- চেনা সমাজের অন্তরালের কিছু কালরূপ নিয়ে – “ওরা কেউ না” - February 7, 2021
- শেষ হয়েও হয়নি শেষ বাংলাদেশী যে মিউজিক ব্যান্ডগুলো - January 26, 2021
ওরা কেউ না শারমিন আহমেদ এর সমকালীন জনরার সামাজিক জীবনবোধের উপর রচিত একটি গল্পগ্রন্থ। ১৭ টি গল্পের সংকলনে রচিত বইটির প্রতিটি গল্পের মাধ্যমে লেখিকা সমাজের মানুষের অন্তরালে লুকিয়ে থাকা কিছু অভিশপ্ত রুপ দেখিয়েছেন। আজ প্রথম দশটি গল্প নিয়ে পাঠক অভিমত তুলে ধরবো। তবে এর মধ্যে কিছু গল্পের জন্য ছোট্ট পাঠক অভিমত যথেষ্ট নয়, প্রয়োজন বিশ্লেষণধর্মী উপস্থাপনা।
গল্প – ক্রীতদাস
গল্পটি একটি মেয়েকে নিয়ে। একটি মেয়ে না বলে যদি বলি একজন ফাঁসির আসামীর পরিবারকে নিয়ে তাহলে বোধ হয় যথার্থ হয়। নিশি,গল্পের প্রধান চরিত্র। গল্পে দেখা যায় সে সাইপ্রাসের একটি এয়ারপোর্টে ফ্লাইটের জন্য অপেক্ষা করছে। অপেক্ষরত অবস্থায় সে তার অতীত নিয়ে ভাবতে গেলে স্মৃতিপটে ফুটে উঠে তার বাবার সাথে তার দারুণ সম্পর্কের দৃশ্যপট। নিশির বাবা তাকে খুব আদর করতো। যা দেখে স্বয়ং তার মা বলতো, ‘অতি আদরে মেয়েকে বিগড়ে দিচ্ছে।’ সুন্দরভাবে জীবন চলছিলো তাদের। কিন্তু সব কিছু নষ্ট হয়ে যায় যেদিন নিশির বাবা গ্রেফতার হন। রাষ্ট্রদ্রোহীতার মামলায় গ্রেফতার করা হয় তার বাবাকে। দুঃসময়ে যাদের পাশে থাকার কথা ছিলো তাদের কাউকে কাছে পায়নি চৌদ্দ বছরের নিশি ও তার মা।
গল্পের মূলভাব ছিলো-সমাজের যে নিয়ম মানার কারণে মানুষ সাধু হয়, নিয়ম পালটে গেলে ঠিক সেই নিয়ম মানার কারণেই সেই মানুষ হয়ে যায় অপরাধী। এক সরকারের আমলে যে হয় বীরউত্তম অন্য সরকারের কাছে সে হয় রাষ্ট্রদ্রোহী। সমাজের এমন নিয়মের ক্রীতদাস হয়ে থাকা মানুষদের সময়ের পরিবর্তনে নিজের এবং পরিবারের প্রামান্যচিত্র ফুটে ওঠে গল্পটিতে।
গল্প – অন্তরালে
মানুষ সামাজিক জীব। কিন্তু সমাজে বাস করা প্রতিটি মানুষই কি সামাজিক? মানুষ সমাজে বাস করতে গিয়ে নিজেদের মধ্যে নানা পদ-পদবী তৈরি করে। আর এই পদের বদৌলতে মানুষ পায় সম্মান, পায় শ্রদ্ধা ও সম্মানের অন্ধবিশ্বাস। লেখিকা এমনি সমাজের কিছু সাধুবেশী শয়তানের রূপ দেখিয়েছেন গল্পটিতে।
বাদশা মিয়া,গল্পের প্রধান চরিত্র। তার পৈতৃক সম্পত্তি এবং বাবার নামের কারণে সমাজের এক শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তি তিনি। কিন্তু সাধারণ মানুষের এই শ্রদ্ধাকে কাজে লাগিয়ে নিজের ব্যক্তি স্বার্থ বহাল রাখেন তিনি। প্রতিদিন বাজারে কিংবা স্কুলের গেইটের উল্টো পাশের এক লাইব্রেরীতে বসে তার লোলপ দৃষ্টিতে আত্মতুষ্টি করেন স্কুলে বাচ্চাদের দিতে আসা মায়েদের শরীর দেখে। সবাই ভাবে সে লাইব্রেরীতে পত্রিকা পড়তে যান। অথচ তা না, তার মূল উদ্দেশ্য তো নারী! মসজিদ কমিটির সভাপতি হওয়ার সুবাধে মাঝে মাঝে এলাকার কিছু বিচার কার্য করতে হয় তাকে। এরকমই বিচার প্রার্থী হিসেবে আসা লায়লা নামের এক মহিলা পরিচিত হন সমাজের এক ভিন্ন বাদশা মিয়ার সাথে।
গল্পটির মূলভাব একটি কথায় প্রকাশ করা যায়,“খ্যাতিমান মানেই সাধুপুরুষ না”।


গল্প – অসমাপ্তের সমাপ্তি
গল্পটি মূলত এক বেখেয়ালি প্রেমিকের। গল্পের প্রধান চরিত্র নাভিদ এবং প্বার্শপ্রধান চরিত্র তার প্রেমিকা মিশু। গল্পে মিশু এবং অন্যান্যরা নাভিদকে বেখেয়ালি ভাবলেও নাভিদ মোটেও ততটা বেখেয়ালি নয়। সময়ের পরিবর্তনে অনেক কিছু সে নিজের মধ্যে রেখে দেয় কাউকে প্রকাশ করতে পারে না। তার এই প্রকাশ না করার অপারগতাকে মিশু বেখেয়ালি ভাবে। এমনকি মিশুর বিয়ের জন্য পাত্র পক্ষ দেখতে আসবে বলে গ্রামে যাওয়ার সময়, রেলস্টেশনে এসেও মিশুকে হাত নেড়ে বিদায় জানাতে পারেনি নাভিদ।
তবে গল্পের শেষে দেখা যায় নাভিদ মিশুকে তুলে আনতে ভৈরব স্টেশনে গিয়ে পৌঁছায়। ভালোবাসা ও মনের অন্তঃদহ মানুষকে পরিবর্তন করে, কাছে আনে তারই বহিঃপ্রকাশ অসমাপ্তের সমাপ্তি গল্পটি।
গল্প – কান্টু
গল্পটির মাধ্যমে লেখিকা শহীদ মিনারকে ঘিরে বাস করা কিছু কাকের চোখে মানুষের জীবনপ্রবাহ দেখিয়েছেন। এদের মধ্যে এক কাক শাবক, কান্টু, গল্পের প্রধান চরিত্র। কাক সমাজের সমঝোতার নীতি দেখিয়ে লেখিকা মানুষের মাঝে যে ভেদাভেদ, হানাহানির বীজ কিভাবে মানুষ নিজেই নিজের ভবিষ্যত প্রজন্মের মাঝে বুনে দিচ্ছে তারই বহিঃপ্রকাশ করেছেন গল্পটিতে। তবে কান্টুর সাথে এক অঘোষিত ঘরবন্দি মানুষের ভাষাহীন কথাবার্তা গল্পটিকে অন্যমাত্রায় নিয়ে গেছে।
গল্প – কালঘুম
আমাদের সমাজের অতলে ডুবে থাকা ভয়ংকর সত্য হচ্ছে কালঘুম গল্পটি। গল্পে দেখা যায় এক পরিবারে তিন ছেলে মেয়ে নিত্যদিন মুখ বুঝে দেখে যায় বাবার হাতে মায়ের মার খাওয়া। এতে করে বাড়ির ছোট ছেলেটির এমন দশা হয় যে মায়ের গুনগুন কান্নার শব্দ না শুনলে তার ঘুম হয় না। এমনকি এই রোগ স্থায়িত্ব পেলে মা-বাবার মৃত্যুর পর অপরাধের রাস্তাও বেঁছে নেয়।
গল্পের শেষে দেখা যায়, তার বোনের বিয়ের পর স্বামীর কাছে বোনও যখন নির্যাতিত হয় তখন বোনের কান্না শুনে তার ভাগিনারও কান্নার সুরে ভীষণ ঘুম পায়! গল্পে লেখিকা পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর নির্যাতিত হওয়ার বিষয়টি খুব সুন্দর করে তুলে ধরেছেন।
গল্প – কেউ না
কেউ না গল্পটি অতসী নামক এক মায়ের। বলা যায় শ্বশুর বাড়ি থেকে নিপীড়িত হওয়া এক মেয়ের। জাভেদ নামের এক লোকের সাথে বিয়ে হয় অতসীর।এরপর শ্বশুর বাড়ির নানা অত্যাচারে তাদের ছেলে লিখন হওয়ার পরও তাদের বৈবাহিক সম্পর্কটা আর টিকে না। লিখনকে নিয়ে আসলেও এক সময় লিখন মাকে ছেড়ে বাবার কাছে চলে যায়। গল্পের শেষে দেখা যায়, বহুবছর পর কোন প্রকার সম্পর্ক না থাকা সত্ত্বে জাভেদ মারা যাওয়ার খবর পেয়ে অতসী তাদের বাড়িতে গেলে তাকে দেখে অনেকেই জিজ্ঞেস করে “আপনি কোন পক্ষের”। গল্পটিতে ফুটে ওঠে সময় মানুষের মাঝে শুধু দূরত্ব বাড়ায় না, অপরিচিতও করে তোলে।
গল্প – ঘণ্টাধ্বনি
মোহমায়া মানুষকে যেমনই বন্ধনে আবদ্ধ করতে পারে, তেমনই সময় আর বাস্তবতা তা থেকে মানুষকে আলাদা করতে না পারলেও মানুষের ঘোষিত সম্পর্ককে নষ্ট করে দিতে পারে। ঘন্টাধ্বনি সাজ্জাদ ও রাত্রির জীবনের এমনি একটি গল্প। অভাব, সমঝোতা এবং বিভিন্ন কারণে সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেলেও মানুষের মাঝে যে ভালোবাসা তৈরি হয় তা যে চিরকাল রয়ে যায় তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটে ঘন্টাধ্বনি গল্পটিতে।
আরও পড়ুন: কুহেলিকা: এক প্রেমিক, এক বিপ্লবী ও এক সন্তানের গল্প


গল্প – ছেলেমানুষি
“পরিচিতরা পরিচিতদের কদর করতে পারে না।” বিষয়টি এভাবে বললে ভালো হয়, আপন মানুষের কাছে মূল্য নেই কারোই। গল্পটির কনা চরিত্রের মাধ্যমে লেখিকা আপন মানুষের আবেগ অনুভূতির প্রতি সম্মান রাখাটা যে কতটা জরুরী তাই বুঝাতে চেয়েছেন। গল্পে তরুণী কনার বিভিন্ন কৌতূহলকে নেহাত ছেলেমানুষি মনে করে তার প্রতি বিরক্ত হয় নাবিল। এমনকি বিরক্ত হয়ে নাবিল যখন কনাকে গালমন্দ করতো তখনো কনা বুঝতে পারতো না তার দোষটা কোথায়? অবশেষে তার এই ছেলেমানুষির কারণে নাবিলের সাথে তার সম্পর্কটা ভেঙে যায়। তবে কনার আশেপাশে থাকা মানুষরা তাকে নিত্যান্তই সরল এবং মনভোলা মানুষ ভাবে।
গল্পের ধারাবাহিকতা এরকম ছিলো যে, কনার সরলতা এবং কৌতূহল আপন মানুষের কাছে চরম বিরক্তির বিষয় যা তাকে একাকিত্ব জীবনের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়।


গল্প – নিখোঁজ সংবাদ
গল্পটিতে সমাজের বুকে নিখোঁজ হয়ে যাওয়া কিছু মানুষের পরিবারের ভিন্ন মাত্রার সমীকরণ দেখিয়েছেন লেখিকা। পরিবারের সকল সদস্যের প্রতি শ্রদ্ধা রাখার প্রয়োজনীয়তা এবং দীর্ঘদিন অবজ্ঞা সয়ে সয়ে একজন মানুষের কতটা ভয়ানক পরিবর্তন হতে পারে তা স্পষ্ট ফুটে ওঠে গল্পটিতে।
গল্প – মেঘ জলে ডুবি চাঁদ
দাম্পত্য জীবনে দুটি মানুষের ইচ্ছার যখন মিল হয় না, তখন তাদের হাতেই খুন হয় আসন্ন সুন্দর। ইরা ও বাদল চরিত্রের মাধ্যমে গল্পটিতে লেখিকা পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে এবোয়েশন করার অভিশপ্ত মানসিকতার দৃশ্য ফুটিয়ে তুলেছেন।
সমাজের মধ্যকার এরকমই বেশ কিছু মৌলিক গল্পের সমগ্র “ওরা কেউ না”।প্রতিটা গল্পে লেখিকা এমন কিছু মেসেজ দেওয়ার চেষ্টা করেছেন যা আমরা প্রতিনিয়ত দেখে থাকি কিংবা অনুভূব করি, কিন্তু সমাজে বাস করার অপরাধে সামাজিক রূপী অনেক অসামাজিক কার্যকলাপকে আমাদের মেনে নিতে হয়। সভ্য সমাজে বাস করলেই প্রতিটা মানুষ সভ্য হয় না- তারই এক ভিন্ন মাত্রা দেখিয়েছেন লেখিকা।


বইয়ের গঠনশৈলী ও পাঠক অভিমত
বইয়ের গঠনশৈলী নিয়ে বলতে গেলে মূলধারার উপন্যাস বা গল্পগ্রন্থ থেকে আলাদাই বলা চলে এই বইটিকে। শুরুতেই বইটি পড়তে গিয়ে ভাষাগত দিক থেকে পাঠকরা এক ভিন্ন স্বাদ পাবে। সমকালীন জনরার লেখকরা মূলত সমাজের কোন একটা প্রেক্ষাপটের উপর ভিত্তি করে তাদের উপন্যাস সাজিয়ে তোলে। সেক্ষেত্রে লেখিকা শারমিন আহমেদ ছোট ছোট সতেরোটি গল্পের মাধ্যমে সাজিয়ে তুলেছেন সমাজের সতেরো রকমের অবয়ব। প্রতিটা গল্পের মূলধারা এরকম ছিলো যে,প্রতিটা গল্পই আমাদের চেনা কিন্তু এই গল্পগুলো সম্পর্কে আমাদের মুখ ফুটে বলার কিছু ছিলো না। এমনকি এই বিপত্তি গুলোর বিনাশ ও আমাদের জানা নেই। “ওরা কেউ না” এর মাধ্যমে লেখিকা সামাজিক এই ব্যাধি গুলো বিনাশের সহজলভ্য পথ্য দেখিয়েছেন।
আমার মতে বইয়ের ভাষাগত বোঝার ক্ষেত্রটা আরেকটু সহজলভ্য হওয়া উচিত ছিলো। তবে গল্পগুলো পড়া শুরু করলে গল্পের ধারাবাহিকতায় ভাষাগত বোঝার জটিলতা আর থাকে না। এবং প্রতিটা গল্প শেষ মূহুর্তে এসে পাঠককে ক্ষণিকের জন্য হলেও ভাবনার খোড়াগ জোগাবে তা নিয়ে বিন্দু মাত্র সন্দেহ নেই। এছাড়া গল্পের শ্রেণীবিন্যাস এবং একের পর এক সমাজের গভীরের গল্প গুলোকে তুলে ধরার ধারাবাহিকতা ছিলো দুর্দান্ত।
বই সম্পর্কে
- বইয়ের নাম: ওরা কেউ না
- লেখক: শারমিন আহমেদ
- প্রকাশক: কিংবদন্তি পাবলিকেশন
- প্রচ্ছদ: সঞ্চিতা দাশ সৃষ্টি
- মূদ্রিত মূল্য: ৩০০ টাকা
- প্রথম সংস্করণ: ফেব্রুয়ারি ২০২১
- আইএসবিএন: 978-984-95153-5-7
প্রচ্ছদঃ কিবোর্ডিং ডট কম
অনেক ভালোবাসা রইলো। চেষ্টা থাকবে পাঠককে আরো ভালো কিছু উপহার দেবার।
ধন্যবাদ।
ধন্যবাদ ম্যাম।