- আয়না কাহিনি: মনোহারিণী আয়নার একাল সেকাল - January 9, 2021
- রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ: বাংলা সাহিত্যের এক ক্ষণজন্মা নক্ষত্র - December 23, 2020
- বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন: আবির্ভূত হয়েছিলেন যিনি হাতে নিয়ে আলোকবর্তিকা - December 9, 2020
“আয়না, জাদুর আয়না, বলো তো এই পৃথিবীতে কে বেশি সুন্দরী?” বেচারা জাদুর আয়না উত্তর করলো, “তুমি সবচেয়ে সুন্দরী।” এরপর আবার একদিন যখন জিজ্ঞেস করলো তখনও জাদুর আয়না একই উত্তর করলো। পরে হঠাৎ একদিন সে উত্তর করলো, “সিনড্রেলা সবচেয়ে বেশি সুন্দরী।” আর যায় কোথা! সেদিন থেকে বেচারি সিনড্রেলার কপালের দুঃখ যেন আরও বেড়ে গেলো। সে যাক গে, সিনড্রেলার গল্প তো ছোটবেলায় সবাই পড়েছি কিন্তু আয়নার গল্প আমরা কতজন জানি? হ্যাঁ, আজকে আমরা জানবো আয়নার আদ্যোপান্ত।
বর্তমানে আয়না খুবই সহজলভ্য একটি অনুসঙ্গ। সাজসজ্জার সাথে যা ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। সামান্য কারণে বাইরে বেরোতেও যেন আয়নায় নিজেকে একবার না দেখলেই নয়। একারণে বাড়িতে অপরিহার্যভাবে ড্রেসিং টেবিলে তো আয়না থাকছেই, সাথে শৌখিনতার জন্য ঘর সাজানোর কাজেও হচ্ছে আয়নার ব্যাপক ব্যবহার। আর মেয়েদের হ্যান্ডব্যাগ যেন আয়নার নিজস্ব আবাসস্থল।


কিন্তু এই আয়নার ধারণা এলো কোথা থেকে? মনে করা হয় প্রাচীন লোকজন স্থির জলাশয়ে নিজেদের প্রতিচ্ছবি দেখে আয়না তৈরির ধারণা পায়। চকচকে প্রস্তর বা শীলাখন্ডকে প্রথমে আয়না হিসেবে ব্যবহার করার চেষ্টা করা হয়েছিল। ধীরে ধীরে ধাতব পৃষ্ঠকে মসৃণ করে আয়নার রূপ দেয়া হয়।
প্রাচীনযুগের আয়না
প্রাচীন মিশরীয়, রোমান এবং গ্রীকরা আয়না বেশ পছন্দ করত। প্রাচীনকালে আয়না এতটা সহজলভ্য ছিল না। কেবলমাত্র অভিজাত লোকেরাই আয়না ব্যবহারের সুযোগ পেত। শুধুমাত্র বিলাসবহুল ও শৌখিনতার জন্যই নয় বরং আয়না যেন তাদের আভিজাত্যেরই প্রতীক ছিল। আয়না থাকলে তাকে অবস্থাসম্পন্ন লোক বলে ধরে নেয়া হতো। চকচকে ধাতবপৃষ্ঠকে মসৃণ করে আয়নার কাজে ব্যবহার করা হতো। সাধারণত ব্রোঞ্জ, তামা, লোহা দিয়ে আয়না বানানো হতো। এগুলো অত্যন্ত ভারী হওয়ায় আয়নার আকৃতি হতো ছোট। ছোট গোলাকৃতির আয়না বানানো হতো, যার একটি ছোট হাতলও থাকতো। হাতলে থাকতো বিভিন্ন ধরনের নকশা।
আধুনিক আয়নার আবিষ্কার উনবিংশ শতাব্দীতে হলেও প্রায় ৮০০০ বছর আগে প্রাচীন আনাতোলিয়ায় (বর্তমান তুরস্কে) প্রথম আয়নার সন্ধান পাওয়া যায়। সেগুলো ছিল পালিশ করা আগ্নেয়গিরির পাথর। পরবর্তীতে ৪০০০-৩০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মেসোপটেমিয়া (বর্তমান ইরাক) ও মিশরীয়রা তামার পাতে পালিশ করে আয়না তৈরি করে। প্রায়শই আয়নার গোল মুখটি কারুকার্য করে দৃষ্টিনন্দন করে তোলা হতো। অনেকসময় অলঙ্কার দিয়েও সজ্জিত করা হতো।


রোমানদের কাছ থেকে সেল্টরা হাতলওয়ালা আয়নার ব্যবহার গ্রহণ করেছিল এবং তা মধ্যযুগের শেষের দিকে পুরো ইউরোপ জুড়ে প্রচলিত হয়ে ওঠে, এগুলো সাধারণত রূপার তৈরি হত। প্রায় ২০০০ বছর পূর্বে মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকায় পাথরগুলোকে পালিশ করে আয়না হিসেবে ব্যবহার করা শুরু করে। চিনে প্রথম ধাতব মিশ্রণকে পালিশ করে আয়না তৈরি করা হয়। টিন এবং তামার মিশ্রণে বেশ মসৃণ ধাতব পাত তৈরি করা হত। যা বেশ ভালোভাবে পালিশ করে আয়না হিসেবে ব্যবহার করা হত।
আয়নার আধুনিক যুগ
ধারণা করা হয়, ধাতব পারা লাগানো কাচের তৈরি আয়নাগুলো খ্রিষ্টীয় প্রথম শতাব্দীতে লেবাননে প্রথম তৈরি করা হয়েছিল। রোমানরা প্রথম গলিত কাঁচের পৃষ্ঠে সীসার পারা লাগানো অপরিশোধিত আয়না তৈরি করেছিল। কাচের আয়না তৃতীয় শতাব্দীতে প্রথম উৎপাদিত হয়। মিশর, গল, জার্মানি এবং এশিয়াতে আয়নার বেশ প্রচলন ঘটেছিল।
ধাতব পারা লাগানো কাঁচের আয়নার ব্যবহার দ্বাদশ শতকের শেষ এবং ত্রয়োদশ শতাব্দীর শুরুতে শুরু হয়েছিল। নার্নবার্গ ও ভেনিস আয়না উৎপাদনকেন্দ্র হিসাবে অসামান্য খ্যাতি অর্জন করেছিল। ফ্রান্সে সেন্ট-গোবাইন নামক আয়না তৈরির একটি কারখানা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ভেনিসে উৎপাদিত আয়নাগুলো তাদের উচ্চমানের জন্য বিখ্যাত ছিল। সপ্তদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে লন্ডন এবং প্যারিসে আয়না তৈরির ব্যাপক প্রচলন করা হয়। সাধারণত আয়নাগুলো অত্যন্ত ব্যয়বহুল ছিল। বিশেষত এর বৃহত্তর বৈচিত্র্য ছিল ভার্সাই নগরীর রাজপ্রাসাদে আয়নার ব্যবহার। রাজকীয় প্রাসাদের কক্ষগুলোকে সজ্জিত করা হতো আয়না ব্যবহার করে।


সপ্তদশ শতাব্দীর শেষের দিক থেকে, আয়না এবং আয়নায় ব্যবহৃত ফ্রেম অন্দরসজ্জার ক্ষেত্রে ক্রমবর্ধমান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। সাধারণত ফ্রেমগুলো হাতির দাঁত, রূপা, আবলুস কাঠ দিয়ে সজ্জিত ছিল। সুতার কাজ এবং পুঁতির কাজও করা থাকতো বিভিন্ন আয়নার ফ্রেমে।
১৮৩৫ সালে জার্মান রসায়নবিদ ভন লিবিগ রূপার পারা লাগানো কাঁচের আয়না তৈরি করেছিলেন। যেখানে কাঁচের ওপর সিলভার নাইট্রেট্রের একটি পাতলা স্তর ফেলে দেয়া হয়। এই প্রক্রিয়ার আবিষ্কারটি আয়নাগুলোকে অনেক বড় আকারে তৈরি করতে সক্ষম করে এবং ইতিহাসে প্রথমবারের মতো আয়নাগুলো সাধারণ মানুষের হাতের নাগালে আসে।
আরও পড়ুন: মধু: অসাধারণ এই খাদ্যের উপকারিতা ও ব্যবহার
আয়না পরীক্ষা
আত্মসচেতনতার একটি পরিমাপ হিসেবে ১৯৭০ সালে গর্ডন গ্যালাপ জুনিয়র মিরর টেস্ট বা আয়না পরীক্ষার আবিষ্কার করেন।
মানব শিশু কমপক্ষে ১.৫-২ বছর বয়স না হওয়া পর্যন্ত এই পরীক্ষায় ব্যর্থ হওয়ার অবকাশ থাকে। কুকুর এবং এক বছর বয়সী শিশুরা সাধারণত ভয়ে বা কৌতুহলবশত আয়নায় প্রতিক্রিয়া দেখায় বা উপেক্ষা করে। কিন্তু পাখিরা প্রায় ক্ষেত্রেই আয়নায় নিজেদের প্রতিচ্ছবিকে আক্রমণ করে থাকে। বিড়ালের ক্ষেত্রে এ বিষয়টি বেশ কৌতুহলের! তারা খুব কাছে থেকে নিজেদের দেখতে থাকে।


শিম্পাঞ্জি, ওড়াং ওটাং, ডলফিন, হাতি, কবুতর এবং মানুষ এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেও গরিলা এখন পর্যন্ত এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেনি। সম্ভবত কারণ হিসেবে ধরা হয়, গরিলা নিজের সাথে তার প্রতিবিম্বের চোখের যোগাযোগকে আক্রমণাত্মক অঙ্গভঙ্গি হিসাবে বিবেচনা করে এবং সাধারণত একে অপরের মুখের দিকে তাকানো এড়ানোর চেষ্টা করে।
আয়না নিয়ে যত কুসংস্কার
বর্তমানে আমরা আয়না নিয়ে বিভিন্ন ধরনের কুসংস্কারের সাথে পরিচিত। কুসংস্কারগুলো আজকের তৈরি নয় যুগ যুগ থেকেই এগুলো চলে আসছে।
প্রাচীন রোমানদের ধারণা, কোনো বাড়িতে পুরনো আয়না ভেঙে যাওয়া মানে সেই বাড়িটি আগামী ৭ বছরের জন্য অশুভ। বা সেই ব্যক্তির ভেতর থেকে শুভ শক্তির বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া। আবার সেই অভিশাপ কাটানোর ব্যবস্থাও আছে। ভেঙে যাওয়া আয়নার টুকরোগুলো মাটিতে খুবই গভীর গর্ত করে পুঁতে ফেলতে পারলে এই অভিশাপ থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে।
রোমানরা রাতের বেলা আয়নাগুলোকে ঢেকে রাখতো। যে বাড়িতে কোনো ব্যক্তি মারা যায়, সে বাড়িতে যতগুলো আয়না থাকে সবগুলোকে কাপড়ের সাহায্যে ঢেকে দেয়া হত। তাদের ধারণা ছিল মৃত আত্মারা আয়নার ভেতর ঢুকে যেতে পারে। এবং একবার আয়নার জগতে ঢুকে গেলে পরপারে যাওয়া আর সম্ভব হবে না। স্বর্গেও যেতে পারবেনা।


কুসংস্কারের মধ্যে নবদম্পতিদের জন্য সৌভাগ্যের বিষয়ও রয়েছে। সুখী দম্পতি একসাথে আয়নার সামনে দাঁড়ানো উচিত। তারা কেবল তাদের বিশেষ দিনটিতে নিজেদের কী চমকপ্রদ দেখায় তা খতিয়ে দেখতে পান না, তাদের ভবিষ্যতও দেখতে পান। বলা হয়ে থাকে যে বিবাহিত দম্পতি যদি “I do” বলার কিছুক্ষণ পরেই একসাথে আয়নার দিকে নজর দেয় তবে তারা জন্ম জন্মান্তরের সঙ্গী হিসেবে গণ্য হয়।
এছাড়াও ঘুমানোর সময় যদি আয়নার দিকে মুখ করে ঘুমানো যায় তবে তা আপনার দেহ থেকে আত্মাকে বিচ্ছিন্ন করতে পারে। এমন বিভিন্ন ধরণের অদ্ভুত কুসংস্কার রয়েছে আয়না নিয়ে। ভাঙা আয়নায় মুখ দেখা অমঙ্গলজনক। এই কুসংস্কারটি বর্তমান আধুনিক যুগেও প্রচলিত আছে। প্রিয় পাঠক, আয়না নিয়ে আপনার শোনা কুসংস্কারটি জানাতে ভুলবেন না।
প্রচ্ছদ: Pixabay
তথ্যসূত্র:
সম্পর্কিত নিবন্ধসমূহ: