- ক্ষুদিরাম বসু: ছোট্ট অথচ বিদ্রোহী এক জীবন - December 3, 2020
- দি হিউম্যানি কর্পোরিস ফেব্রিকা: আধুনিক অঙ্গসংস্থানবিদ্যা যে বইয়ের কাছে ঋণী - November 18, 2020
- জলাতঙ্ক বনাম পাস্তুর: জীবাণুর বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়ী মানবসভ্যতা - October 27, 2020
“অগ্নি যুগের অগ্নিপুত্র: ক্ষুদিরামরা ফিরে ফিরেই আমাদের ভিড়ে উপস্থিত হয় ”
ব্রিটিশ বিরােধী সশস্ত্র আন্দোলনের কনিষ্ঠ শহিদ, কিশোর থেকে যুবক হয়ে উঠার প্রাক-মুহূর্তে হায়নাদের কালো থাবায় মহাবিশ্বের অসীম অতল গহ্বরে লুকিয়ে পড়া সাহসী বিপ্লবী বীর, ক্ষুদিরাম বসু জন্মেছিলেন ১৮৮৯ সালের আজকের এই দিনে তথা ৩ ডিসেম্বর।
৩ ডিসেম্বর, ১৮৮৯ সাল। ভারতের মেদিনীপুর শহর সংলগ্ন হবিবপুর গ্রামের কুয়াশাপূর্ণ হার-কাঁপানো শীতের সেই সকালে বসু পরিবারের সকলের মধ্যে ছিল সাগ্রহ প্রতীক্ষা। নবজাতকের ক্রন্দনধ্বনিতে উপস্থিত সকলেই সচকিত হয়ে উঠল। ছুটে এলেন গৃহকর্তা ত্রৈলক্যনাথ। পুত্র সন্তানের আগমনে তার দুচোখে তখন বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস। কিন্তু তবুও কোথায় যেন ছিল একটু সংশয়ের কালো ছায়া! এর আগের দুটি ছেলে পর পর মারা যাওয়ায় বাঁধন হারা আনন্দের মধ্যে নবজাতক হারানাের আশঙ্কা তার চোখে-মুখে স্পষ্ট। সেই বিপদের সম্ভাবনা নির্মূল করার জন্য প্রচলিত সংস্কার অনুযায়ী লক্ষীপ্রিয় দেবী সদ্যোজাত পুত্রের ওপর সমস্ত লৌকিক অধিকার ত্যাগ করে তিন মুঠো খুদের (শস্যের খুদ) বিনিময়ে বড় মেয়ে অপরূপা দেবীর হাতে নবজাতকের দায়িত্বভার তুলে দিলেন। খুদের বিনিময়ে কেনা হল বলেই নবজাতকের নাম রাখা হল ক্ষুদিরাম।


দেশের স্বাধীনতা সঙ্গে সম্পর্কহীন কোন কিছুর প্রতি শিশু বয়স থেকেই তাঁর ছিল না কোন আকর্ষণ। এমনকি তথাকথিত ভালাে ছাত্রদের মত বই মুখস্থ করার অভ্যাস বা ডিগ্রী অর্জনের মােহও তাঁর মাঝে পরিলক্ষিত হয়নি কোনদিন। এমনকি বালক বয়স থেকেই তার বিভিন্ন কর্মকাণ্ড প্রমাণ করে যে, তিনি অত্যাচারী ব্রিটিশ শাসকদের প্রবল ঘৃণার চোখেই দেখতেন।
তাইতো মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সে বিপ্লবী সত্যেন্দ্রনাথ বসুর সান্নিধ্যে আসেন ক্ষুদিরাম বসু। অল্প সময় ক্ষুদিরামকে পর্যবেক্ষণ করে তিনি বুঝে ফেলেছিলেন এ ছেলের জাতই আলাদা! এরকম ছেলেই তো তাঁর চাই। ক্ষুদিরামের মাঝে থাকা স্বাধীনতার দীপ্ত শিখা সত্যেন্দ্রনাথকে বিমোহিত করে। ক্ষুদিরামকে তিনি তার সশস্ত্র বিপ্লবী দলের সদস্য করে নেন। তখন থেকেই শুরু হয়েছিল ক্ষুদিরামের নতুন জীবন। ১৮ বছর, ৭ মাস, ১১ দিনের ছিল সেই বিদ্রোহী জীবন।
বিপ্লবী সংঘটনে শােনানাে হতাে অত্যাচারী ইংরেজ অফিসারদের কথা। তাদের রটানো বিভিন্ন কু-কীর্তির কথা, সাধারণ মানুষের উপর নির্বিচারে অত্যাচারের কথা। ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ড ছিল এদের মধ্যে একজন। তাকে শিক্ষা দেবার কাজের জন্য প্রথমে বাছা হয়েছিল প্রফুল্ল চাকী এবং সুশীল সেনকে। শেষমুহূর্তে এক বিশেষ কারণে সুশীল সেন যেতে পারেননি। তার জায়গায় দলে জায়গা পান ক্ষুদিরাম বসু। জায়গা পান বললে ভুল হবে ইংরেজদের প্রতি ব্যাপক ক্ষোভ আর ঘৃণার বহিঃপ্রকাশই তাকে এই গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য নিযুক্ত করে দেয়।


কিংসফোর্ডকে শিক্ষা দিতে প্রথম যখন পরিকল্পনা হয়, তখন তিনি আলিপুরে প্রেসিডেন্সি কোর্টে প্রধান ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। গোপন সুত্রের খবরে উনার সুরক্ষা নিশ্চিত করতে তাঁকে মোজাফফরপুরে বদলি করা হয়। ক্ষুদিরাম ও প্রফুল্ল চাকি নাম বদলে দিনেশ চন্দ্র রায় ও হরেল সরকার নাম নিয়ে এক ধর্মশালায় উঠে কিংসফোর্ডের উপরে নজরদারি জারি রাখে। তারা লক্ষ্য করে প্রায়ই কিংসফোর্ডকে মোজাফফরপুরে পার্কের বিপরীতে ব্রিটিশ ক্লাবে যেতে হত সময় কাটানাের জন্য।
প্রফুল্ল চাকি
এই বোমা নিক্ষেপের ঘটনা রাতারাতিই আশেপাশে সাড়া ফেলে দেয়। চতুর্দিকে পুলিশকে সজাগ থাকতে বলা হয়। অন্যদিকে বােমা নিক্ষেপ করে তাঁরা পায়ে হেঁটে দু-জন আলাদা আলাদা পথে দূরের দিকে পালাতে থাকে। কিন্তু ঘটনার আকস্মিকতায় জুতো, জামা কাপড় ঘটনা স্থলেই ফেলে রেখে যায়।
সকালের দিকে ক্ষুদিরাম ২৫ মাইল দূরের ওয়েনি নামক রেল স্টেশনে হাজির হয়। সেখানে একটি দোকানে, যখন তিনি জল পান করতে যান, সেখানে দুজন অস্ত্রধারী কনস্টেবল ক্ষুদিরামের পায়ের অবস্থা দেখে সন্দেহ করেন এবং ক্ষুদিরামকে তাঁরা ধরে ফেলে। ক্ষুদিরাম তার পিস্তল বার করার আগেই ওই দুজন ভারতীয় তাঁকে কাবু করে ফেলে। ধরা পড়ে যান ক্ষুদিরাম।
অপরদিকে প্রফুল্ল পায়ে হেঁটে অনেক দূর চলে গিয়ে একটি ট্রেনে উঠে গা-ঢাকা দেয়। ট্রেনে যাবার সময়ে ব্রিটিশদের এক সাব ইন্সপেক্টর নন্দলাল ব্যানার্জি ওই কামরাতেই ছিল। গল্প করার ছলে প্রফুল্লকে সে চিনতে পার এবং সে খবর পাঠিয়ে ট্রেনের কামরাতেই প্রফুল্লকে ধরিয়ে দেয়। পালিয়ে যাবার চেষ্টা করলেও প্রফুল্ল অসমর্থ হয়। তখম সে নিজের কাছে থাকা রিভলবারের গুলি চালিয়ে নিজেকে শেষ করে দেয়।
অন্য কোনো সহযােগীর নাম বা কোন গােপন তথ্য শত অত্যাচারেও প্রকাশ করেননি। শুরু হয় ক্ষুদিরামের বিচার কাজ। কিন্তু শুরুর দিকে ক্ষুদিরামের পক্ষে কোন আইনজীবীই দাঁড়ানোর সাহস পাচ্ছিল না। পরে তৎকালীন রংপুরের বারের উকিল সতীশ চন্দ্র চক্রবর্তী, কুলকমল সেন ও নগেন্দ্রনাথ লাহিড়ী ক্ষুদিরামের পক্ষে মামলা পরিচালনায় এগিয়ে আসেন।
৬ জুন, ১৯০৮। শুরু হয় বিচারকার্য। কিন্তু সব ঘটনাকে অবাক করে দিয়ে বিচারের শুরুতেই ক্ষুদিরাম নিজেকে বোমা নিক্ষেপের সাথে জড়িত দাবি করে স্বীকারােক্তি প্রদান করেন। কিন্তু বিচারক এই স্বীকারােক্তিকে এড়িয়ে আদালতের প্রচলিত নিয়মেই বিচার করা হবে মর্মে ঘােষণা দেন। রংপুর থেকে যাওয়া তিন আইনজীবী দুই দিন সরকারী সাক্ষীদের জেরা করেন।
মামলার উকিলরা সওয়াল জবাবকালে যুক্তি দেখিয়েছিলেন এই ঘটনার সময় ক্ষুদিরামের গায়ে একটা ভারী কুর্তা, কোর্ট, দুইটি পিস্তল এবং বেশ কিছু কার্তুজ ছিল তাই ঐ পরিমাণ ওজন নিয়ে তাঁর পক্ষে এতাে ক্ষিপ্রতার সাথে বােমা ছুঁড়ে মারা সম্ভব নয়। তাছাড়া দীনেশ (প্রফুল্ল চাকীর ডাক নাম) ক্ষুদিরামের থেকে বলিষ্ঠ গড়নের এবং বােমা বানানাে জানতাে সে। তাই বােমাটি প্রফুল্ল চাকীর পক্ষেই ছোঁড়ার সম্ভাবনা বেশী। প্রফুল্লের আত্মহত্যাও এই দিকেই ইঙ্গিত করে। কেননা সে জানতাে সে দোষী। আর দোষী বলেই ধরা পড়ার সাথে সাথে আত্মহত্যা করে সে। তবে যাইহোক পারিপার্শ্বিকতা বিবেচনা করলে ক্ষুদিরামের পক্ষে সন্দেহের অবকাশ (Benefit of doubt) থেকেই যায়।
তাই সব কিছু বৃথা যায়। বৃথা যায় রংপুর থেকে মামলায় লড়তে যাওয়া আইনজীবীদের তৎপরতা। উকিলরা অনেক চেষ্টা করেও ক্ষুদিরামকে নিজের দোষ অস্বীকার করানাের জন্য রাজি করাতে পারেননি। বলতে গেলে আইনজীবীদের তিনি কোনভাবেই সহযােগিতা করেননি।
নিজের দোষ স্বীকার করে নেওয়ায় ক্ষুদিরাম বসুর শেষ বিচার খুব কম সময়ের মধ্যেই শেষ হয়। পক্ষে, বিপক্ষের সাক্ষী শােনার পর প্রাণদণ্ড ঘােষিত হয়।
আরও পড়ুন: মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী: একটি নাম, একটি জীবন, একটি সফল অধ্যায় পর্ব-১


ক্ষুদিরামের ফাঁসির আদেশ শুনে গােটা বাংলা গর্জে উঠেছিল। রাস্তাতে নেমে পড়েছিল হাজার হাজার বিপ্লবী জনতা। এমন ঘটনা কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি কেউ। আর ক্ষুদিরাম? তাঁকে যতই লােকে দেখে ততই অবাক হয়। ১৮ বছরের একটা ছেলে কিভাবে নিজের স্বীকারোক্তিতে ফাঁসির আদেশ নির্ভয়ে মেনে নিতে পারে!


১১ ই আগস্ট, ১৯০৮। অবিভক্ত বাংলার মুজাফফরপুর, বিহার। সময় তখন ভাের ৫ টা। পনেরাে ফুট উঁচুতে এক মঞ্চ প্রস্তুত। চারপাশে পুলিশ প্রহরা। দুই দিকে দুটি খুটি আর একটি লােহার রড আড় দ্বারা যুক্ত, মাঝখানে বাঁধা মােটা এক গোছা দড়ি।
শেষ হাসি দিয়ে মঞ্চে উঠে সােজা হয়ে দাঁড়াল সদ্য কিশাের পেরোনাে এক যুবক। ব্রিটিশ পুলিশরা অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। বীরদর্পে হেঁটে গেলেন ক্ষুদিরাম। তখনাে তাঁর মুখ ভরা যেন জয়ের হাসি চারপাশের মানুষদের যেন কটাক্ষ ছুড়ে দিলেন এই তরুণটি। সবুজ রংয়ের পাতলা টুপিতে মাথা থেকে গলা ঢেকে দেয়া হল।উপস্থিত এক প্রহরীর হাত ততক্ষণ বসে আছে কোনায় স্থাপন করা হ্যান্ডেলের উপর। উডমেন সাহেব ঘড়ির দিকে তাকিয়ে উড়িয়ে দিল তার হাতে থাকা সাদা রংয়ের রুমাল। নিমিষে বালকটি হারিয়ে গেল কোন এক অতল গহব্বরে। শেষ হল ১৮ বছর ৭ মাস ১১ দিনের বৈপ্লবিক জীবন। যে বয়সে ক্ষুদিরাম আমাদের মাঝে থেকে হারিয়ে গেছে সেই বয়সে এখনকার ছেলেরা মায়ের আঁচলের নিচেই অবস্থান করে।
সবশেষে ক্ষুদিরামের সম্মানে মুকুন্দ দাসের লেখা গানের লাইনগুলোর মাধ্যমে মানুষের হৃদয়ে স্মরণীয়-বরণীয় হয়ে থাক প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তর –
একবার বিদায় দে-মা ঘুরে আসি।
হাসি হাসি পরব ফাঁসি দেখবে জগৎবাসী।
কলের বোমা তৈরি করে
দাঁড়িয়ে ছিলেম রাস্তার ধারে মাগো,
বড়লাটকে মারতে গিয়ে
মারলাম আরেক ইংল্যান্ডবাসী।
শনিবার বেলা দশটার পরে
জজকোর্টেতে লোক না ধরে মাগো
হল অভিরামের দ্বীপ চালান মা ক্ষুদিরামের ফাঁসি
দশ মাস দশদিন পরে
জন্ম নেব মাসির ঘরে মাগো
তখন যদি না চিনতে পারিস দেখবি গলায় ফাঁসি
মুকুন্দ দাস
প্রচ্ছদ সূত্র: Amazon
সহায়ক গ্রন্থ:
- জানা, সুনীল। ক্ষুদিরামের ফাঁসি। ISBN:978-81-295-2096-8। দে’জ পাবলিশিং।
সম্পর্কিত নিবন্ধসমূহ: