- বিচিত্র মানুষের বিচিত্র স্বভাব নিয়ে ব্যোমকেশের চিড়িয়াখানা - February 16, 2021
- রুলার অফ দ্য ওয়ার্ল্ড: মুঘল সাম্রাজ্যের স্বর্ণালী যুগের কারিগর সম্রাট আকবর - February 13, 2021
- ফ্রিডম অ্যাট মিডনাইট: দেশভাগের এক পূর্ণাঙ্গ আখ্যান - February 4, 2021
বাংলাদেশের রাষ্ট্র হিসেবে যে যাত্রা, তার চলার পথ কিন্তু সর্বদা মসৃণ ছিল না! আমাদের গুরুজনেরা তাদের অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান দ্বারা এই দেশকে তার চলার ট্র্যাকে রাখার চেষ্টা করেছেন। কেউ ছিলেন শিক্ষাক্ষেত্রে, কেউ সংস্কৃতি, কেউবা দেশের বিজ্ঞানচর্চাকে ত্বরান্বিত করার চেষ্টা করে গেছেন। এই সম্পূর্ণ ধারাবাহিকে আমরা বাংলাদেশের এমন কিছু মানুষকে পাঠকদের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করবো। আজ প্রথম পর্বে থাকছে প্রয়াত অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী স্যারের জীবন এবং কর্ম সম্পর্কে।
জন্ম এবং প্রারম্ভিক জীবন
জামিলুর রেজা চৌধুরী ব্রিটিশ শাসনাধীন আসামের সিলেট জেলায় ১৯৪৩ সালের ১৫ নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেন । তাঁর পিতা আবিদ হাসান ছিলেন আসামের বাসিন্দা। তিনি নিজে ছিলেন একজন পুরকৌশল প্রকৌশলী এবং বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড সাইন্স ইউনিভার্সিটি থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করা প্রথম বাঙালি মুসলিম। তাঁর মায়ের নাম হায়াতুন্নেসা। তাঁর পুরো পরিবার দেশভাগের পরে আসামের হাইলাকান্দি থেকে থেকে ময়মনসিংহে চলে আসেন ১৯৫০ সালে। তখন তাঁর বয়স মাত্র ৭ বছর।
শিক্ষাজীবন
ময়মনসিংহে জামিলুর রেজা চৌধুরীর আনুষ্ঠানিক শিক্ষাজীবন শুরু হয়। সেখানে ময়মনসিংহ জিলা স্কুলে তিনি ভর্তি হন। এরপরে ১৯৫২ সালে তাঁর পুরো পরিবার ময়মনসিংহে থেকে ঢাকায় চলে আসেন। সেখানে জামিলুর রেজা চৌধুরী নবাবপুর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। তারপরে আরেকবার জামিলুর রেজা চৌধুরী নিজের স্কুল পরিবর্তন করেন এবং ক্যাথলিক ধর্মগুরু কর্তৃক পরিচালিত সেন্ট গ্রেগরি হাই স্কুলে ১৯৫৩ সালে ভর্তি হন। ১৯৫৭ সালে তিনি মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হন। তারপরে তিনি উচ্চমাধ্যমিকে ঢাকা কলেজে ভর্তি হন। এখান থেকে তিনি ১৯৫৯ সালে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।
এবার তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে (বর্তমানে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগে ভর্তি হন। এরই মধ্যে ১৯৬২ সালে এই আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ তৎকালীন নির্বাহী নির্দেশক্রমে বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে উন্নীত হয়। নামকরণ করা হয় ইস্ট পাকিস্তান ইউনিভার্সিটি অফ ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি (ইপুয়েট)। এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি ১৯৬৩ সালে প্রথম শ্রেণিতে স্নাতক সম্পন্ন করেন।
জামিলুর রেজা চৌধুরীর বর্ণাঢ্য কর্মজীবন
স্নাতক পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের সাথে সাথেই জামিলুর রেজা চৌধুরী অনানুষ্ঠানিকভাবে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন নিজের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই। ১৯৬৩ সালের নভেম্বরে আনুষ্ঠানিকভাবে তাঁর নিয়োগ চূড়ান্ত হয়। তিনি পুরকৌশল বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন, যেখানে তিনি নিজের শিক্ষাজীবন অতিবাহিত করেছেন।
স্নাতকোত্তর এবং পিএইচডি
১৯৬৫ সালে জামিলুর রেজা চৌধুরী বৃত্তি নিয়ে যুক্তরাজ্যের সাউদাম্পটন বিশ্ববিদ্যালয়ে যান। সেখানে তিনি Advanced Structural Engineering বিষয়ে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। তাঁর স্নাতকোত্তর থিসিসের বিষয় ছিল Cracks in Concrete Beam using Computer Aided Design. স্নাতকোত্তর সমাপ্ত করার পরে তিনি এখানেই থেকে যান এবং তাঁর ডক্টরেট শুরু করেন এবং ১৯৬৮ সালে এখান থেকে পিএইচডি লাভ করেন। তাঁর পিএইচডি এর মূল বিষয় ছিল Shear Wall and Structural Analysis of High Rise Building।
পিএইচডির অংশ হিসেবে তিনি হাই-রাইজ দালানগুলোর ভূমিকম্প সহনশীলতা পরিমাপের জন্য একটি সহজ পদ্ধতি প্রয়োগ করেন। তাঁর নামানুসারে এই পদ্ধতি ‘কউল অ্যান্ড চৌধুরী’ নামে পরিচিত। ভূমিকম্প সহনশীলতা পরিমাপের এই পদ্ধতি বিশ্বজুড়ে প্রায় সমস্ত জায়গায় পুরকৌশল পাঠ্যক্রমের অংশ।
বুয়েটে দায়িত্ব পালন
১৯৬৮ সালের শেষদিকে তিনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে আসেন এবং ইপুয়েটের পুরকৌশল বিভাগে একজন সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। এরই মধ্যে ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হয় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম বদলে বুয়েট হয়। পরবর্তীতে ১৯৭৩ সালে তিনি সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতি পান এবং এবং ১৯৭৬ সালে অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতি পান।
এরই মধ্যে ১৯৭৫ সালে তিনি কমনওয়েলথ স্টাফ ফেলোশিপ বৃত্তি পান তাঁর পোস্ট ডক্টরালের জন্য। তাই জামিলুর রেজা চৌধুরী ১ বছরের জন্য যুক্তরাজ্যের সারে বিশ্ববিদ্যালয়ে যান। ১৯৭৬ সালের শুরুর দিকেই তিনি দেশে ফিরে আসেন।
১৯৭৮-৭৯ এবং ১৯৮১-৮৩ সালে জামিলুর রেজা চৌধুরী বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের বিভাগীয় প্রধান এবং ১৯৮৩-৮৫ সালে তিনি পুরকৌশল অনুষদের ডিন হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পাশাপাশি ১৯৮২ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ দশ বছর বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সেন্টারের পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। একজন পুরকৌশল প্রকৌশলী হওয়া সত্ত্বেও তিনি অত্যন্ত সফলতা এবং দক্ষতার সাথে নিজের দায়িত্ব পালনে সফল হন। ২০০১ সালে জামিলুর রেজা চৌধুরী বুয়েট থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে অবসরে যান।
অবসর-পরবর্তী জীবন
অবসর মানেই যে থেমে যাওয়া নয়, তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ হলেন জামিলুর রেজা চৌধুরী। অবসর গ্রহণের পরেই ২০০১ সালে তিনি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য হিসেবে যোগ দেন। সেখানে ২০১০ পর্যন্ত তিনি দায়িত্ব পালন করেন। ২০১০ সাল থেকে আমৃত্যু তিনি ইউনিভার্সিটি অফ এশিয়া প্যাসিফিকে উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
আরো পড়ুন: প্রণব মুখার্জি: এক বর্ণাঢ্য জীবনের পরিসমাপ্তি
জামিলুর রেজা চৌধুরী এবং বাংলাদেশের আইটি খাত
যদিও জামিলুর রেজা চৌধুরী ছিলেন একজন পুরকৌশল প্রকৌশলী, তা সত্ত্বেও বাংলাদেশের আইটি খাতে তিনি ব্যাপক অবদান রাখেন। বাংলাদেশ সরকারের আইটি খাতের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৯৭ সাল থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সফটওয়্যার রপ্তানি আইটি অবকাঠামো উন্নয়ন সংক্রান্ত টাস্কফোর্সের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশ সরকারের আইটি পলিসি বাস্তবায়ন কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন। ২০০৮ সালে নির্বাচন কমিশনের ছবি যুক্ত ভোটার আইডি কার্ড তৈরির মহাযজ্ঞে তিনিও শামিল ছিলেন।
বাংলাদেশ সরকারের প্রস্তাবিত ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ প্রকল্পে তিনি বাস্তবায়ন কমিটির একজন সদস্য হিসেবে ছিলেন।
জামিলুর রেজা চৌধুরী এবং বাংলাদেশের অবকাঠামো খাত
বাংলাদেশের অবকাঠামো খাতে জামিলুর রেজা চৌধুরী এক অপরিহার্য নাম। বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী প্রায় সকল বড় ধরনের উন্নয়ন প্রকল্পে তাঁর প্রত্যক্ষ অবদান রয়েছে। একাধিক জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে প্রকল্প পরিচালনার মত দুরূহ কাজ তিনি সম্পাদন করেছেন। ১৯৯৩ সালে বাংলাদেশের ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড বাস্তবায়ন কমিটির তিনি সদস্য ছিলেন।
ঘূর্ণিঝড়ে আক্রান্তদের জন্য তৈরি পুনর্বাসন প্রকল্পের মাস্টারপ্ল্যানের তিনি প্রধান ছিলেন। বাংলাদেশের ভূমিকম্প ঝুঁকি বিবেচনা করে তিনিই প্রথম বাংলাদেশের সিসমিক জোন মানচিত্র তৈরি করেন।


বঙ্গবন্ধু যমুনা বহুমুখী সেতুর পরামর্শদাতা কমিটির তিনি প্রধান ছিলেন। তাঁর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশ সরকার এবং জাপানের অর্থায়নে এই মেগা প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়।


বাংলাদেশ সরকারের আরো অন্যান্য মেগা প্রকল্পে তিনি পরামর্শদাতা হিসেবে যুক্ত ছিলেন। কর্ণফুলী টানেল মেগা প্রকল্প, ২১ কিলোমিটার দীর্ঘ প্রথম ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, ২৪ কিলোমিটার দীর্ঘ ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে এবং অতি অবশ্যই পদ্মা সেতু প্রকল্প এদের অন্তর্ভুক্ত। এসমস্ত মেগা প্রকল্পে তিনি নিজের কর্মদক্ষতা প্রমাণ করেছেন বারংবার।
ভাবমূর্তি
পুরো কর্মজীবনে জামিলুর রেজা চৌধুরী নিজের এক পরিচ্ছন্ন এবং নিরপেক্ষ ভাবমূর্তি বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। ফলশ্রুতিতে তিনি বহু সরকারি এবং বেসরকারি সংবেদনশীল উচ্চপর্যায়ের প্রকল্পে দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৯৬ সালের নির্দলীয় তত্তাবধায়ক সরকারের একজন উপদেষ্টা হিসেবে তিনি দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৬ থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের প্রধান হিসেবে তিনি দায়িত্ব পালন করেন। প্রতিষ্ঠাকাল থেকে মৃত্যু পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াডের সভাপতি ছিলেন। এছাড়া তিনি বাংলাদেশ কম্পিউটার সোসাইটির সভাপতি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। প্রতি পদে যেমন নিজের কর্মদক্ষতা প্রমাণ করেছেন, ঠিক তেমনি নিজের নিরপেক্ষতারও পরিচয় দিয়েছেন।
সম্মাননা
বর্ণাঢ্য জীবনের স্বীকৃতিস্বরূপ জামিলুর রেজা চৌধুরী বহু জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। ১৯৯৭ সালে ডঃ এম এ রশিদ গোল্ড মেডেল এবং ১৯৯৮ সালে আইইবি গোল্ড মেডেল লাভ করেন। এরই সাথে ২০০৫ সালে বাংলাদেশ কম্পিউটার সোসাইটি গোল্ড মেডেল এবং ২০১২ সালে খান বাহাদুর আহসানউল্লাহ গোল্ড মেডেল অর্জন করেন। বাংলাদেশের মেগা উন্নয়ন প্রকল্পসমূহে তাঁর অবদানের জন্য ২০১৩ সালে তিনি ‘জাইকা’ কর্তৃক রিকগনিশন অ্যাওয়ার্ড পান।
বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি বিষয়ে তাঁর অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাঁকে ২০১৭ সালে একুশে পদক দ্বারা সম্মানিত করে।
২০১৮ সালে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে সম্মানজনক ‘জাতীয় অধ্যাপক’ হিসেবে ভূষিত করে। ঐ বছরেই জাপান সরকার তাঁকে সম্মানসূচক ’অর্ডার অফ দ্য রাইজিং সান’ পদকে ভূষিত করে।
জামিলুর রেজা চৌধুরীর মৃত্যু
মহান কর্মবীর জামিলুর রেজা চৌধুরী ২০২০ সালের ২৮ এপ্রিল ভোররাত্রে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে ৭৭ বছর বয়সে ধানমণ্ডিস্থ নিজের বাসায় মৃত্যুবরণ করেন। ধানমণ্ডি ইদগাহ মসজিদে জানাজার নামাজ শেষে তাঁকে বনানী বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে দাফন করা হয়।
যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে উন্নয়নের মহাসড়কে নিয়ে আসার মূল অস্ত্র ছিল অবকাঠামো উন্নয়ন। এই অবকাঠামো উন্নয়নের প্রাণভোমরা ছিলেন জামিলুর রেজা চৌধুরী। একজন শিক্ষক, গবেষক, প্রশাসক, পরামর্শদাতা, প্রকৌশলী; সকল চরিত্রে তিনি নিজেকে সফল হিসেবে প্রমাণিত করেছেন। তাঁর মৃত্যুতে দেশ একজন গুণী নির্মাতাকে হারিয়েছেন। তাঁর মত বহুমুখী প্রতিভাসম্পন্ন মানুষে ভরপুর হয়ে যাক আমাদের বাংলাদেশ, এই আজকের দিনের প্রত্যাশা।
পরবর্তী পর্বে ফিরে আসবো বাংলাদেশের অন্য কোনো গুণী ব্যক্তিকে নিয়ে। চোখ রাখুন অসামান্যতে মোঃ রেদোয়ান হোসেনের লেখায়।
তথ্যসূত্র –
ফিচার চিত্রসূত্র – Wikimedia Commons
অনেক ভালো লিখা।
আমাদের জন্য তিনি পদপ্রদর্শক।
ধন্যবাদ আপনাকে মূল্যবান মতামতের জন্য, আসলেই তিনি বাংলাদেশের জন্য একজন পথপ্রদর্শক।