- বখতিয়ার খলজির বাংলা জয়: ইতিহাসের এক নতুন অধ্যায় - October 21, 2020
- খলিফাতাবাদ ও ষাটগম্বুজ মসজিদ: ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্য, শেষ পর্ব - October 1, 2020
- খলিফাতাবাদ ও ষাটগম্বুজ মসজিদ: ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্য (পর্ব-২) - September 27, 2020
খলিফাতাবাদ! যার বর্তমান নাম বাগেরহাট। আধুনিক বাগেরহাট শহর প্রাচীন খলিফাতাবাদ শহরের ঠিক পাশেই গড়ে উঠেছে। এই শহরে অবস্থিত রয়েছে ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান ষাটগম্বুজ মসজিদ, যেটা আমাদের প্রায় সবারই জানা। কিন্তু আমাদের এই জানার মধ্যে কিছুটা ভুল রয়েছে!
ইউনেস্কো শুধু মাত্র ষাট গম্বুজ মসজিদকে বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে ঘোষণা করেনি, বরং পুরো প্রাচীন খলিফাতাবাদ শহরকেই ১৯৮৫ সালে বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে। ইউনেস্কোর ঘোষণা অনুযায়ী, প্রাচীন খলিফাতাবাদ শহরের সকল স্থাপত্যকর্ম, জলাধার, রাস্তা, সমাধি সবকিছুই বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ।


খলিফাতাবাদ বাংলাদেশের বুক থেকে হারিয়ে যাওয়া একটি শহর। না, এটি কোনো আটলান্টিস বা এলডেরাডোর মতো পৌরাণিক উপকথার শহর নয়। মধ্যযুগে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জলাভূমি আর বনাঞ্চলের মধ্যে গড়ে উঠা এক সমৃদ্ধ রাজধানী শহর। বিশ্ববিখ্যাত ম্যাগাজিন ফোর্বস এর ২০১১ সালে 15 Lost Cities of the World শীর্ষক একটা নিবন্ধের তালিকা অনুসারে বিশ্বের হারিয়ে যাওয়া ১৫টি সমৃদ্ধ শহরের একটি হচ্ছে মসজিদের শহর খলিফাতাবাদ। দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র শহর হিসেবে তালিকাভুক্ত হয় বাংলাদেশের ঐতিহাসিক শহরটি। যে তালিকাতে আছে পেরুর মাচু পিচু, জর্ডানের মরুভূমির বুকে দাঁড়িয়ে থাকা শহর পেত্রা, মেক্সিকোর চিচেন ইৎজা, ইরাকের ব্যাবিলন এর মতো বিশ্বের সপ্তাশ্চার্য শহরগুলো!
খলিফাতাবাদ শহরটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন খান জাহান আলী (রহ.)। যিনি ছিলেন একজন যোদ্ধা এবং সুফি সাধক। তার কবরে উৎকীর্ণ ফলকে তার নামের সাথে যুক্ত আছে উলুঘ খান ও খান-ই-আযম। যেখান থেকে ধারণা করা হয়, তিনি তুর্কি বংশোদ্ভূত। আবার অনেকের মতে তার পরিবার ভারতীয় উপমহাদেশে এসেছিল বাগদাদ থেকে।
তার জন্মসাল, পিতা-মাতা সম্পর্কে সঠিক তথ্য পাওয়া না গেলেও গবেষকদের অনুমান তিনি ১৪শ শতাব্দীর শেষভাগে দিল্লিতে জন্মগ্রহন করেন। তার শিক্ষক ছিলেন দিল্লির বিখ্যাত আলেম শাহ নেয়ামত উল্লাহ (রহ.) সহ আরো বিখ্যাত পণ্ডিতবর্গরা। যাদের নিকট থেকে তিনি কুরআন, সুন্নাহ, ফিকহ শাস্ত্র, দর্শন ও স্থাপত্য বিদ্যায় পারদর্শীতা অর্জন করেন।


খান জাহান আলীর দক্ষিণ অঞ্চলে আগমনের সময়কাল ও কারণ সুনির্দিষ্টভাবে বলা যায় না। কোনো কোনো ঐতিহাসিকদের মতে তিনি তুঘলকি সেনাবাহিনীতে সৈনিক পদে কর্মজীবন শুরু করেলেও নিজ যোগ্যতায় সেনাপতি পদে অধিষ্ঠিত হন। পরবর্তীতে শাসকদের নির্দেশে বাংলা অঞ্চলে আগমন করেন। আবার কেউ কেউ ধারণা করেন, গৌড়ের বিশিষ্ট বুযুর্গ হজরত নূর-ই কুতুব-উল আলম (রহ.) এর অনুরোধে জৈনপুরের সুলতান ইবরাহিম শর্কি তাকে বিশ্বাসঘাতক অত্যাচারী রাজা গণেশের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে এ অঞ্চলে প্রেরণ করেন। বাংলা অঞ্চলে প্রথমে তিনি তুঘলক কিংবা গৌড়ের প্রতিনিধিত্ব করতে আসলেও, পরবর্তীতে তিনি আসেন ধর্মপ্রচার ও নিজস্ব শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে, যে লক্ষ্যে তিনি সফলও হয়েছিলেন।
সেই সময়ে দক্ষিণবঙ্গে আসার একমাত্র সহজ পথ ছিল ভৈরব নদী। খান জাহান আলী (রহ.) গৌড় হতে পদ্মা নদী হয়ে কুষ্টিয়ার মেহেরপুরের নিকটবর্তী ভৈরব নদীতে আসেন। সেখান থেকে চুয়াডাঙ্গা হয়ে বর্তমান যশোর জেলা শহর থেকে উত্তরে এবং ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ বাজার থেকে দক্ষিণে ভৈরব নদীর উত্তর তীরে অবস্থিত বারোবাজারে এসে পৌছান। সাথে ছিল তার আরও ১১ জন অনুসারী। জানা যায় বারোবাজারের পুরোনো নাম ছিল ছাপাইনগর; যেখানে একসময় হিন্দু-বৌদ্ধ শাসকদের শাসনকার্য ছিল এবং ইতঃপূর্বে যুদ্ধে ধ্বংসপ্রায় ছিল। খানজাহান আলীর আগমনে শহরটি নতুন করে আবার প্রাণ ফিরে পায়। পরবর্তীতে এই অঞ্চল ছাপাইনগর থেকে বারোবাজার নামে পরিচিত হয়।
কিছুকাল বারোবাজারে অবস্থান করার পর খান জাহান আলী (রহ.) চলে যান মুরলী, যেখানে বর্তমান আধুনিক যশোর শহর। মুরলী থেকে দুভাগে বিভক্ত হয়ে ইসলাম প্রচার চালিয়ে যায় তার দল। একদল সোজা দক্ষিণ মুখে কপোতাক্ষ নদের পূর্ব ধার অতিক্রম করে ক্রমান্বয়ে সুন্দরবনের অভ্যন্তরভাগে প্রবেশ করে। আর অন্যদল পূর্ব-দক্ষিণ মুখে ক্রমান্বয়ে ভৈরব নদীর তীর ধরে পায়গ্রাম কসবায় গিয়ে পৌঁছায়। এই দলকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন খান জাহান আলী (রহ.) নিজেই।
পয়গ্রাম কসবাতেও কিছুকাল অবস্থান করেন তিনি। পরবর্তীতে সেখান থেকে ভৈরব তীরে সুন্দরঘোনায় এসে পৌঁছান, যেখানে অনেক এলাকাজুড়ে একটি নগরের পত্তন করেন। যার নাম দেন খলিফাতাবাদ। সেই সময়ে এ অঞ্চলের বেশিরভাগ জায়গা ছিল বনাঞ্চল। এই বনাঞ্চলের জঙ্গল পরিষ্কার করে একটা সমৃদ্ধ শহর তৈরি করা চাট্টিখানি কথা ছিল না। তার উপর ছিল অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা। এই কঠিন পরিবেশকে নিজেদের অনুকূলে করে নিয়েছিলেন খান জাহান আলী (রহ.) ও তার দলবল। তিনি অবাধে এই অঞ্চলে শাসনকাজ চালান। এ অঞ্চলে বড় কোনো যুদ্ধ বা রক্তক্ষয়ের তেমন কোনো ইতিহাস খুঁজে পাওয়া যায় না।
তিনি অবাধেই প্রায় গোটা দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল শাসন করেছিলেন। তার শাসিত অঞ্চলের মূলকেন্দ্র ছিলো খলিফাতাবাদ অর্থাৎ তার রাজধানী শহর ছিল খলিফাতাবাদ, যেখান থেকে তিনি গোটা রাজ্য নিয়ন্ত্রণ করতেন। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলে প্রয়োজনে গভর্নর নিয়োগ করতেন। খুলনা-বাগেরহাটের ভৈরব নদী থেকে নড়াইলের উত্তরে নলদি পর্যন্ত বিস্তৃত ছিলো তার রাজ্য। তার রাজ্যে খলিফাতাবাদ ছাড়াও আরো কিছু শহর ছিল, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ঝিনাইদহের বারোবাজারে অবস্থিত মোহাম্মদাবাদ।
খান জাহান আলী (রহ.) শুধুমাত্র একজন সুফি সাধক ও শাসকই ছিলেন না, তিনি ছিলেন একটি সমৃদ্ধ নতুন সভ্যতার নির্মাতা এবং একজন দক্ষ ও জনদরদী শাসকও বটে। যার প্রমাণ মেলে তার শাসনামলের নানা কার্যক্রমে যা বর্তমান বিশ্ববাসীর কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্তিক নিদর্শন, এই স্বীকৃতি দিয়েছে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা (UNESCO)।
ইউনেস্কোর তথ্য অনুসারে খলিফাতাবাদ শহরটির অয়তন ছিল ৫০ বর্গ কিলোমিটার। ছিল বাংলার স্থাপত্য ও তুঘলকী স্থাপত্য-শৈলীর মিশ্রণে অনন্য অনেক স্থাপত্য নিদর্শন। সেই সময়ে এই অঞ্চলে ৩৬০ টি মসজিদ থাকার কথা উল্লেখ করে জাতিসংঘের এই সংস্থাটি। ১৫শ শতাব্দীতে অন্যান্য শহরে এ পরিমাণ মসজিদ থাকা অনেকটা অকল্পনীয়। আর এ কারণেই ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্য তালিকায় উল্লেখ করা হয়েছে Historic Mosque City of Bagerhat বা ঐতিহাসিক মসজিদের শহর।
ঐতিহাসিক শহরটিতে তিনি শুধু মসজিদই তৈরি করেননি, তৈরি করেছেন অনেক সরকারি দালান, স্মৃতিস্তম্ভসহ আরো নানা স্থাপনা। যেগুলো নির্মাণ করা হয়েছে টেরাকোটার সমন্বয়ে। দূর্ভেদ্য বনাঞ্চলের মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থার অভূতপূর্ব উন্নয়ন সাধন করেন, শুধু রাস্তা-ঘাট নয়, গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় নির্মাণ করেন ব্রিজও। উপকূলীয় লোনা অঞ্চলটিতে পানি সংকট নিরসনের জন্য খনন করেন অনেক জলাধার (দীঘি, পুকুর)। এই শহরটিতে এখনো অস্তিত্ব আছে পঞ্চাশটির মতো স্থাপত্যকর্ম, যেগুলো মধ্যযুগের বাংলার মুসলিম স্থাপত্যের সাক্ষ্য বহন করে চলছে।
মার্কিন ইতিহাসবিদ রিচার্ড ইটন তার লেখা দ্য রাইজ অব ইসলাম অ্যান্ড দ্য বেঙ্গল ফ্রন্টিয়ার বইতে ঐতিহ্যবাহী শহরটির প্রতিষ্ঠায় হজরত খান জাহান আলী (রহঃ) অবদানের কথা উল্লেখ করে লিখেছেন-
এটি অনস্বীকার্য যে, খান জাহান আলী একজন সুদক্ষ নেতা ছিলেন। ঘন জঙ্গলপূর্ণ একটি এলাকাকে চাষাবাদের উপযোগী জমিতে পরিণত করার জন্য উন্নত সাংগঠনিক দক্ষতা ও বিপুল পরিমাণে জনশক্তির প্রয়োজন ছিল। চাষাবাদ ও ব্যবহার উপযোগী পানি সংগ্রহের সুবিধার্থে লোনা পানির প্রবেশ ঠেকাতে নদীর তীরে বাঁধ নির্মাণ করতে হয়েছিল। জঙ্গল পরিষ্কার করতে হয়েছিল।
পানি সরবরাহ ও সংরক্ষণের জন্য জলাধার (দীঘি, পুকুর ইত্যাদি) খনন করতে হয়েছিল। শ্রমিকদের জন্য আবাসস্থল, সরকারী দালান নির্মাণ করা লেগেছে। এসব কাজ শেষ করার পরেই দ্রুত চাষাবাদ শুরু করে ফসল উৎপাদন করা লেগেছিল। নয়তো পুনরায় জঙ্গল গজিয়ে যাওয়ার ভয় ছিল। এসব কাজ সম্পাদন করা ছিল খুবই দুরূহ কাজ, কারণ ছিল অসুস্থ হয়ে যাওয়া এবং জঙ্গলের বাঘের আক্রমণের ভয়।
দ্য রাইজ অব ইসলাম অ্যান্ড দ্য বেঙ্গল ফ্রন্টিয়ার, রিচার্ড ইটন
হযরত খান জাহান আলী (রহ.) শহরটিতে জনহিতৈষী ও উন্নয়নমূলক কাজ করে হয়ে উঠেন গণমানুষের নেতা। তার চারিত্রিক মাধুর্যতা দিয়ে জয় করে নিয়েছিলেন জনসাধারণের মন। জনসাধারণের কল্যাণে তিনি একাধিক রাস্তা, জলাশয় ও স্থাপনা নির্মাণ করেন।
১৯১৩ সালে প্রকাশিত সতীশচন্দ্র মিত্রের সুপরিচিত ইতিহাস বিষয়ক যশোহর খুলনার ইতিহাস গ্রন্থে লিখেছেন-
খাঁ জাহান আলি একজন অদ্ভুতকর্মা পুরুষ ছিলেন। লোকে বলে খাঁ জাহানের ষাটহাজার সৈন্য ছিল, উহাদের অন্যান্য যুদ্ধাস্ত্রের মত একখানি বাজে অস্ত্র ছিল কোদাল। যুদ্ধবিগ্রহ সব সময়ে চলিত না, আবশ্যকও হইত না, লোকে পাঠান সৈন্য দেখিলে বশ্যতা স্বীকার করিত। বিশেষত লোকে খাঁ জাহানের জন-হিতৈষণায় মোহিত হইয়া তাঁহাকে ভক্তি করিত। সুতরাং সৈন্যদিগকে অনেক সময় নিষ্কর্মা থাকিতে হইত; খাঁ জাহান তাহাদিগের হস্তে কোদাল দিয়া কর্ম দিয়াছিলেন।
যুদ্ধ বাধিলে সৈন্যেরা যুদ্ধ করিত, নতুবা কোদাল কেহ কাড়িয়া লইত না, অবাধে রাস্তা নির্মাণ ও পুষ্করণী খনন করিতে করিতে দেশময় পুণ্যকীর্তি রাখিয়া সৈন্যদল অগ্রসর হইত। এই প্রণালী একটি শিক্ষার বিষয়; এমনভাবে দেশের ও দশের স্থায়ী উপকারের উপায় আর নাই।
যশোহর খুলনার ইতিহাস, সতীশচন্দ্র মিত্র
… … …
খলিফাতাবাদ ও ষাটগম্বুজ মসজিদ: ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্য (পর্ব-২) পড়তে পারেন এখান থেকে।
ফিচার ইমেজ: TourismDiary
তথ্যসূত্র:
- UNESCO
- Forbes
- DW Bangla
- ResearchGate
- হযরত খান জাহান আলী: জীবন ও কর্ম; লেখক- মোঃ মাসুম আলীম; প্রকাশকাল- ২০০০ সাল