- বখতিয়ার খলজির বাংলা জয়: ইতিহাসের এক নতুন অধ্যায় - October 21, 2020
- খলিফাতাবাদ ও ষাটগম্বুজ মসজিদ: ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্য, শেষ পর্ব - October 1, 2020
- খলিফাতাবাদ ও ষাটগম্বুজ মসজিদ: ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্য (পর্ব-২) - September 27, 2020
খলিফাতাবাদ শহর বাংলাদেশের তিনটি ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের মধ্যে একটি। ঐতিহাসিক এই মসজিদের শহরের অন্যতম স্থাপনা সুবিখ্যাত ষাটগম্বুজ মসজিদ। শহরটির প্রতিষ্ঠাতা হযরত খান জাহান আলি (রহ.) এর এ অঞ্চলে আগমন ও শহরটির প্রতিষ্ঠা, ষাটগম্বুজ মসজিদসহ অন্যান্য স্থাপত্যকর্মের বিবরণ এবং তাঁর মৃত্যু পরবর্তী শহরটির অবস্থা ও আধুনিক নামকরণ নিয়ে ৩ পর্বের ধারাবাহিকের শেষ পর্ব এটি। শুরু করার আগে পাঠক ১ম পর্ব ও ২য় পর্ব পড়ে নিতে পারেন।
প্রাচীন খলিফাতাবাদ শহরের আরেকটি ঐতিহাসিক স্থাপনা রণবিজয়পুর মসজিদ। মসজিদটি ফকিরাবাড়ি মসজিদ নামেও পরিচিত। রণবিজয়পুর গ্রামে ষাটগম্বুজ সড়কের ধারে এই মসজিদটির অবস্থান। মসজিদটি এককক্ষ বিশিষ্ট বর্গাকার, যা পোড়া ইট ব্যবহার করে তৈরি করা হয়েছে। রণবিজয়পুর গ্রামের নামানুসারে এই মসজিদের নাম। ধারণা করা হয়, কোনো এক কালে এই স্থানে যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। সেই যুদ্ধে বিজয়ের স্মরণে এই এলাকাটির নাম হয় রণবিজয়পুর।
বর্গাকৃতির মসজিদটির ছাদ এক গম্বুজবিশিষ্ট। এর কিবলার দিকের (পবিত্র মসজিদুল হারামের (কাবা ঘর) দিকে) দেয়াল ব্যতীত বাকি দেয়ালগুলোতে তিনটি করে প্রবেশদ্বার রয়েছে।
ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী এই খলিফাতাবাদ শহরের স্থাপত্যকর্ম ও স্মৃতিস্তম্ভের মধ্যে আরো উল্লেখযোগ্য কিছু হচ্ছে- জিন্দাপীর মসজিদ, ঠাকুর দীঘি বা খাঞ্জেলী দীঘির পশ্চিম পাড়ে, সুন্দরঘোনায় অবস্থিত ইট নির্মিত মসজিদ। যেটি হযরত খান জাহান আলি (রহ.) অনুসারী জিন্দাপীরের নামে নামকরণ করা হয়, পাশেই রয়েছে জিন্দাপীরের সমাধি।
ষাটগম্বুজ মসজিদের দক্ষিণ-পূর্বে সুন্দরঘোনায় বাগেরহাট-খুলনা মহাসড়কের পাশেই অবস্থিত প্রাচীন বর্গাকার আরেকটি মসজিদ সিংগাইর মসজিদ।
বিবি বেগনী মসজিদ, সাবেকডাঙ্গা পুরাকীর্তি, রেজা খোদা মসজিদ, বড় আজিনা, উলুঘ খান জাহান আলির বসতবাড়ি, খান জাহান আলির সমাধি ও সমাধি সংলগ্ন মসজিদ, খান জাহান আলির শাসনামলের নির্মিত রাস্তাঘাট ও অন্যান্য স্থাপনাসহ ৫০টির মতো পুরাকীর্তির অস্তিত্ব প্রায় ৬০০ বছর ধরে বিরূপ প্রকৃতির সাথে লড়াই করে আজও টিকে থেকে মধ্যযুগে এ অঞ্চলের সমৃদ্ধির কথা জানান দিচ্ছে। যদিও এই খলিফাতাবাদ শহরে আরো অনেক স্থাপনা ছিল, যার মধ্যে ছিল ৩৬০টি মসজিদ, যেগুলো এখন নিশ্চিহ্ন হয়ে চাপা পড়ে আছে মাটির নিচে।
ষাটগম্বুজ মসজিদের ৬০টি পিলারসহ, প্রাচীন খলিফাতাবাদ শহরের অন্যান্য স্থাপত্যকর্মেও পাথরের ব্যবহার দেখা যায়। এই জঙ্গল অঞ্চলে পাথর আনা নিয়েও লোকমুখে নানা গল্প শোনা যায়। অনেকের মতে খলিফাতাবাদ শহরে ব্যবহৃত সকল পাথর খান জাহান আলি (রহ.) তাঁর অলৌকিক ক্ষমতাবলে ভারতের উড়িষ্যার রাজমহল থেকে আনিয়েছিলেন! আবার অনেকের মতে এসব পাথর তিনি চট্টগ্রাম থেকে এনেছিলেন। তবে চট্টগ্রাম থেকে পাথর আনার স্বপক্ষে কিছুটা জোর দেয়া যায়।
খলিফাতাবাদ থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত একটা রাস্তা নির্মাণের কথা শোনা যায়- বেঙ্গল ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ার: যশোর ও ১৯১৪ সালে প্রকাশিত ইতিহাসবিদ সতীশ চন্দ্র মিত্রের লেখা বিখ্যাত যশোহর-খুলনার ইতিহাস বইতেও। সম্প্রতি ২০১১ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার দেশের আবিষ্কার হওয়া এই প্রাচীন রাস্তাটির রক্ষণাবেক্ষণ করে সংরক্ষিত পুরাকীর্তি হিসেবে ঘোষণা করে।
হযরত খান জাহান আলি (রহ.) এর সমাধিতে উৎকীর্ণ ফলক হতে জানা যায়, তিনি ১৪৫৯ সালের ২৫শে অক্টোবর (ইসলামিক চান্দ্রবর্ষের ৮৬৩ হিজরীর ২৭শে জিলহজ্জ) ইন্তেকাল করেন।
তাঁর মৃত্যুর পর অনেকটা অভিভাবকহীন হয়ে পড়ে খলিফাতাবাদ নগরী। কারণ তিনি ক্ষমতার দাম্ভিকতাময় শাসক (শোষক) ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন সুদক্ষ নেতা ও নতুন সভ্যতা ও নগরের নির্মাতা। পুরো দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে (তাঁর রাজ্য এলাকায়) ইসলামের আলো ছড়িয়ে দেন এই মহান সাধক। তাঁর সুশাসন ও বিনয়ী স্বভাবের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে দলে দলে এই এলাকার মানুষ ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নেয়। জীবনের শেষ দিনগুলো আল্লাহর ধ্যানে কাটিয়ে দিতেন তিনি। হযরত খান জাহান আলি (রহ.) এর উত্তরাধিকারের কথা জানা যায় না, অনেকের মতে তিনি নিঃসন্তান ছিলেন। মৃত্যুর পর তাঁর বসতবাড়িও নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়।
মরগা ও সুন্দরঘোনার মাঝামাঝি কোনো এক জায়গায় তাঁর বসতভিটা থাকার কথা বহুকাল ধরে লোকমুখে জানা যায়। ইতিহাসবিদ সতীশ চন্দ্র মিত্রের যশোহর-খুলনার ইতিহাস বইয়ের বর্ণনা অনুসারে-
ষাটগুম্বজ হইতে ক্রমে পূর্বমুখে অগ্রসর হইলে আমরা খাঁ জাহান ও তাঁহার সহচরগণের নামীয় নানা কীর্তিচিহ্ন দেখিতে পাইব। ষাটগুম্বজ হইয়ে একটি রাস্তা উত্তরমুখে ভৈরবের কূল পর্যন্ত গিয়াছিল। ওই রাস্তারই পূর্বপার্শ্বে খাঁ জাহানের গড়বেষ্টিত আবাসবাটী ও তাহার সংলগ্ন মসজিদ ছিল। নদীর তীরে গড়বেষ্টিত বাড়ির সদর দ্বার ছিল। বেষ্টনপ্রাচীর ও গড়ের চিহ্ন এখনও আছে।
যশোহর-খুলনার ইতিহাস, সতীশ চন্দ্র মিত্র
১৯৯৬-৯৭ সালের দিকে মরগার একটা ঢিবিতে ইটসহ, স্থাপনায় ব্যবহৃত অন্যান্য সরঞ্জাম পাওয়া যায়। পরে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ এটিকেই খান জাহান আলির বসতবাড়ি বলে স্বীকৃতি দেয়।
উলুঘ খান জাহানের যোগ্য উত্তরসূরীর অভাবে এখানকার শাসনব্যবস্থা ও উন্নয়ন কাজ থমকে গিয়েছিল। তাঁর মৃত্যুর কিছুকাল পর হোসেন শাহী রাজবংশের শাসকরা (১৪৯৩-১৫৩৮ খ্রিষ্টাব্দ) এ অঞ্চল শাসন করতেন। আবার অনেকের মতে, বাংলার সুলতান নুসরাত শাহর টাকশাল বাগেরহাট শহরের নিকটবর্তী মিঠাপুকুরের নিকটে অবস্থিত ছিল। পরবর্তী ৪০/৫০ বছর ধরে এই টাকশাল থেকেই বাংলার স্বাধীন সুলতানদের মুদ্রা তৈরি করা হতো। উল্লেখ্য, মিঠাপুকুর পাড়ে সে সময়কার একটি মসজিদ এখনও আছে।
ষোড়শ শতকের দিকে তৈরি করা পর্তুগিজ ডি. ব্যারস, ব্লাইভ এবং ভেন ডেন ব্রুকের মানচিত্রে এই শহরটিকে কুইপাটাভাজ নামে দেখানো হয়েছিল। যেটা খলিফাতাবাদ থেকে কুইপাটাভাজ এ বিকৃত হয়েছিল বলে ইতিহাসবিদদের মত।
খান জাহান আলি পরবর্তী এই খলিফাতাবাদ শহরে আর তেমন কোনো যোগ্য শাসকের দেখা মেলেনি। ঝড়, জলোচ্ছ্বাসসহ অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ে ক্ষয় হতে থাকে এই সমৃদ্ধ নগরটি। লতাপাতা, জঙ্গলে ঢেকে যায় অনেক স্থাপনা, রাস্তাঘাট। তাঁর মৃত্যুর পর থেকে বর্তমান বাগেরহাটের চারদিকের এলাকাসহ এই এলাকা “হাওয়েলি খলিফাতাবাদ” বা “উপ শাসকের আবাসস্থল” হিসেবে পরিচিত ছিল ১৮শ শতক পর্যন্ত। সুবিখ্যাত আবুল ফজলের লেখা আইন-ই-আকবরী গ্রন্থে খুলনা-যশোর অঞ্চলকে হাওয়েলি খলিফাতাবাদ নামেই উল্লেখ করা হয়।
খান-উল আযম উলুঘ খান-ই-জাহান আলি (রহ.) কর্তৃক গড়ে উঠা এই প্রাচীন খলিফাতাবাদ শহরই আজকের বাগেরহাট। প্রাচীন শহরটির পাশেই গড়ে উঠেছে আধুনিক শহরটি। তবে আধুনিক নাম বাগেরহাট হওয়ার কারণ কি? যেখানে প্রথমদিকে খলিফাতাবাদ, পর্তুগীজদের করা মানচিত্রে কুপাইটাভাজ, আইন-ই-আকবরীতে হাওয়েলি খলিফাতাবাদ।
বাগেরহাট নামের পিছনে স্বাভাবিক ও সবার আগে যে ব্যাখ্যাটা আসে তা হলো নিকটবর্তী সুন্দরবনের বাঘের আনাগোনা ও উপদ্রব। হাট শব্দের অর্থ হচ্ছে বাজার, আর বাজার মানে অনেক মানুষের আনাগোনা। বাঘের বেশি আনাগোনার কারণে হয়তো বাঘেরহাট থেকে লোকমুখে উচ্চারণ পার্থক্যে শব্দ বিবর্তিত হয়ে বাগেরহাট নামে রুপ নিয়েছে।
অন্য একটি মতানুযায়ী, বর্তমান বাগেরহাট শহরের পাশ দিয়ে প্রবাহিত ভৈরব নদে শহরের মুনিগঞ্জ থেকে নাগেরবাজার পর্যন্ত একটি বাঁক রয়েছে। নদের এই বাঁকের পাশে শহরের বর্তমান পুরাতন বাজার এলাকায় একটি হাট বসতো। নদীর বাঁকে গড়ে উঠা সেই হাট অর্থাৎ বাঁকেরহাট থেকে শব্দ বিবর্তিত হয়ে বাগেরহাট নাম ধারণ করেছে। বর্তমান বাগেরহাট বাজার স্থানান্তরিত হবার আগ পর্যন্ত ভৈরবের বাঁকে এই পুরাতন বাজারই ছিলো বাগেরহাট শহরের প্রধান বাজার।
তবে বাগেরহাট নামকরণের পেছনে যুক্তিযুক্ত আরেকটি মত হচ্ছে- ‘বাগ’ এর ‘হাট’ থেকে। ফার্সি ভাষায় ‘বাগ’ শব্দের বাংলা অর্থ বাগান বা বাগিচা। সতীশ চন্দ্র মিত্রের লেখা যশোহর-খুলনার ইতিহাস বই থেকে জানা যায়, খলিফাতাবাদ শহরে নির্মিত হযরত খান জাহান আলির অন্যতম স্থাপনা “বড় আজিনা” সংলগ্ন বর্তমান বাগেরহাট শহর এলাকায় একটি বাগ (বাগান) ছিলো। সেই বাগ (বাগান) এলাকায় বসা হাট কে বাগ + এর + হাট = বাগেরহাট বলা হতো, সেখান থেকে বর্তমান মূল শহরের নামকরণ হয় বলে অনেকেই মনে করেন।
খলিফাতাবাদ হোক আর বাগেরহাট, নাম দিয়ে কী যায় আসে? দেশের মধ্যযুগে গড়ে উঠা এই বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী শহর যে কারো জন্য গর্বের বিষয়। আমরা যখন আমাদের সমৃদ্ধ ঐতিহ্যের কথা স্মরণ করব, তখন অন্যান্য পুরাকীর্তির সাথে এই ঐতিহাসিক মসজিদের শহরের ষাটগম্বুজ মসজিদসহ এখনো টিকে থাকা সব স্থাপনাগুলো আমাদের চোখের সামনে ভাসবে, ভাসবে আমাদের হারিয়ে ফেলা সমৃদ্ধি।
বাগেরহাট বা খলিফাতাবাদ শহরটি মধ্যযুগে যেমন প্রাণবন্ত ছিল, আজও কিন্তু কোনো অংশে কম নয়! ইউনেস্কোর অন্যান্য কিছু বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী (যেমন: পেত্রা, চিচেন ইৎজা, মাচু পিচু ইত্যাদি) শহরগুলোর থেকে এখানেই ব্যবধান বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় এই শহরটির। আজও প্রাচীন এই শহরের বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থাপনাগুলোর কার্যক্রম সক্রিয় আছে।
ঐতিহ্য হচ্ছে আমরা উত্তরাধিকার সূত্রে যা পেয়ে থাকি। আমাদের পূর্বপুরুষদের রেখে যাওয়া ঐতিহ্য যদি সমগ্র বিশ্ববাসীর জন্য ঐতিহ্য হয়, তাহলে তো কথাই নেই! বাংলাদেশে অবস্থিত এই ঐতিহাসিক মসজিদের শহর খলিফাতাবাদ শুধু আমাদের নয় সমগ্র বিশ্ববাসীর জন্য গর্বের, কারণ এটি শুধু আমাদের জন্য ঐতিহ্য নয়, বরং গোটা বিশ্ববাসীরই সম্পদ।
ফিচার ছবিসূত্র: ArchaeologyBD