- রহস্যময় ডার্ক ম্যাটার ও ডার্ক এনার্জি (১ম পর্ব) - December 21, 2020
- মিশিও কাকু : বর্তমান বিশ্বের জনপ্রিয় এক পদার্থবিজ্ঞানী - October 22, 2020
- রকেট বৃত্তান্ত: রকেট যখন বিজ্ঞান ও যুদ্ধক্ষেত্রে (পর্ব-০২) - September 28, 2020
ডার্ক ম্যাটার নামটির সাথে আমরা প্রায় সবাই কমবেশ পরিচিত, জ্যোতির্বিজ্ঞানে আগ্রহীদের কাছে তো এটি বেশ পরিচিত নাম! তো দেখা যাক কি এই ডার্ক ম্যাটার!
মনে করুন আপনার হাতে একটি টেনিস বল আছে। আপনার দুষ্টু মন দুষ্টুমির দিকে আপনাকে ইঙ্গিত করল!
এই টেনিস বলটিকে নিয়ে আপনি পানিতে চুবালেন। এবার ঘরে এসে আপনি টেনিস বলটিতে ঘূর্ণনের সৃষ্টি করলেন।
আর এতে করে পুরো ঘরের বিভিন্ন দিকে পানি ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ল। আর এই দুষ্টুমির মাঝেই টের পেলেন আপনার মা আপনার ঘরে এসে হাজির! বকাঝকার পর আপনাকে দুপুরের খাবার খেতে দিল।
এর মধ্যেই আপনার বাসায় বেড়াতে আসা চাচাত ভাই আপনার সেই টেনিস বলটি নিয়ে খেলা শুরু করল এক পর্যায়ে আপনার দেখাদেখি সেও পানিতে ভিজিয়ে টেনিস বলটিতে ঘূর্ণনের চেষ্টা করল।
এদিকে আপনি তো মহাখুশি, আপনার আম্মু আজকে তাকেও অনেক বকাঝকা করবে!


কিন্তু এটি কি ঘটল! পানি তো ঘূর্ণনের সাথে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল না! কেন এমন হল? তখন মনে করবেন আপনার চাচাতো ভাই যখন এই কাজটি করেছে তখন টেনিস বলটির ভেতর ডার্ক ম্যাটার আছে!
কি ভয় পাচ্ছেন? আরে এটি তো আমরা কল্পনা করলাম মাত্র। কিন্তু এবার বাস্তবে ফেরা যাক।
রহস্যময় ডার্ক ম্যাটার
ডার্ক ম্যাটার বিজ্ঞানের রহস্যময় জিনিসের একটি।
কিন্তু আপনি কি জানেন ডার্ক ম্যাটার ও ডার্ক এনার্জি এই মহাবিশ্বের প্রায় ৯৫ ভাগ জায়গা দখল করে আছে!
হ্যাঁ ঠিকই পড়েছেন। আমরা মহাবিশ্বে যা কিছু দেখি বা জানি তা মাত্র ৫ ভাগ। বাকি ৯৫ ভাগ এখনও আমাদের জ্ঞানের নাগালের বাহিরে।
কিন্তু কি এই ডার্ক ম্যাটার আর কেনই বা এটি এত রহস্যঘেরা? ডার্ক ম্যাটারের কাজ কি? কিন্তু এখন থেকে যেহেতু মূল আলোচনার দিকে অগ্রসর হতে হচ্ছে তাই ইতিহাসের পাতা থেকে কিছুটা চোখ বুলিয়ে নিলে আশা করি মন্দ হবে না।
এই পর্যায়ে এসে পাঠকের মনে যদি একটি ভুল থেকে থাকে তা সংশোধন করে দিতে চাই।
বলুন তো ডার্ক ম্যাটার কি বর্ণের?
যদি আপনার উত্তর হয় কালো বর্ণের (যেহেতু নাম ডার্ক ম্যাটার) তাহলে আমি আপনার উত্তরকে সঠিক বলব না! হ্যাঁ ডার্ক ম্যাটার কালো বর্ণের নয়!
আসলে ডার্ক ম্যাটার কালো বর্ণের নয়, এটি মূলত বর্ণহীন।
আবিষ্কারের ইতিহাস
এই ডার্ক ম্যাটার সম্পর্কে যিনি প্রথম অনুমান করেন তার নাম ফ্রিটজ জুইকি।


আমরা জানি, মহাকর্ষ বলের কারণে একটি বস্তু আরেকটি বস্তুকে আকর্ষণ করে আর ভরের সাথে মহাকর্ষ ওতপ্রোতভাবেই জড়িত।
আর আমরা এটিও জানি যে, সময়ের সাথে সাথে মহাবিশ্ব ছড়িয়ে পড়ছে বা এক্সপান্ড(Expand) করছে।
১৯৩৩ সালে ফ্রিটজ জুইকি একটি বিষয় আবিষ্কার করেন, যা সহজ ভাষায় বললে, নক্ষত্রসমূহের মধ্যে যে মহাকর্ষ বল কাজ করে থাকে তার মাত্র ১ ভাগ জোগান দেয় এই নক্ষত্রসমূহের ভর।
তাহলে স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে বাকি মহাকর্ষ বলের জোগান হয় কীভাবে?
ঠিক প্রথমে বলা একটি কল্পিত ঘটনার মত যেখানে আপনার চাচাত ভাইয়ের ক্ষেত্রে বলটি থেকে পানি ছড়িয়ে পড়ে নি, এখানে মহাকর্ষের ক্ষেত্রেও গ্যালাক্সিগুলোতে নক্ষত্রগুলো একে অপরের থেকে ছিটকে পড়ছে না।
অথচ তাদের ভর হিসেবে যে মহাকর্ষ তাতে তাদের ছিটকে পড়ার কথা যেহেতু তারা উচ্চবেগে পরিভ্রমণ করছে ফলে কেন্দ্রবিমুখী বলের দরুন!


আর যেহেতু মহাকর্ষ ও ভর একে অপরের সাথে গভীরভাবে জড়িত তাই কল্পনা করা হয় এই অদৃশ্য মহাকর্ষের জোগান হয়ত কোন অদৃশ্য বস্তুই থেকেই আসছে! আর এরই নাম ফ্রিটজ জুইকি দেন “ডার্ক ম্যাটার”!
যা কয়েকযুগ ধরেই এক রহস্য ছিল (এখনও কিন্তু রহস্যই বটে!)।
সাধারণ পদার্থের চেয়ে বেশি!
১৯৭০ সালে মার্কিন জ্যোতির্বিদ ভেরা রুবিন এবং কেন্ট ফোর্ড এই ডার্ক ম্যাটারের উপস্থিতি নিশ্চিত করেন।
তো তখন স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে এই ডার্ক ম্যাটারের পরিমাণ কত? প্রথমে যখন বিজ্ঞানী ফ্রিটজ জুইকি পরিমাপ করেন তখন তিনি ডার্ক ম্যাটারের আসল পরিমাণের চেয়ে অনেক বেশি পরিমাপ করেন।
কিন্তু জ্যোতির্বিদ ভেরা রুবিন বেশ নিখুঁতভাবেই এই পরিমাপ করতে সক্ষম হন।
এখন আমরা জানি এটির পরিমাণ সব পদার্থের মধ্যে প্রায় ৮০-৮৫ ভাগ। অর্থাৎ দৃশ্যমান পদার্থের প্রায় ৪ থেকে ৫ গুনের মত।
মহাবিশ্বের প্রায় ৬৮ ভাগ হচ্ছে ডার্ক এনার্জি এবং ২৭ ভাগ হচ্ছে ডার্ক ম্যাটার।
আর এর বাহিরে বাকি ৫ ভাগ বা তার চেয়ে কম হচ্ছে সাধারণ পদার্থ যাদেরকে সাধারণত আমরা আমাদের যন্ত্রংশ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করতে পারি।
অর্থাৎ এগুলোকে আমরা সাধারণ পদার্থ বলতে পারি, যদিও এগুলো মহাবিশ্বের মোট পদার্থের তুলনায় পরিমাণে বেশ কম।
ডার্ক ম্যাটার কি?
এর উত্তরে নাসা’র গড্ডারড স্পেস ফ্লাইট সেন্টারের জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানী রেজিনা কাপুটো জানান, “আমরা জানি না”!
তিনি বলেন, “আমরা জানি এটি কি না!
এটি সাধারণ কোন বস্তু যেমন প্রোটন, নিউট্রন, ইলেকট্রন অথবা নিউট্রিনো থেকে তৈরি হয়নি। আমরা জানি এটি স্থিতিশীল। আমরা জানি এটি চার্জিত নয়।”


তাহলে এটির সংজ্ঞা যদি বলতে হয় তাহলে আমরা বলতে পারি, ডার্ক ম্যাটার এমন এক পদার্থ যে পদার্থ সম্পর্কে আমরা প্রায় কিছুই জানি না!
জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানী কাপুটোর মত ডার্ক ম্যাটারকে বেশিরভাগ বিজ্ঞানীই নন-বেরিয়নিক পদার্থ ভেবে থাকেন।
বেরিয়নিক পদার্থ হচ্ছে সেগুলো যেগুলো প্রোটন, নিউট্রন, ইলেকট্রনের সমন্বয়ে গঠিত; আর নন-বেরিয়নিক হচ্ছে তারা যারা এগুলোর সমন্বয়ে গঠিত নয়।
অর্থাৎ বুঝা যায় এটি আসলেও অনেক বেশি রহস্যঘেরা, কিন্তু এই রহস্য একটি গুরুত্বপূর্ণ রহস্য তা আশা করি বুঝতে পারছেন।
যেহেতু মহাবিশ্বের একটি বড় অংশতেই আছে ডার্ক ম্যাটার।
ডার্ক ম্যাটার নিয়ে গবেষণা
ডার্ক ম্যাটার সাধারণ পদার্থ থেকে ব্যতিক্রম, আর একে নিয়ে বেশ কিছু পরীক্ষা নিরিক্ষা চলছে।
আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশনের সংবেদনশীল কণা সনাক্তকারী আলফা চৌম্বকীয় স্পেকট্রোমিটার (এএমএস), এটি ২০১১ সালে প্রতিষ্ঠার পর হতে কাজ করে আসছে।
ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজির (MIT) নোবেল বিজয়ী এএমএসের শীর্ষস্থানীয় বিজ্ঞানী স্যামুয়েল টিং (Samuel Ting) স্পেস ডটকমকে জানান, এএমএস তার ডিটেক্টরগুলিতে 100 বিলিয়নেরও বেশি মহাজাগতিক রশ্মি আবিষ্কার করেছে।


ইউরোপীয় মহাকাশ সংস্থার(ESA) প্ল্যাঙ্ক মহাকাশযানটি(Planck Spacecraft) ২০০৯ সালে চালু হওয়ার পর থেকেই মহাবিশ্বের মানচিত্র তৈরি করে চলেছে।
আরও পড়ুন: “মিশিও কাকু : বর্তমান বিশ্বের জনপ্রিয় এক পদার্থবিজ্ঞানী”
মহাবিশ্বের ভর কীভাবে ইন্টারঅ্যাক্ট বা মিথস্ক্রিয়া করে তা পর্যবেক্ষণ করে মহাকাশযানটি ডার্ক ম্যাটার এবং এটিরঅংশীদার, ডার্ক এনার্জি উভয়ই তদন্ত করতে পারে।
এছাড়াও রয়েছে আইসকিউব নিউট্রিনো অবজারভেটরি, যা অ্যান্টার্কটিকার বরফের নিচে অবস্থিত একটি গবেষণা।


ডার্ক ম্যাটার নিয়ে কিছু প্রশ্ন!
আচ্ছা বলুন তো ডার্ক ম্যাটার কি কৃষ্ণগহ্বর বা ব্ল্যাক হোলের এর মধ্যে থাকে?
এর উত্তর হচ্ছে না। কারণ হচ্ছে, এতে করে কাছাকাছি থাকা অন্যান্য নক্ষত্রদের উপর এত এত কৃষ্ণগহ্বরের মহাকর্ষীয় প্রভাব আমাদের এতদিনে শনাক্ত করার কথা!
তাহলে এটি কি হতে পারে, ডার্ক ম্যাটার নক্ষত্রমণ্ডল বা কোন গ্যালাক্সির অংশ-দুর্বিনীত কোন গ্রহ, গ্রহাণু কিংবা ধূমকেতু, যাদের নিজস্ব কোন আলো নেই?
মহাবিশ্বে নক্ষত্র থেকে ৬ গুণ বেশি ভরের কোন গ্রহ থাকাটা আসলে বিশ্বাসযোগ্য নয়। এর কারণ হচ্ছে প্রতিটি গ্যালাক্সির মাঝে থাকা এত এত নক্ষত্রের প্রতিটির জন্য প্রায় ৬ হাজার করে বৃহস্পতি গ্রহ থাকতে হবে! আরও অবাক করা ব্যাপার, এমনটা হলে আমদের সৌরজগতের জন্যই দরকার আরও অন্তত দুই মিলিয়ন বা বিশ লাখ পৃথিবী! কারণ সূর্য ছাড়া আমাদের সৌরজগতে দৃশ্যমান ভরের আর যত বস্তু আছে, এদের সবার ভর যোগ করলেও মোট পরিমাণ সূর্যের ভরের ৫০০ ভাগের ১ ভাগেরও কম হয়।
এটি কি তাহলে ডার্ক গ্যাসমেঘ?
এরও উত্তর হচ্ছে না। এমন হলে এরা পিছন থেকে আসা নক্ষত্রকে শুষে নিত কিংবা অন্য কোনভাবে এদের সাথে ইন্টারেক্ট বা মিথস্ক্রিয়া করত। কিন্তু ডার্ক ম্যাটারের ক্ষেত্রে এর কোনটিই দেখা যায় না!
তো এই হচ্ছে ডার্ক ম্যাটার নিয়ে সংক্ষেপে লেখা ১ম পর্ব, পরের পর্বে ইনশাআল্লাহ্ জানানো হবে ডার্ক এনার্জি সম্পর্কে, ডার্ক ম্যাটার ও ডার্ক এনার্জির মধ্যে তুলনা ইত্যাদি!
ফিচার ছবিসূত্র: লেখকের নিজস্ব সংগ্রহ
তথ্যসূত্র:
- Nasa
- Space
- Enotes
- Encyclopædia Britannica
- বই: Astrophysics for People in a Hurry; মূল লেখক: Neil deGrasse Tyson, বাংলা অনুবাদক: আবুল বাশার ও উচ্ছ্বাস তৌসিফ
সম্পর্কিত নিবন্ধসমূহ: