- ঘড়ি ও এর কারিগরদের গল্প: হোউট হরোলজি - September 14, 2020
“সময়”– সবার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। অনেকের কাছে এই সময় যে যন্ত্রে দেখা হয়, তার গুরুত্বও কম নয়। ঘড়ি তাই যুগ যুগ ধরে মানুষের হাতে, পকেটে শোভা পাচ্ছে সময়ের প্রদর্শক হিসেবে। কিন্তু সব ঘড়িই কি সাধারণের জন্যে তৈরি? না! শৌখিন মানুষদের মনের চাহিদা মেটাতে যুগ যুগ ধরে চলে আসছে বিলাসবহুল ঘড়ি তৈরির চর্চা। এগুলো যেন ঘড়ি না, লিওনার্দোর আঁকা ছবি অথবা দান্তের শব্দবুননের মত একটি শিল্প যা হাতে ধরা যায়, পরাও যায়। তাহলে চলুন পাঠক ঘুরে আসি ঘড়িশিল্প বা হোউট হরোলজি (Haute Horology) এর দুনিয়া থেকে।
ঘড়ি তৈরির শুরুর কথা
১৯৭০ এর দশকে ঘড়ির বাজারে কোয়ার্টজ ঘড়ির (যে ঘড়িতে তড়িৎকম্পন যন্ত্র এবং ক্রিস্টাল কোয়ার্টজ ব্যবহৃত হয় সময়ের হিসাব রাখতে) একটা জোয়ার আসে। সকল ঘড়ির ব্র্যান্ড এই কোয়ার্টজ ব্যবহার করা শুরু করে এবং এর ফলে একটি ঘড়ি বানানোর প্রয়োজনীয় সময় নাটকীয় ভাবে কমে আসে। ফলে ঘড়ি কমদামী ও সহজলভ্য হয় আগের থেকে। কিন্তু যেসকল ঘড়ি নির্মাতা হাতে বানানো মেকানিক্যাল ঘড়ি তৈরি করতেন, তারা চাননি কোয়ার্টজে পরিবর্তন করতে। কেননা, এতে ঘড়ির শিল্পমূল্য কমে যায়। তারা চাচ্ছিলেন তাদের হাতে তৈরি উচ্চমানের যান্ত্রিক ঘড়ি আর স্বল্পমূল্যের কোয়ার্টজ ঘড়ির মধ্যে পার্থক্যসূচক একটা নাম রাখতে, সেখান থেকেই আসে Haute Horology বা উৎকৃষ্ট ঘড়িশিল্পের।
Haute শব্দটি ফ্রেঞ্চ থেকে আগত, এর অর্থ উৎকৃষ্ট বা সেরা। আর Horology অর্থ সময় এবং ঘড়ি সংক্রান্ত পড়াশুনা। তাহলে Haute Horology বলতে আমরা বুঝতে পারি, মানুষের হাতে তৈরি সবচেয়ে উৎকৃষ্ট ঘড়ি যেগুলো বানানো হয় হাতে, যার ভেতরে থাকে না কোন বৈদ্যুতিক অংশ, পুরোটাই যান্ত্রিকভাবে কাজ করে। ৭০ এর দশকের সুইস ঘড়ি প্রস্তুতকারকেরা এই নামের প্রবর্তক।
উন্নত ঘড়ি শিল্পের হর্তাকর্তা (FHH)
সেসময়কার সুইস ঘড়ি প্রস্তুতকারকেরা তৈরি করে ফাউন্ডেশন হাই হরোলজি (Fondation De La Haute Horlogerie)। এ সংঘকে বলা যায় উন্নত ঘড়ি শিল্পের হর্তাকর্তা। ফুটবলের দুনিয়ায় যেমন ফিফা, ক্রিকেটের দুনিয়ায় যেমন আইসিসি, ঘড়ির দুনিয়ায় তেমন এই FHH। এই সংঘের সদস্যপদ পেলেই কোন প্রস্তুতকারক নিজেদের হোউট হরোলজি নির্মাতা হিসেবে দাবি করতে পারে। আর পুরো দুনিয়ায় এটার মান নিরীক্ষণ, রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বও এই সংঘের। সুইজারল্যান্ডের জেনেভা শহরে এর সদর দপ্তর অবস্থিত। উন্নত ঘড়ি নির্মাণের মানদণ্ড হিসেবে এই সংঘ প্রণীত সাদা কাগজ বা White Paper পুরো বিশ্বে ব্যবহৃত।
এই WhitePaper অনুযায়ী নিচের ৭টি ক্ষেত্রে FHH ঘড়ি প্রস্তুতকারক সংস্থাগুলোকে পরিমাপ করে-
১। Research & Development Production- ঘড়ির প্রস্তুতি ও উন্নতিতে কি পরিমাণ গবেষণা করা হয়, এর পাশাপাশি তৈরিকরণে কি পরিমাণ সময় ব্যয় করা হয়, কতটা নিখুঁত হয় এর কারিগরি, এটাই মূলত দেখা হয় এই ক্ষেত্রে।
২। Style and Design- ঘড়ির নকশা ও স্টাইলের সূক্ষ্মতা এ ক্ষেত্রের বিবেচ্য বিষয়। বলাই বাহুল্য, এ ক্ষেত্রটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ Houte Horology হওয়ার জন্যে।
৩। History and DNA- এটি আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ এবং বলা যায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক। কেননা FHH তাদের ইতিহাস এবং ঐতিহ্য রক্ষায় খুবই সচেতন। তাই শুধুমাত্র যেসকল প্রস্তুতকারক শুধুমাত্র উন্নতমানের ঘড়ি প্রস্তুত করে, তারাই শুধু এর যোগ্য বলে বিবেচিত হয়।
৪। Distribution and After-sales Services- উন্নত জিনিসের আদান-প্রদান হতে হবে উন্নতমানের। পাশাপাশি এর বিক্রয় পরবর্তী সেবা এতই ভালো হতে হবে যে, এসকল ঘড়ি যেন কয়েক পুরুষ ধরে ব্যবহার করা যায়। (বিশ্বাস না হলে সামনেই জানতে পারবেন বিস্তারিত!)
৫। Collectors- এসকল ঘড়ির মূল্য সাধারণত এতই বেশি হয় যে আমজনতার পক্ষে এগুলো কেনা দুরূহ ব্যাপার। এসকল ঘড়ির মূল গ্রাহক হচ্ছেন ধনী ঘড়ি সংগ্রহকারীরা, কাজেই কোন ব্র্যান্ডের ঘড়ি সংগ্রহকারীদের কাছে কত জনপ্রিয় এটাও একটা ক্ষেত্র।
৬। Brand Image- বলাই বাহুল্য, এসকল ঘড়ি বিলাস ও শৌখিনতার প্রতীক, তাই এদের সদস্য ব্র্যান্ডের ইমেজ ও সেই সমমানের হওয়া বাধ্যতামূলক।
৭। Communication- দুনিয়ার বড় বড় ক্রীড়াতারকা, অভিনয়শিল্পী, ব্যবসায়ী, সঙ্গীতজ্ঞদের হাতে প্রায়শই এসকল ব্র্যান্ডের ঘড়ি দেখা যায়, যা তাদের ইমেজ বৃদ্ধি করতে সহায়তা করে। তাই কোন ব্র্যান্ডের যোগাযোগ কতখানি প্রভাবশালী মানুষ/প্রতিষ্ঠানের সাথে, এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
ঘড়ি তৈরির যাচাইপর্ব
FHH শুরুর সময়ে ৮৪টি ঘড়ি প্রস্তুতকারককে আমন্ত্রণ জানানো হয় যাচাই করার জন্যে যে তারা উন্নত ঘড়ি প্রস্তুতকারক কি না। সেখান থেকে ৬৪টি প্রস্তুতকারককে যোগ্য ঘোষণা করা হয়। এখানে উল্লেখ্য, এটি কোন র্যাংক নয়, শুধুমাত্র যোগ্য বা অযোগ্য হিসেবে গণ্য হবে কোম্পানিগুলো। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই যে, এদের বেশিরভাগই সুইস কোম্পানি। কেননা, সুইসরা তাদের ঘড়ির কারিগরিবিদ্যার কারণে বিশ্বখ্যাত। এখন আসুন দেখে আসি কিভাবে ভাগ করা হয়েছে এদেরকে।
১। ঐতিহাসিক: এরা সেসকল ব্র্যান্ড, যারা বছরের পর বছর ধরে উন্নত বিলাসবহুল ঘড়ি প্রস্তুত করে আসছে। এমন কিছু ব্র্যান্ড আছে ইতিহাসে যারা অনেক বছর ধরে ঘড়ি বানানোর পর একসময় বানানো বন্ধ করে দেয়, তারপর নতুন কোনো ব্যক্তি সেই প্রতিষ্ঠান কিনে নিয়ে একই নামে আবার ঘড়ি বানানো শুরু করে। সেই প্রতিষ্ঠান যদি মূল প্রতিষ্ঠাতার ঐতিহ্য ধারণ না করতে পারে, সেক্ষেত্রে তাদের এই ভাগের আওতায় আনা হবে না। উদাহরণ- A. Lange & Söhne, Audemars Piguet, Blancpain, Bovet Fleurier, Breguet, Breitling, Bulgari, Cartier, Chopard, Girard Perregaux, Glashütte Original, H. Moser & Cie, Harry Winston, IWC, Jaeger-LeCoultre, Jaquet Droz, Rolex ইত্যাদি ঘড়ি।
পাটেক ফিলিপ্স ঘড়িকে বলা যেতে পারে ঘড়িদের রাজা। Haute Horology এর দুনিয়ায় এরচেয়ে বড় নাম খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। এসকল ঘড়ির আয়ু এতই বেশি যে পাটেক ফিলিপ্স এর স্লোগান হলো- আপনি কোনো পাটেক ফিলিপ্স এর মালিক হন না, আপনি শুধুমাত্র এটিকে আপনার পরের পুরুষের জন্যে দেখে রাখেন। সবচেয়ে পুরনো পাটেক ফিলিপ্স Grand complication সেই ১৯ শতকে প্রস্তুত করা হয়েছিল যেটি এখনও সময়ের হিসেব রেখে যাচ্ছে। কি পাঠক, এখন বিশ্বাস হলো?
আরও পড়ুন: স্লিপ প্যারালাইসিস: ঘুমের মধ্যে বোবায় ধরা
২। সমসাময়িক: এ সকল ব্র্যান্ডগুলো তুলনামূলক নতুন হলেও, ঘড়ির কারিগরিতে এরাও কম যায় না। বরং বলা যায় বর্তমান সময়ের ব্র্যান্ডগুলো এখনকার শৌখিনদের কাছে বেশ জনপ্রিয়। উদাহরণ- Armin Strom, Ateliers Louis Moinet, Cabestan, Christophe Claret, De Bethune, De Witt, FP Journe, Greubel Forsey, Hautlence, Hublot, HYT, Laurent Ferrier, Maîtres du Temps, MB & F, MCT, Parmigiani ইত্যাদি।


৩। বিলাসবহুল: এ সকল প্রস্তুতকারক শুধু ঘড়ি না এর পাশাপাশি অন্যান্য বিলাসদ্রব্যও প্রস্তুত করেন। উন্নত ঘড়ি তাদের অনেক বিলাসদ্রব্য যেমন চামড়ার পণ্য অথবা লেখার সামগ্রী ইত্যাদির মতন একটি পণ্য। তবে তাই বলে এদের কোনভাবে ছোট করে দেখার উপায় নেই, কেননা উন্নত ঘড়ির জগতে তারাও নিজেদের পায়ের ছাপ রাখতে সক্ষম হয়েছেন। উদাহরণ- Chanel, Hermès, Louis Vuitton, Montblanc ইত্যাদি।


৪। একক প্রস্তুতকারক: সর্বশেষ এই ভাগে আছেন তারা যারা কোন প্রতিষ্ঠান নয় বরং ব্যক্তিগতভাবে অথবা পারিবারিকভাবে ঘড়ি তৈরি করেন। এদেরকে বলা হয় আর্টিসান বা স্বাধীন প্রস্তুতকারক এবং এদের তৈরি ঘড়ি সত্যিকার অর্থেই দুষ্প্রাপ্য। কেননা খুব কম সংখ্যক ঘড়িই এরা তৈরি করেন এবং কিছুক্ষেত্রে ঘড়িগুলো তাদের পরিবারের বাইরে আসে না। তাই এই ঘড়িগুলোর দামও হয় আকাশচুম্বী। উদাহরণ- Andreas Strehler, Antoine Preziuso, Beat Haldimann, Christiaan Van der Klaauw, Grönefeld, Kari Voutilainen, Philippe Dufour, Roger W. Smith। এরা সবাই এককভাবে ঘড়ি তৈরি করতেন এবং বর্তমানে এদের তৈরি খুব কম সংখ্যক ঘড়িই দুনিয়ায় আছে।
শেষ কথা
একটি ঘড়ি যে কত জটিল একটি যন্ত্র হতে পারে, তা হয়তো আমরা কেউ অনুধাবন করি না। এই একেকটি Haute Horology এর পিছনে কী পরিমাণ গণনা এবং প্রকৌশল এর প্রয়োজন হয় তা জানলে সত্যিই অবাক হতে হয়। সময়, চাঁদের অবস্থান এবং চক্র, টোরবিলন্স (একপ্রকার যন্ত্র যা সময়ের হিসাব রাখতে ব্যবহার করা হয়), রিপিটার, ক্রোনোমিটার ইত্যাদি সবকিছুর নিখুঁত সমন্বয়ে অস্বাভাবিক জটিল একটি শিল্প এসকল একেকটি ঘড়ি। যখন আপনি এর একটি হাতে স্পর্শ করবেন, তখন প্রতি ঘড়ির পিছনে দেওয়া শ্রম, সময় এবং উন্নত কারিগরিবিদ্যা স্পষ্ট হয়ে উঠবে ঘড়ি সম্পর্কে কিছু না জানলেও। তাই তো ধনী ও শৌখিন মানুষেরা কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা দিয়ে যুগ যুগ ধরে এসকল ঘড়ি সংগ্রহ করে আসছে।
পাঠক, যদি সম্ভব হয়, জীবনে একবার একটি Haute Horology পরে দেখবেন হাতে, হয়তো সময়ের মূল্যের পাশাপাশি সময় প্রদশর্নকারী যন্ত্রটির মূল্যও বুঝতে পারবেন। আশায় থাকবো আমাদের সবার যেন সেই সৌভাগ্য হয়!
ফিচার ছবিসূত্র: Montredo
দারুণ !
লেখকের প্রথম লেখা পড়েই লেখকের ফ্যান হয়ে গেলাম। আরও লেখার অপেক্ষার থাকবো।
অদ্ভুত!! এখন তো মেকানিক্যাল এক্সপ্লেনেশন জানতে ইচ্ছা করছে!!