- দ্য স্পাই ইন ইয়োর ফোন: এনএসও কর্তৃক তথ্যের বিপজ্জনক ব্যবহার - January 22, 2021
- এক পৃথিবী, এক রাষ্ট্র: বাস্তব নাকি কেবলই ধূসর কল্পনা - January 18, 2021
- সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়: বাংলা চলচ্চিত্রের মুকুটহীন মহারাজ (তৃতীয় পর্ব) - December 27, 2020
বেশ কিছু বছর ধরেই নিরামিষভোজীদের আন্দোলনের মূল লক্ষ্যবস্তু হচ্ছে আমিষভোজীদের জন্য অন্য কোনো উদ্ভিজ্জ আমিষ উৎসের প্রতি উৎসাহ প্রদান করা। এক্ষেত্রে, কারণ হিসেবে তারা বৈশ্বিক উষ্ণায়নকে মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করতে চান। এই পরিস্থিতিতে শ্যাম রাখি, আবার কূলও রাখি এর মতো উপায় নিয়ে হাজির হয়েছেন বিজ্ঞানীরা। তাঁদের হাতের সেই মোক্ষম অস্ত্র হল কৃত্রিম মাংস। চলমান নিবন্ধ এই কৃত্রিম মাংস বিষয়েই।
কেন কৃত্রিম মাংস
কেন বিজ্ঞানীরা কৃত্রিম মাংস নিয়ে গবেষণা করছেন, তা আগে খুঁজে বের করা দরকার। বাস্তুসংস্থানের নিয়ম অনুযায়ী, কোনো বাস্তুসংস্থানে যত বেশি শক্তি ধাপ তৈরি হয়, শক্তির অপচয় তত বাড়তে থাকে। এই বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করেছেন গত শতকের মধ্যভাগের বাস্তুতন্ত্রবিদ রেমন্ড লিন্ডম্যান তাঁর ১০ শতাংশ শক্তি তত্ত্বে। তিনি উল্লেখ করেছেন, বাস্তুতন্ত্রের কোনো ধাপ থেকে অপর ধাপে যাওয়ার সময় মোট শক্তির ৯০ শতাংশ খরচ হয়। বাকি মাত্র ১০ শতাংশ শক্তিই পরবর্তী ধাপের খাদকের শরীরে পৌঁছায়।
এই ছবিতে ১০ শতাংশ শক্তি তত্ত্ব ব্যাখ্যার চেষ্টা করা যাক। বাস্তুতন্ত্রের মূল উৎপাদক হল সবুজ উদ্ভিদ যারা সালোকসংশ্লেষণের মাধ্যমে খাদ্য প্রস্তুত করে। এখন, গাছের নিজের শারীরবৃত্তীয় কার্যক্রম পরিচালনার জন্য শক্তি প্রয়োজন। এই কাজে উদ্ভিদ তাঁর মোট উৎপাদন করা শক্তির ৯০ শতাংশ শক্তি ব্যবহার করে। বাস্ততন্ত্রে এরপরের ধাপে আসছে তৃণভোজী প্রাণীরা। এরা সরাসরি উদ্ভিদকে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে। এসকল তৃণভোজী প্রাণী যে ১০ শতাংশ শক্তি পেল, তার মধ্য থেকে এটি নিজের শারীরবৃত্তীয় কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ৯০ শতাংশ শক্তি ব্যয় করবে। ফলে ধীরে ধীরে বাস্তুতন্ত্রে শক্তির পরিমাণ হ্রাস পেতে থাকবে।
এক্ষেত্রে, প্রাণিজ উৎস থেকে আমিষ সরবরাহের জন্য অতিরিক্ত পরিমাণ শক্তি প্রয়োজন। তাই উদ্ভিজ্জ উৎস থেকে আমিষ সংগ্রহ করা বর্তমান বৈশ্বিক উষ্ণায়নের সময় সর্বাধিক কার্যকরী পন্থা। কিন্তু মানুষ সেই প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে প্রাণিজ আমিষকে আমিষের প্রধান উৎস হিসেবে ব্যবহার করে আসছে। তাই, এই পরিস্থিতিতে মানুষের জিহ্বার স্বাদকে সমুন্নত রাখতে বিজ্ঞানীরা নিয়ে এসেছেন কৃত্রিম মাংস।
কৃত্রিম মাংস সম্পর্কে প্রথম চিন্তা
কৃত্রিম মাংস সম্পর্কে মানুষের সর্বপ্রথম ধারণা আসে কোষকলা প্রকৌশল (টিশু এঞ্জিনিয়ারিং) থেকে। একটি উদ্ভিদের কিছু সংখ্যক কোষকলা বা কলা থেকে যদি কোষকলা প্রকৌশলের মাধ্যমে পূর্ণ একটি উদ্ভিদের বিকাশ হতে পারে, তবে প্রাণীর একটি কোষ থেকে কেন একটি পূর্ণাঙ্গ প্রাণী সৃষ্টি হতে পারে না!
তবে মানুষ যে কোষকলা প্রকৌশলের বহু আগে থেকেই এই বিষয়ে ভাবছে, তার প্রমাণ ফুটে উঠেছে উইনস্টন চার্চিলের কথায় (হ্যাঁ, বাংলার দুর্ভিক্ষের জন্য কুখ্যাত সেই ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিলের কথাই হচ্ছে)। ১৯৩১ সালে এক প্রবন্ধে তিনি উল্লেখ করেন,
হরমোন, যা মূলত রক্তে বাহিত রাসায়নিক দূত; এর সম্পর্কে বিস্তারিত জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে কোষের বৃদ্ধিকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে। একটি মুরগির পাখার মাংস খাওয়ার জন্য সম্পূর্ণ মুরগিটিকে ব্যবহার করার প্রতিবন্ধকতাকে আমরা অতিক্রম করতে পারবো যদি আমরা উপযুক্ত পরিবেশে আলাদা আলাদাভাবে তাদের তৈরি করতে পারি।
১৯৭১ সালে রাসেল রস উদ্ভিদের ইন-ভিট্রো (কাচের ভেতর) পদ্ধতিতে উদ্ভিদের স্টেম কোষ (বা সস্য কোন) ব্যবহার করে অল্প কিছু কোষ থেকে প্রচুর উদ্ভিদ তৈরির পরীক্ষা চালিয়েছেন। এই কাজে তিনি সফলতা পান। তিনি ধারণা করেছিলেন, উদ্ভিদের ন্যায় প্রাণীর ক্ষেত্রেও এরূপ কিছু করা যাবে এবং এটিই ছিল কৃত্রিম মাংস আবিষ্কারের পথে প্রথম বৈজ্ঞানিক অনুকল্প।
কৃত্রিম মাংস তৈরির প্রচেষ্টাসমূহ
নাসা শুরু থেকেই তাদের মহাকাশচারীদের খাদ্য সরবরাহ বিষয়ে চিন্তিত ছিল। মহাকাশে প্রাণিজ আমিষের স্বাদ ও গুণাগুণ নষ্ট হয়ে যাওয়ার একটি সম্ভাবনা আছে। অন্যদিকে উদ্ভিজ্জ আমিষ সরবরাহের ফলে স্বাদের ভিন্নতা সৃষ্টি হবে না। এই পরিস্থিতিতে কৃত্রিম মাংস ছিল এক উপযুক্ত সমাধান। তাই কৃত্রিম মাংস সংক্রান্ত গবেষণায় নাসাও শুরু থেকে যুক্ত ছিল। তারা মূলত টার্কির কোষ ব্যবহার করে ২০০১ সাল থেকেই কৃত্রিম মাংস সংক্রান্ত গবেষণা করে আসছেন।
২০০৩ সালে হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের কারিগরি সহায়তায় ওরন ক্যাত এবং আয়োনেট জুর যুক্তরাষ্ট্রে একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করেন। এই প্রদর্শনীতে তারা একটি ব্যাঙের সস্য কোষ ব্যবহার করে তৈরি কৃত্রিম মাংসের স্টেক প্রদর্শন করে দেখান। সেই কৃত্রিম মাংসের স্টেকের দৈর্ঘ্য ছিল মাত্র কয়েক সেন্টিমিটার। প্রদর্শনীতে সাধারণ মানুষের সামনেই সেই মাংস রান্না করে খাওয়া হয়।
কৃত্রিম মাংস বিষয়ে ২০০৮ সালে পেটা (পিপল ফর এথিকাল ট্রিটমেন্ট অফ অ্যানিমালস—প্রাণিকুলের প্রতি নৈতিক আচরণের সমর্থনে গোষ্ঠী) এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ নেয়।
পেটা ২০০৮ সালে ১০ লক্ষ মার্কিন ডলারের পুরষ্কার ঘোষণা করে। যেই প্রতিষ্ঠান ২০১২ সালের মধ্যে প্রথম বাণিজ্যিকভাবে ভোক্তাদের হাতে কৃত্রিম মুরগির মাংস তুলে দিতে পারবে, সেই প্রতিষ্ঠান এই পুরস্কার লাভ করবে। পুরস্কার লাভের দুইটি শর্ত ছিল:—
- উৎপাদিত কৃত্রিম মুরগির মাংসকে প্রাকৃতিক মুরগির মাংস থেকে আলাদা করা যাবে না।
- বাণিজ্যিক আকারে উৎপাদন এমনভাবে করতে হবে যাতে কৃত্রিম মাংস মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ১০টি অঙ্গরাজ্যে জনসাধারণের কাছে বিক্রির জন্য উন্মুক্ত করা যায়।
উপযুক্ত প্রার্থী না পাওয়ার কারণে ২০১২ সালে থেকে বর্ধিত করে প্রতিযোগিতার মেয়াদ ২০১৪ সালের মার্চ পর্যন্ত করা হয়। কোনো সফলতা ছাড়াই এই প্রতিযোগিতা শেষ হলেও এর প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। এই প্রতিযোগিতা বিজ্ঞানী মহলে বেশ সাড়া ফেলে। বিজ্ঞানী সমাজ আড়মোড়া ভেঙে জেগে উঠে। ফলে, এ সংক্রান্ত গবেষণা বেগবান হয়।
প্রথম জনসমক্ষে প্রকাশ
২০১৩ সালের আগস্ট মাস। কৃত্রিম মাংস সংশ্লিষ্ট গবেষণার ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন। এই দিন সর্বপ্রথম জনসাধারণের সামনে কৃত্রিম মাংসের তৈরি বার্গার প্রদর্শন করা হয়। ড. মার্ক পোস্ট যুক্তরাজ্যের লন্ডন শহরে এই প্রদর্শনী পরিচালনা করেন। এই কৃত্রিম মাংসের বার্গার তৈরির পিছনে তিনি প্রায় ২ বছর সময় ব্যয় করেন। সবমিলিয়ে ৩ লক্ষ মার্কিন ডলারের প্রয়োজন হয় এই কৃত্রিম মাংস তৈরি করতে।
অস্ট্রীয় পুষ্টিবিজ্ঞানী হানি রুৎসলার নামে একজন সেখানে উপস্থিত ছিলেন। এই বার্গারের পরীক্ষণ শেষ করে তিনি মন্তব্য করেন,
আমি যেহেতু পূর্বে থেকেই জানি যে, এতে কোনো চর্বি নেই; তাই আমি জানি না যে এটি ঠিক কতটা রসালো হবে। তবে আমি বেশ তীব্র স্বাদ পেয়েছি। এটি মাংসের কাছাকাছি, তবে মাংসের মত সরস নয়। তবে, নিখুঁতভাবে মসৃণ।
সর্বপ্রথমে ড. মার্ক পোস্ট জানান যে, এক অজ্ঞাতনামা ব্যক্তি এই পুরো প্রকল্পের জন্য অর্থ প্রদান করেন। পরবর্তীতে জানা যায়, এই পুরো প্রকল্পের অর্থায়ন করেছেন সের্গেই ব্রিন।
আরো পড়ুন: সাভান্ট সিনড্রোম ও কিছু মানুষের বদলে যাওয়া জীবনের গল্প (পর্ব ১)
বাণিজ্যিক উৎপাদন
২০১৩ সালে জনসমক্ষে প্রদর্শনের পর থেকে একে বাজারে নিয়ে আসার প্রচেষ্টা শুরু হয়। ২০১৫ সালে ম্যাসট্রিক্ট বিশ্ববিদ্যালয় কৃত্রিম মাংস বিষয়ক একটি কনফারেন্সের আয়োজন করে। তখন থেকে প্রচুর বাণিজ্যিক এবং অলাভজনক সংস্থা এতে জড়িয়ে পড়ে। এদের মধ্যে নিউ হারভেস্ট এবং দ্য গুড ফুড ইন্সটিটিউট উল্লেখযোগ্য। এরা প্রতি বছরেই নানারূপ সভা, সমিতি ও কনফারেন্সের আয়োজন করে। এই বিষয়ে বিশেষজ্ঞ বিভিন্ন বিজ্ঞানীরা মিলিত হন এবং এই ব্যবস্থার উন্নতিকল্পে আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন।
‘মেম্ফিস মিট’ নামের সিলিকন ভ্যালি উদ্যোগ ২০১৫ সালে যাত্রা শুরু করে। ২০১৭ সালের মার্চ মাসে তারা কৃত্রিম মুরগির পাখার মাংস সর্বসমক্ষে প্রদর্শন করে।
২০১৬ সালে ইজ়রায়েলি প্রতিষ্ঠান ‘সুপারমিট’ যাত্রা শুরু করে। এই প্রতিষ্ঠানটি কৃত্রিম মুরগির মাংস নিয়ে গবেষণা করছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সান ফ্রান্সিসকো অঙ্গরাজ্যের ‘ফিনলেস ফুড’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান ২০১৬ সালে যাত্রা শুরু করে। ২০১৭ সালে তারা ল্যাবরেটরিতে গবেষণা শুরু করে। পরিচালক মাইক সেলডেন ২০১৮ সালের শেষদিকে এক সংবাদ সম্মেলনে জানান যে, ২০২০-এর শেষ বা ২০২১-এর শুরুর দিকে তারা বাণিজ্যিক বিপণনে যাবেন। তবে, করোনা পরিস্থিতির কারণে তাদের গবেষণা কার্যক্রম ব্যাপকভাবে বাধাগ্রস্ত হয়েছে।
২০১৮ সালে স্প্যানিশ প্রতিষ্ঠান ‘মিটেবল’ যাত্রা শুরু করে। ‘১৮ এর সেপ্টেম্বর মাসের তথ্যানুযায়ী, তারা প্রাণীর শরীরের আম্বিলিকাল কর্ডের কোষ ব্যবহার করে কৃত্রিম মাংস তৈরি শুরু করেছে।
২০২০ সালের মে মাসে কোয়ার্টজ় এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, বর্তমানে সারা বিশ্বে প্রায় ৩০টি প্রতিষ্ঠান কৃত্রিম মাংস বিষয়ে গবেষণা চালাচ্ছে।
… … …
পরবর্তী পর্বের জন্য চোখ রাখুন অসামান্যতে মোঃ রেদোয়ান হোসেন এর লেখায়
ফিচার চিত্রসূত্র – Interest.co.nz
তথ্যসূত্র –
খুব সুন্দর একটি নিবন্ধন। বেশ কিছু ইনফর্মেশন পেলাম এটি থেকে। পরবর্তী পর্বের অপেক্ষায় রইলাম ♥
ধন্যবাদ আপনাকে আপনার মতামতের জন্য। ইনশাআল্লাহ দ্রুত লিখবো পরবর্তী পর্ব।