- বরফ গলা নদী: জহির রায়হানের লেখনীতে নিম্ন মধ্যবিত্তের দুঃখগাথা - October 11, 2020
- জাগরী – রাজনৈতিক উপন্যাসে স্নেহ ও আদর্শের মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব - August 13, 2020
জাগরী
সতীনাথ ভাদুড়ী
(রবীন্দ্র পুরস্কার প্রাপ্ত ১৯৫০)
প্রথম প্রকাশ -১৯৪৫
চরিত্র ও প্রেক্ষাপট
জাগরী উপন্যাসের পটভূমি ১৯৪২ সালের গণ-আন্দোলন। জাগরী একজন গান্ধিবাদী বাবা, দুই ছেলের একজন সোশ্যালিস্ট তথা সমাজতন্ত্রী (বিলু) আর একজন কমিউনিস্ট মতাদর্শে বিশ্বাসী (নীলু) আর স্বামীর আজ্ঞাবাহী শাশ্বত স্নেহময়ী মাতা এই চারটি প্রধান চরিত্রের নিয়ে উত্তম পুরুষে রচিত রাজনৈতিক উপন্যাস। জাগরী শুধু রাজনৈতিক উপন্যাস নয় এটি স্নেহ আর আর্দশের মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বের গল্প।
জাগরী উপন্যাসে, বিলু মাতা পিতা তিনজনে জেলের বিভিন্ন সেলে বন্দি আর নীলু জেলগেটে। জাগরী কারাগারে, আসামি কথিত নিছক বর্ণনা নয়; বরং আত্মদর্পণে দেখা জীবনী।
বিলুর ফাঁসিকে ঘিরে উপন্যাসটি আর্বতিত হলেও সব থেকে চমৎকার দিক হচ্ছে এর প্লট বিন্যাস। লেখক উপন্যাসটিকে চারভাগে ভাগ করে প্রত্যেকের নিজস্ব মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব আর স্মৃতিচারণ ব্যাখ্যা করেছেন– যেখানে একটা শব্দ থেকে আরেকটি প্লট জন্ম নিয়েছে। তাই বর্ণনাভঙ্গি আর চারটা যেকোনো উপন্যাস থেকো ভিন্ন। উপন্যাসে সবাই প্রতীক্ষা করছে একটি রাত্রি অবসানের জন্য, যা বিলুর ফাঁসি নিয়ে আসবে।


আত্মকেন্দ্রিক বিলু চরিত্র
প্রকৃতিপ্রেমিক, কবিমনা বিলুর আত্মকথন দিয়ে উপন্যাসের শুরু। বিলু ফাঁসির সেলে বসে তার জীবনের শেষ বিকালটা উপভোগ করে। আর স্মৃতিচারণ করে, ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠা- নিজের আর প্রিয় অনুজ নীলুর, দুজনের দুরন্ত শৈশব।
দুজনের মায়ের ডান কোলে নিজের অধিকার রাখবার চেষ্টা, আপনার শৈশবে নিয়ে যাবে। উপন্যাসে বিলুর অনুভূতি প্রকাশ অসাধারণ মাত্রা দিয়েছে । যেমন :
“ফাঁসির মঞ্চ কথাটিকেও যেন কত শহীদের স্মৃতির সুবাস ঘিরিয়া আছে, কিন্তু উহাকেই ‘ফাঁসিকাঠ ‘ বলো, মনে পড়িবে খুনী আসামীর কথা।”
ফাঁসির আসামির শেষ ইচ্ছা কী বিলু জানায় নি। আত্মকরুণার কোনো প্রশ্রয়ই সে দিতে গররাজি। বিলুর ফাঁসির সাক্ষ্য দিয়েছিল তার ভাই নীলু; তাও নীলু সম্পর্কে বিলু কোনো অভিযোগ উত্থাপন করে নি।
“নীলু আমার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়া নিজের কর্তব্য করিয়াছে। কোন আত্মসম্মানশীল, সত্যনিষ্ঠ রাজনৈতিক কর্মীর ইহা ছাড়া কোন গত্যন্তর ছিল না।”
বিলুর জীবন একটা আক্ষেপ দেখা যায়, “আমার কথা কে মনে রাখবে? প্রতিবেশীরাও বোধহয় আগামী সপ্তাহে ভুলে যাবে। যা কিছু করিবার চেষ্টা করিয়াছি তাহা একেবারে ব্যর্থ হয়ে গেছে। কেহ জানিবে না, কেহ শুনিবে না, কেহ দু-ফোঁটা তপ্ত অশ্রু ফেলিবে না। সাধারণ এক কর্মীর রাজনৈতিক বলিদান কে স্মরণে রাখবে?” বিলুর এই মনোভাবের জন্য বইটির উৎসর্গপত্র সবার হৃদয় ছুঁয়ে যাবে।
যে সকল অখ্যাতনামা রাজনৈতিক কর্মীর
কর্মনিষ্ঠা ও স্বার্থত্যাগের বিবরণ, জাতীয়
ইতিহাসে কোনদিনই লিখিত হইবে না,
তাদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে-


মার স্মৃতির স্রোতে আত্মকথন
মা চরিত্রটি রাজনীতির কিছু না বুঝলেও, স্বামীর সিদ্ধান্তে ও ইচ্ছায় উপন্যাসে কংগ্রেস মাতা রূপে প্রতিষ্ঠিত। তাই তাঁর ভাবনা জুড়ে রাজনীতির থেকে সন্তান আর পরিবারই প্রাধন্য পেয়েছে। স্বামী সম্পর্কে তার মতো ‘তুমি দেশের স্বাধীনতার জন্য সব ছেড়েছ সত্যি-কিন্তু আমাকে তো একটুও স্বাধীনতা দাও নি।’ এছাড়াও গান্ধীজী নিয়ে তার তীব্র অভিযোগ দেখা যায়। তার মতে, ছেলে ভুলানো রাজনীতি তার সংসারের ক্ষতি করেছে।
পিতা ও নীলু
নীলু বলিষ্ঠ, ঋজু,নিজের মতে বিশ্বাসে স্থির,অপরের মনে আঘাত লাগল কিনা,নিজের মত প্রলাশের সময় সে সম্পর্কে আদৌ চিন্তিত নয়। উপন্যাসে নীলু চরিত্রটি এভাবে শুরু হয়েছে,জেলগেটে ভোরের অপেক্ষা করছে, তার ভাইয়ের লাশের জন্যে। নীলু সাক্ষ্য দেয়ায়, দাদা যে তাকে ভুল বুঝবে না, তাই নীলুর বিশ্বাস, কারণ হিসাবে উল্লেখ করেছে
“পৃথিবী আমার সম্পর্কে যাহা ইচ্ছা ভাবুক,দাদা আমার মনোভাব ঠিক বুঝবে;সেখানে যে সংকীর্ণতা লেশ নেই।’’
এটা বিশ্বাস করলেও সে এক গভীর যাতনা অনুভব করে। পিতার সাথে পুত্রে দূরুত্ব বাস্তবে যেমন প্রতীয়মান, উপন্যাসেও ঠিক তেমনটি দেখা গেছে। আসলে বাবা চরিত্রটি কারো সাথে একাত্ম হতে পারে নি। তাই নিজের মতে একটা অনুশোচনার কালো ছায়া ভেসে উঠে – ‘বোধহয় আমার ছেলেদেরকে যতটা ভালোবাস উচিত, ততটা গভীরভাবে স্নেহ করি না।’ সামগ্রিকভাবে পিতা চরিত্রটিতে কর্তৃত্বপরায়ণ দিকই উজ্জ্বল।
‘জাগরী’ স্বতন্ত্র, বিশিষ্ট ও অনবদ্য রচনা। উপন্যাসিক সতীনাথ ভাদুরীর প্রতক্ষ্য রাজনৈতিক অংশগ্রহণ উপন্যাসকে বাস্তবমুখী করেছে । ভারতের স্বাধীনতাকালে একটি পরিবারের রাজনৈতিক আন্দোলনে অংশগ্রহণ এবং মানবচরিত্রের বিশ্লেষণ , লেখক সতীনাথ ভাদুড়ী নিপুণভাবে ফুটে তুলেছেন। পিতার গান্ধিবাদী মতাদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়ে বিলু ও নীলুর সোশ্যালিস্ট আর ফ্যাসিবিরোধী ভাবধারায় অনুপ্রাণিত হওয়ার কারণ, নীলু কেন সাক্ষ্য দিয়েছিল, আর বিলুর ফাঁসি কি হয়েছিল তা জানতে হলে বইটি পড়ুন।
সুচয়নী পাবলিশার্স থেকে অন্য অনেক সংস্করণের মতোই আরেকটি সংস্করণে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মিল্টন বিশ্বাসের লেখা ভূমিকা ও আলোচনা সুখপাঠ্য ও চিন্তার গভীরতায় দাগ কাটে। তেমনি ঘটনাপ্রবাহের নিখুঁত বিশ্লেষণ আপনার উপলব্ধি করার ক্ষমতাকে শাণিত করবে।


[…] আরও পড়ুন: জাগরী – রাজনৈতিক উপন্যাসে স্নেহ ও আদ… […]