- আলো-আঁধারে: প্রিন্সেস ডায়ানা, মাদার তেরেসা ও মহাত্মা গান্ধী - November 26, 2020
- উইলিয়াম জেমস সিডিস: ইতিহাসের সবচেয়ে বুদ্ধিমান ব্যক্তি - October 2, 2020
উইলিয়াম জেমস সিডিস ছিলেন এমন একজন ব্যক্তি যিনি ছিলেন সর্বকালের অন্যতম সেরা বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন এবং বিজ্ঞানী নিউটন থেকেও অধিক আইকিউ সম্পন্ন। বিজ্ঞানী আইনস্টাইন ও নিউটন ছিলেন যথাক্রমে আনুমানিক ১৬০ ও ১৫২ আইকিউ ক্ষমতাসম্পন্ন, যেখানে সিডিস এর আইকিউ ছিল আনুমানিক ২৬০! যা এই পর্যন্ত সবচেয়ে বড় সংখ্যা আইকিউ পরিমাপের ক্ষেত্রে। এমনকি বর্তমান সময়ের অন্যতম বিশিষ্ট তরুণ উদ্যোক্তা ফেসবুকের সহ-প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জাকারবার্গ এর আইকিউও হলো ১৫২।
কিন্তু অসাধারণ এই প্রতিভার অধিকারী হয়েও সিডিস ছিলেন লোকচক্ষুর আড়ালে। খুব কম মানুষই আছেন যারা সিডিস সম্পর্কে জানেন। মূলত ব্যক্তিগত জীবনে সিডিস ছিলেন জনপ্রিয়তাবিমুখ মানুষ। খ্যাতি, যশ এসবের মোহ কখনই তাকে আকৃষ্ট করেনি আর এই কারণেই হয়তো তিনি ছিলেন লোকচক্ষুর আড়ালে।
আমাদের প্রজন্মের সবচেয়ে বড় আবিষ্কার এটি জানা যে, অভিব্যক্তি পরিবর্তনের মাধ্যমেই মানুষ জীবনকে বদলে ফেলতে পারে!
জেমস সিডিস, সূত্র: Goodreads
১৮৯৮ সালের পহেলা এপ্রিল নিউইয়র্ক সিটিতে জন্মগ্রহণ করা উইলিয়াম জেমস সিডিস ছিলেন একইসাথে তুখোড় গণিতবিদ এবং বহু ভাষাবিদ। মাত্র ১৮ মাস বয়সেই তিনি দ্য নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকা সাবলীলভাবে পড়তে পারতেন। ৮ বছর বয়সেই ৬টি ভাষায় (ফ্রেঞ্চ, জার্মানি, রুশ, হিব্রু, তুর্কি, আর্মেনিয়ান) পারদর্শিতা অর্জন করেছিলেন সিডিস। এমনকি তিনি এতটাই প্রতিভাবান ছিলেন যে তিনি “ভেন্ডারগুড” নামে নিজের একটা ভাষাও তৈরি করেন।
মূলত সিডিসের বহু ভাষাবিদ হওয়ার পিছনে তার পিতা বরিস সিডিসের ভূমিকাও ছিল তাৎপর্যপূর্ণ। বরিস ছিলেন সেই সময়ের সেরা মনোচিকিৎসকদের একজন। বহু ভাষায় তিনি পাণ্ডিত্য অর্জন করেছিলেন। মূলত ভাষার প্রতি এই টানই তাকে আগ্রহী করেছিল সিডিসকে বহু ভাষার শিক্ষা দেওয়ার জন্য। সিডিস এর মা সারাহ উইলিয়ামসও ছিলেন সেসময়ের সেরা চিকিৎসকদের একজন। সুতরাং জন্মসূত্রেই সিডিস প্রতিভাবান হবেন এটা বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে তার মেধার প্রখরতা ছিল বরিস ও সারাহ এর ধারণার বাইরে। বরিস এবং সারাহ ছিলেন ইউেক্রন শরণার্থী। শরণার্থীদের মধ্যে অনেকেই নিউইয়র্ক সিটিতে আশ্রয় নিয়েছিলেন, এমনকি অনেকেই বোস্টন শহরে।
সিডিসের মেধার জোর ধরেই পিতা বরিস মাত্র ৮ বছর বয়সেই হাভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে যান। কিন্তু বয়স কম হওয়ার কারণে কর্তৃপক্ষ বরিসকে ভর্তি করতে রাজি না হলেও, ৩ বছর পরে ১১ বছর বয়সে প্রতিভার দুরন্তপনা দেখে তারা তাকে ভর্তি করতে বাধ্য হন। তুখোড়তার দরুন সিডিস সবক্ষেত্রেই নিজের প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন। ১৯১০ সালে যখন তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন তরুণ শিক্ষার্থী তখনই তিনি গণিতের জটিল বিষয় শিক্ষকদের চেয়ে ভালো পড়াতে পারতেন। এমনকি কোনও কোনও বিষয় তাদের চেয়েও ভালো বুঝতেন। অতঃপর তরুণ এই প্রতিভাবান মাত্র ১৬ বছর বয়সেই তার স্নাতক সম্পন্ন করেন।
আইকিউ পরিমাপের ক্ষেত্রে ১০০ কে ধরা হয় সাধারণ পরিমাপ যেখানে ১৩০ এর উপরের পরিমাপকে বলা হয় অনন্যসাধারণ বা আশীর্বাদপ্রাপ্ত এবং ৭০ এর নিচের পরিমাপকে ধরা হয় কম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন। এবং ধারণা করা হয় সিডিস এর আইকিউ ছিল আনুমানিক ২৫০ এর উপরে এবং তা ছিল ৩টা মানুষের আইকিউ এর সমষ্টি।
কোন জিনিস এড়িয়ে যেতে হবে, সে সম্পর্কে ধারণাই মানুষকে জ্ঞানী করে তোলে।
জেমস সিডিস, সূত্র: Goodreads
যথার্থই বলেছেন জেমস সিডিস। নিজেদের সম্পর্কে সঠিক মূল্যায়নই মানুষকে আলোর পথে নিয়ে যেতে পারে।
আরও পড়ুন: শ্রোডিঙ্গার এবং তাঁর সমীকরণ ও বিড়ালের গল্প
সর্বোচ্চ আইকিউ এর অধিকারী হয়েও সিডিসের সেই গুণের প্রতি আগ্রহ ছিল না। তিনি ছিলেন নির্জনপ্রিয়, কোলাহলবিমুখ মানুষ এবং নিজের মতো থাকতে পছন্দ করতেন এবং একাধিকবার তিনি এই কথা জনসমক্ষেও বলেছেন। নির্জনতাতেই তিনি নিজেকে উপলব্ধি করতে পারতেন।
সিডিসের মেধার তুখোড়তা দেখে ছোট থেকেই তার লালনপালনের প্রতি আলাদা যত্ন নেন বরিস ও সারাহ। তার জন্য আলাদা করে প্রত্যেক জিনিসের ব্যবস্থা করেন তারা। কোন প্রকার দ্বিধা-দ্বন্দ ছাড়াই তারা বিপুল পরিমাণ অর্থ সিডিসের জন্য বই কেনার ক্ষেত্রে ব্যয় করেছেন। অবশ্য একটি নির্দিষ্ট বয়স পর্যন্ত সিডিস তাদের কথা অনুযায়ী চললেও তাদের প্রদত্ত শিক্ষাকে আদর্শ হিসেবে মান্য করলেও পরবর্তীতে তিনি তাদের দায়ী করেন তার সাথে ঘটে যাওয়া সব অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার জন্য। এমনকি পিতামাতার সাথে সিডিসের সম্পর্কের এতটাই অবনতি ঘটেছিল যে, সিডিস তার পিতার মৃত্যুর সময়ও তাকে দেখতে যান নি।
অল্পকিছুকাল সিডিস রাইস ইন্সটিটিউট এ গণিত শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। কিন্তু তিনি তার শিক্ষার্থীদের তুলনায় বয়সে ছোট ছিলেন। ফলশ্রুতিতে তিনি তাদের সাথে মিলিয়ে উঠতে না পারায় অল্পকাল পরেই তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়। সেসময় তিনি বলেছিলেন শিক্ষকতা পেশা কখনোই তাকে আকর্ষণ করে নি। বরাবরের মতোই তাই তিনি এই পেশা থেকে অব্যহতি নেন।
কালোত্তীর্ণ কোনো কিছুর জন্য সময় অতিবাহিত করাই জীবনের সবচেয়ে দামী ব্যবহার।
জেমস সিডিস, সূত্র: Goodreads
বিভিন্ন সূত্র হতে জানা যায়, যদিও সিডিস বলেছিলেন তিনি একা থাকতে পছন্দ করেন এবং দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন যে কখনই তিনি বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হবেন না, তবুও হাভার্ড শিল্প ও বিজ্ঞান স্কুলের শিক্ষার্থী মার্থা ফলের সাথে সম্পর্কে আবদ্ধ হন। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো এই সম্পর্কও শেষ পর্যন্ত বিফলে যায়।
এরপর সিডিস কিছুটা ভবঘুরে জীবনযাপন শুরু করেন। এর মধ্যে ১৯১৯ সালে মিথ্যা মামলার দায়ে তাকে ১৮ মাসের সাজাও প্রদান করা হয়। এতকিছুর পর সিডিস দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হন একান্তে বসবাসের জন্য, নির্ঝঞ্ঝাট এক জীবনের জন্য। কিন্তু যেখানেই তিনি যান, তার প্রতিভার স্বাক্ষর তাকে জনপ্রিয় করে তোলে। তিনি এতটাই অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছিলেন যে, তিনি আদালতে মামলাও দায় করেছিলেন এই অভিযোগ যে, মানুষ অযাচিতভাবে তার ব্যক্তিজীবনে হস্তক্ষেপ করছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় এতকিছুর পরও আদালত তার এই মামলা প্রত্যাখ্যান করে। পরবর্তীতে তিনি আর চেষ্টা করেননি।
শেষ পর্যন্ত অসাধারণ প্রতিভার এই ব্যক্তি সামান্য কেরানি হিসেবে মাত্র ৪৪ বছর বয়সে মতিষ্কে রক্তক্ষরণজনিত কারণে মৃত্যুবরণ করেন, ঠিক সেভাবেই যেভাবে তার পিতা ৫৬ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। সিডিস এতটাই অতিষ্ঠ হয়েছিলেন যে, তিনি শেষ পর্যন্ত এটাও বলেন গণিতের সূত্র তাকে মানসিকভাবে এবং শারীরিকভাবে অসুস্থ করে তুলেছে। তিনি বিষয়টিকে এভাবে ব্যাখা করেছেন –
“All I want to do is run an adding machine, but they won’t let me alone.”
আমি কেবল গুনতে চাচ্ছিলাম, কিন্তু তারা আমাকে সেটুকুও করতে দিলো না!
জেমস সিডিস
লেখক হিসেবেও সিডিস ছিলেন সমভাবে পারদর্শী। কিন্তু তার অনেক লেখাই ছদ্মনামে প্রকাশিত হওয়ার কারণে তার এই গুণটি মানুষের অজানা। তার উল্লেখযোগ্য কিছু গ্রন্থের মধ্যে দ্য ট্রাইবস এন্ড দ্য স্টেটস, প্যাসাকোনাওয়ে ইন দ্য হোয়াইট মাউন্টেইনস, দ্য অ্যানিমেট এবং দ্য ইনানিমেট উল্লেখযোগ্য। এদের মধ্যে প্রথমটি যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস নিয়ে প্রায় ১২০০শ পৃষ্ঠার একটি বই। তবে তিনি মূলত খ্যাতি অর্জন করেছিলেন তার অ্যানিমেট এবং দ্য ইনানিমেট গ্রন্থের জন্য, যেটি সেসময়ে যথেষ্ট সাড়া ফেলেছিল।
একজন চাইল্ড প্রডিজি হওয়ার কারণেই হয়তো সিডিস লেখালেখির পাশাপাশি কবিতা রচনাও সমভাবে পারদর্শী ছিলেন। তিনি ফরাসি ভাষায় একটি কবিতা রচনার পাশাপাশি ইথিওপিয়ার জন্য একটি সংবিধানও রচনা করেছেন। সিডিসের বৈচিত্র্যময় জীবন নিয়ে অ্যামি ওয়ালেস লিখেছেন দ্য প্রডিজি বই।
বাল্যকালে সিডিসকে যতটা গণমাধ্যমের ভোগান্তি সইতে হয়েছে সেই তুলনায় যৌবনকালে লোকচক্ষুর আড়ালে থেকে তিনি যথার্থই জীবনের প্রকৃত আনন্দ উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। পাঠকের কাছে প্রশ্ন রেখে নিবন্ধ শেষ করছি,
সিডিস যদি এভাবেই নিজের জীবন কাটাতে চেয়েছিলেন, তবে কেনই বা তার জীবনকাহিনী একটি ট্র্যাজেডি হবে?
তথ্যসূত্র:
ফিচার ছবিসূত্র: Wikimedia Commons
সম্পর্কিত নিবন্ধসমূহ: