প্রভাবে থাকে তবে বিপক্ষ দল কতৃক এই রাজাকে চেক (বাংলায় কিস্তি) দেয়া হয়েছে বুঝায়। তখন রাজাকে নিরাপদ বর্গক্ষেত্রে (যেখানে বিপক্ষের কোন ঘুঁটির সরাসরি প্রভাব নেই) নিতে হয়।
বিপক্ষের দেয়া চেক থেকে মুক্তি লাভের ৩ টি পদ্ধতি রয়েছে।
- হয়ত রাজাকে নিরাপদ কোনো বর্গক্ষেত্রে নিতে হবে
- নয়তো বিপক্ষের যেই ঘুঁটি দিয়ে চেক প্রদান করা হয়েছে, সেই ঘুঁটি আর রাজার মধ্যবর্তী কোনো জায়গায় নিজের কোনো ঘুঁটি বসানো সম্ভব হলে বসাতে হবে
- অথবা বিপক্ষের যে ঘুঁটিটি দিয়ে চেক প্রদান করা হয়েছে, নিজের কোনো ঘুঁটি দিয়ে বিপক্ষের অই ঘুঁটিটি ক্যাপচার করা সম্ভব হলে ক্যাপচার করে নিতে হবে।
এই তিনটির যেকোনো একটি অবলম্বন করেই চেক থেকে উত্তরণ পাওয়া যায়। যদি এমন হয় যে, এই তিনটি পদ্ধতির কোনোটিই আর অবলম্বন করার কোনো উপায়ই নেই, তবে সেটিই হয় কিস্তিমাত বা চেকমেট এবং বিপক্ষ দলের জয়।
অনুরূপভাবে কখনো বিপক্ষ দলকে হারাতে হলে, তার রাজাকে এমনভাবে চেক দিতে হবে যে তা থেকে উত্তরণের কোনো পথ না থাকে, তবে সেটিই হবে তার জন্য চেকমেট এবং বিপক্ষ দল তখন পরাজিত হবে।


উপরের ছবিটিতে সাদা দলের মন্ত্রীর মাধ্যমে কালো রাজাকে চেক প্রদান করা হয়েছে এবং বর্ণিত তিনটি পদ্ধতির কোনোটির মাধ্যমেই এই চেক থেকে মুক্তিলাভ করা সম্ভব নয়, তাই এটি চেকমেট বা কিস্তিমাত। ফলস্বরূপ সাদা দল জয়ী হয়েছে এবং কালো দল পরাজিত হয়েছে।


কিছু বিশেষ নিয়ম
ক্যাসলিং মুভ বা দুর্গ প্রতিষ্ঠা (Castling Move)
এতক্ষণে আমরা রাজার গুরুত্ব নিশ্চয় বুঝেছি। রাজার নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করার জন্য একটা বিশেষ চাল দেওয়া যায়, (বাধ্যতামূলক নয়) এই চাল কে বলে ক্যাসলিং বা দুর্গ প্রতিষ্ঠা।
এখনও পর্যন্ত আমরা জানি সাধারণ অবস্থায় রাজা যেকোনো দিকে কেবলমাত্র একঘর যেতে পারে। কিন্তু এই নিয়মের একটু ব্যতিক্রমও রয়েছে। দাবা খেলায় মাত্র একবার এর জন্য রাজা এবং নৌকা সমেত একটি বিশেষ চাল দেওয়া যায়। এই চালে রাজা বোর্ডের ডান দিকে বা বাম দিকে, যে-কোনো একটা দিকে দু’ঘর যায়, এবং রাজা যেদিকে যায় সেই দিকে নৌকা রাজাকে অতিক্রম করে এসে রাজার পাশে বসে। ক্যাসলিং-এর উদ্দেশ্য হলো রাজার নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে রাজাকে ফলকের একপাশে নিয়ে যাওয়া। আরও বুঝতে নিচের ছবি তিনটি দেখুন। ১মটি সাধারণ অবস্থা, ২য়টিতে কিং সাইড (ডান দিকে) ক্যাসলিং আর শেষের ছবিতে কুইন সাইড (বাম দিকে) ক্যাসলিং।






ক্যাসলিং-এর শর্তাবলী
- ক্যাসলিং করার আগে অবধি যে রাজা বা যে নৌকার সাথে ক্যাসল করা হচ্ছে সেই নৌকা বা রাজা দিয়ে কোনো চাল দেয়া যাবে না।
- রাজা এবং ক্যাসলিং-এ ব্যবহৃত নৌকার মাঝে কোনো ঘুঁটি থাকা চলবে না।
- রাজা কিস্তিতে থাকা অবস্থায় ক্যাসল করতে পারবে না, বা ক্যাসল এর পথে রাজা কোনো কিস্তি অতিক্রম করতে পারবে না।
বোড়ে উত্তরণ (Pawn Promotion)
আমরা জেনেছি যে, বোড়ে শুধুমাত্র সামনে চলতে পারে, পিছনে বা পাশে যেতে পারে না। তাহলে কোনো বোড়ে সামনে চলতে চলতে যদি একসময় বোর্ডের শেষ সীমায় (অষ্টম সারি) পৌঁছলে কী হয়? বোড়ে অষ্টম সারিতে পৌছলে খেলোয়াড় নিজের ইচ্ছেমতো মন্ত্রী, নৌকা, ঘোড়া, হাতি এর যেকোনো একটা ঘুটি নিতে পারবে যা বোড়ের পরিবর্তে ঐ বর্গক্ষেত্রেই বসে যাবে, এই ব্যাপারটি হলো বোড়ে উত্তরণ। কিছু বিশেষ ক্ষেত্র ছাড়া সাধারণত দাবাড়ুগণ বোড়ে থেকে মন্ত্রীতেই প্রোমোশন করে থাকেন।
লেখকের সাথে চেস খেলতে আগ্রহী হলে নিচের লিংকে একটি ঢুঁ মারতে হয় যে! Arko17 (এটি লেখকের লিচেস আইডি)
আমাদের এই পৃথিবীতে যে কতক ইনডোর গেইম রয়েছে, সেগুলোর মধ্যে দাবা অসামান্য এবং অতুলনীয় তা বলতেই হয়। আজ তো কেবল দাবার ইতিহাস আর নিয়ম-কানুনের পাঠ দেখলাম। পাঠকদের সাড়া পেলে, কীভাবে দাবাড়ু হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলা যায় তা নিয়ে ফিরব। সেই প্রতীক্ষায় রইলাম।
আসলে তো বাঁচা চৌষট্টি খোপে,
সাদাকালোর খেলায়!
ঘোড়া ছুটছে আড়াই চালে,
হাতি বেড়াচ্ছে দাপিয়ে,
নৌকা তরতরিয়ে এগোচ্ছে,
মন্ত্রী চোখ রাঙাচ্ছে ইচ্ছেমতন,
চক্রবূহে নাভিশ্বাস…
শেষদানে তাই বোড়ে এগিয়ে দিলাম। কিস্তি!!!
প্রচ্ছদসূত্র: Instagram/Chess4Pro; অলংকরণ: লেখক