- আগন্তুক: সত্যজিৎ রায়ের অন্তিম স্বাক্ষর, দ্বিতীয় পর্ব - November 6, 2020
- আগন্তুক: সত্যজিৎ রায়ের অন্তিম স্বাক্ষর, প্রথম পর্ব - October 29, 2020
জীবনের শেষ ভাগ, সত্যজিৎ রায় তখন হৃদরোগে আক্রান্ত। আহমেদ ছফার ভাষায়: দৈনন্দিন বাঙালী জীবনের ক্লেদ-কালিমার স্পর্শ অবহেলা করার সহজাত ক্ষমতা নিয়েই তিনি জন্মগ্রহণ করেছেন। সেই মানুষটি হৃদরোগকেও সমান তালে অবহেলা করতে চাইলেও, ডাক্তারের কড়া নজদারিতে সেটা আর হয়ে ওঠেনি। দিনে তিন-চারটের বেশি দৃশ্য ধারণে ছিল নিষেধাজ্ঞা, বাহিরের ছোটাছুটি করে শ্যুটিং তো একদমই নয়। তাই তাঁর জীবনের শেষ ভাগের ছবিগুলো ইনডোর গল্পেই তৈরি করতে হয়েছিল।
শেষ জীবনে এসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচনা করে গিয়েছিলেন, সভ্যতার সংকট প্রবন্ধটি, তেমনি ভাবে সত্যজিৎ রায় জীবনের সায়াহ্নলগ্নে আগন্তুক সিনেমায় দেখালেন সভ্যতার চলমান সংজ্ঞার বিকলাঙ্গ অবস্থা, কুশ্রীরূপ। অধিকন্তু ছলচাতুরিপূর্ণ সভ্যতার সংজ্ঞা বদলে দিলেন। আমাদের পরিচয় করিয়ে দিলেন এক নতুন মতাদর্শের সাথে।
সত্যজিতের শিল্পদৃষ্টি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, তিনি ছিলেন মানুষের বিশ্বাস ও সাংস্কৃতিক মনোভাব সচেতন। সমাজ, সভ্যতা, আচার সম্পর্কে তীব্রভাবে বিশ্লেষণপ্রবণ। তিনি সাংস্কৃতিক সম্পর্কিত বিষয়গুলোর অভ্যন্তরে যোগাযোগ খোঁজার চেষ্টা করেছেন। স্থানীয় সংস্কৃতিগুলোর স্বাতন্ত্র্য ও স্বকীয় বৈশিষ্ট্যের গুরুত্ব তুলে ধরতে চেয়েছেন আবার সংস্কৃতিগুলোর তুলনামূলক দর্শনেও পিছিয়ে ছিলেন না।
আগন্তুক চলচ্চিত্রে সত্যজিৎ তাঁর নিজস্ব দর্শন, বোধ, বিশ্ব-সাংস্কৃতিক চেতনাকে মনমোহন মিত্রের সংলাপের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন।
চলচ্চিত্রটির মূলভাবের ছায়া তাঁর নিজেরই লেখা অতিথি নামক ছোটগল্পটি থেকে গৃহীত। সিনেমার সংলাপে অতিথি গল্পটি আগন্তুক নামে পাল্টে গিয়েছে। সংযোজিত হয়েছে আরো নবীন দৃশ্য, গল্প, সংলাপ। বিশেষ করে চলচ্চিত্রের শেষের দু’টো বৈঠকের গল্প ও সংলাপের ধারণা মূল গল্প থেকে একেবারেই স্বতন্ত্র ছিল, যা এই সিনেমাকে অন্য সব সিনেমার থেকে অনন্য করে তুলেছে।


‘আগন্তুক’ সিনেমাটি তৈরির ধারণার সময়কাল সম্পর্কে জানা যায় ১৯৯০ সালের ১৬ অক্টোবরে দেবযানী দেবীকে লেখা সত্যজিতের চিঠি থেকে। সেখানে তিনি লিখেছেন:
হঠাৎ একান্ত ব্যস্ত হয়ে পড়েছি। আগামী ২২ নভেম্বর থেকে নতুন ছবি আগন্তুক-এর শ্যুটিং আরম্ভ করছি! … একটি চমৎকার বিষয়বস্তু/কাহিনি মাথায় এসে গেল—দশ দিনের মধ্যে চিত্রনাট্য, কাস্টিং সব শেষ।
চলচিত্রাঙ্গনে সত্যজিৎ রায় যে অতুলনীয় দক্ষতা অর্জন করেছিলেন, তাঁর প্রতিটি কাজের স্বাতন্ত্র্যই সেটির সাক্ষ্য দেয়। সর্বকালের সেরা পরিচালকদের মধ্যে স্থান করে নেওয়া এই বাঙালি পরিচালক, বাঙালিদের মধ্যে যেন হঠাৎ করে উপস্থিত হওয়া ভিনগ্রহের মানুষ। ৬ ফুট ৪ ইঞ্চি লম্বা, গূঢ় ব্যক্তিত্ব, অসামান্য মেধার অধিকারী সত্যজিৎ রায় গড়পড়তা বাঙালির তুলনায় আলাদা স্বাতন্ত্র্য নিয়েই জম্মেছিলেন। তাই তাঁর চিন্তাধারায়ও ছিল মৌলিকত্ব।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পোস্টমাস্টার-এর কথাই ধরুন, মূলগল্পে রতনের ক্লেদাক্ত জীবনকে তুলে ধরতে রবীন্দ্রনাথকে অনেকগুলো শব্দ ব্যবহার করতে হয়েছে। রতনকে পুরোপুরি উপলব্ধি করতে হলে, প্রত্যেকটা শব্দই আলাদা করে উপলব্ধি করতে হবে, যেটা করতে সাধারণ পাঠককে একটু হিমশিম খেতে হয়। সেখানে সত্যজিৎ রায় এই বেদনাকে কয়েক সেকেন্ডের শটেই জাদুকরের মতো উপস্থাপন করলেন!
এমন পরিচালকের জীবনের শেষ সিনেমা আগন্তুক যেখানে তাঁর পুরো জীবনের উপলব্ধিকৃত অভিজ্ঞতা, দর্শন, চিন্তাকে ঢেলে দিয়েছেন। সিনেমার প্রত্যেকটা সংলাপই আলাদা করে গবেষণার দাবি রাখে। সেই সিনেমা দেখতে বসে আলাদা মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন।
চলচ্চিত্রটি শুরু হয় কলকাতার উচ্চ-মধ্যবিত্ত ঘরের সুধীন্দ্র বোসের স্ত্রী অনীলার হাতে খুব সকালে পুরোদস্তুর সাধুভাষায় লেখা একটি চিঠি আসার দৃশ্য দিয়ে। চিঠি পড়ে অনীলা হতবাক, বিস্ময়-বিহ্বল। অনীলার এ অবস্থা দেখে তার স্বামী ঠাট্টা করে বললেন, ম্যাসেজ মেসিভ?
অনীলা তার প্রত্যুত্তরে জানায়, চিঠিটি এসেছে তার ছোট মামা মনমোহন মিত্রের কাছ থেকে, যিনি ৩৬ বছর আগে যুবক বয়সে বাড়ি ছেড়েছিলেন। বর্তমানে তিনি দিল্লীতে অবস্থান করেছেন এবং সেখান থেকেই চিঠি লিখেছেন। এতদিন পর দেশে ফিরে নিজের ভাগনীর বাড়িতে আতিথেয়তা গ্রহণ করতে চান।
অল্প বয়েসে বাড়ি ত্যাগের কারণটি সিনেমার শুরুর দিকের মনোমোহন মিত্রের সংলাপ থেকেই জানা যায়। দু’টো কারণে তিনি বাড়ি ত্যাগ করেছিলেন। তার একটি হলো: বাইসন। ছোটবেলায় তিনি প্রাচীন আলতামিরি গুহাবাসীর আঁকা একটি বাইসনের ছবি দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন। আর ভেবেছিলেন— সভ্য মানুষেরা এই শিল্প তাঁকে শেখাতে পারবে? যে শিল্প হাজার হাজার বছরের ইতিহাসের সাক্ষ্য দেয়, প্রাণের অস্তিত্ব জানায়, সেই শিল্পকে জানতে হলে তাকে সভ্যতার পর সভ্যতা খুঁজে বেড়াতে হবে। বন্য সভ্যতার কাছাকাছি যেতে হবে।
অপর কারণটি উল্লেখের ক্ষেত্রে তিনি একটি জার্মান উচ্চারণ করেন, Wanderlust (ওয়ান্ডারলাস্ট)। বাংলায় যার অর্থ ভ্রমনের নেশা। যে ভ্রমণের নেশায় মত্ত হয়ে পৃথিবীব্যাপী ঘুরে বেরিয়েছিলেন— হিউয়েন, ইবনে বতুতা কিংবা কলম্বাস; সেই একই নেশায় বাড়ি ছেড়েছিলেন মনমোহন মিত্র।
অনীলার চিঠি পাঠের পর, এই বাঙালি দম্পতির মনে সন্দেহ জাগে যে, যিনি চিঠি পাঠিয়েছেন, তিনি আসলেই মনমোহন মিত্র কি না?
সন্দেহ জাগার যৌক্তিক কারণও ছিল। কারণ দীর্ঘকাল ধরে মনোমোহন মিত্রের কারো কোনো যোগোযোগ রাখেননি। তাঁর পরিচয়ের সত্যতা যাচাই করার মতো কোনো আত্মীয়-স্বজনও বেঁচে নেই। একমাত্র অনীলা আছে, যে কি না তাঁর ছোট মামার ব্যাপারে মায়ের মুখ থেকে যতটুকু শুনেছে, তার বাহিরে আর তেমন কিছু জানে না। এমনকি চেহারাও ঠিকঠাক মনে নেই। কেননা, মনোমোহন মিত্র যখন বাড়ি ছাড়েন তখন অনীলা কেবল ছোট্ট খুকি।
এমন অবস্থায় সুধীন্দ্র বোস প্রথমে স্ত্রীকে বলেন যেন তাঁকে অন্য অজুহাত দেখিয়ে আসতে মানা করে দেয়। পরবর্তীতে স্ত্রীর অভিমানে ও বাঙ্গালির অতিথিপরায়ণতার চিরায়ত সংস্কৃতির দূর্বলতায় আগন্তুক অতিথির আগমনকে মেনে নেন। ওদিকে সুধীর-অনীলা দম্পতির একমাত্র ছেলে সাত্যকির শিশু মন আগন্তুককে নিয়ে তৈরি হওয়া এই সন্দেহ-সংশয়কে উপভোগ করতে শুরু করে।
আরও পড়ুন: ব্রিটিশ কমেডি: সময় ছাপিয়ে এখনো দুর্দান্ত যে ৫টি সিটকম


দীর্ঘকাল পরিবারকে ছেড়ে, ভ্রমণের নেশায় ঘুরে বেড়ানো এই মানুষটিকে সভ্য সমাজ দেখতে শুরু করে সন্দেহের চোখে। বস্তুগত উদ্দেশ্য ছাড়া তার এই প্রত্যাবর্তনকে মেনে নিতে পারছে না। সমাজের দরকার স্বীকৃত পরিচয়। আক্ষরিক অর্থে এই স্বীকৃত পরিচয়টাকে যৌক্তিক ধরা হলেও, আগন্তুকের এটা একটি ভাঁওতা বৈ আর কিছুই নয়। আইডেন্টিটি ক্রাইসিস-এ ভোগা এই সমাজকে আগন্তুক সত্যায়িত পরিচয় দেখানো স্বরূপ সুধীন্দ্র বোসকে নিজের পাসপোর্ট দেখালে সুধীন্দ্র বোস যখনই আইডেন্টিটির ব্যাপারে সুনিশ্চয়তার দাবী জানায়, ঠিক তখনই আগন্তুক রূঢ়ভাবে পাসপোর্টটিকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে , সভ্যতার তৈরি করা ছলচাতুরী নির্দেশনার বিপরীতে শক্ত-কঠোর কণ্ঠে বলে উঠলেন:
This passport proves nothing! তুমি জানো এই বিশ্ব দুর্নীতির যুগে এরকম জাল পাসপোর্ট কত সহজেই বানানো যায়?
সক্রেটিসের চিন্তাচেতনায় বোধকরি সত্যজিতও প্রভাবিত হয়েছিলেন। আগন্তুক সিনেমার একটি সংলাপ সেই দিকেই ইঙ্গিত করে। সক্রেটিসের মতে,
তর্ক সত্যের সন্ধান দিতে পারে না, সত্যকে পেতে সময় ব্যয় করতে হয়।
একই কারণে আগন্তুক সুধীন্দ্রকে আইডেন্টিটি সম্পর্কে তৎক্ষণাৎ নিশ্চিত হতে বারণ করেন। এবং বলে দেন, পরিচয় সম্পর্কে অসংশয়িত হতে সময় লাগবে।
কারণ, মানুষের আসল পরিচয় আত্মীয়তার সম্পর্ক কিংবা সামান্য কিছু সত্যায়িত করা কাগজেই নয়, মানুষের প্রকৃত পরিচয় নৈতিকতায়। যা জানতে হলে বইয়ের মত করেই সেই মানুষটিকে পড়ে নেয়ার দরকার পড়ে।
অথচ তথাকথিত উৎকর্ষ সভ্যতার মানুষ একজন জ্বলজ্যান্ত মানুষের আচার-আচরণ, নৈতিকতা, চিন্তাদর্শনকে পরিচয় হিসেবে মানতে নারাজ। আইডেন্টিটি নিশ্চিতকরণে তাদের দরকার পড়ে কয়েক টুকরো সত্যায়িত কাগজ।
অসাধারণ দৃঢ় ব্যক্তিত্ব বহনকারী আগন্তুক একজন বৈশ্বিক নাগরিক, সভ্যতার শিকড় অনুসন্ধানী। যিনি মানুষের পরিচয়, সভ্যতা, সংস্কৃতি নিয়ে ভাবনার জগতে আমাদের এক নতুন চিন্তাদর্শের সাথে সাক্ষাৎ করিয়ে দেন। ভ্রমণের নেশায়, জ্ঞানের নেশায় তিনি ছুটে বেরিয়েছেন দেশ থেকে দেশান্তরে।
আগন্তুক তথাকথিত ধর্মে বিশ্বাস করেন না। কারণ, ধর্ম কোনো না কোনো ভাবে বিভেদের সৃষ্টি করেই। এমনিভাবেই তিনি বিশ্বাস করেন না, ভারতীয় জাতভেদেও। স্ট্রাগলকে তিনি স্ট্রাগল বলেন না, বলেন মগজ-মাংশপেশির পুষ্টি আর মানুষ চেনার প্রথম পদক্ষেপ। তিনি জীবনের একটা অংশে, সাঁওতাল, কোল, নাগা, মুণ্ডা, ওরাওসহ নানা উপজাতিদের মাঝে বসবাস করেছেন। বন্য জীবনই তার কাছে আসল জীবন।
আগন্তুক ধর্ম-জাতে আস্থা না রাখলেও শিকড়চ্যুত হননি। এতকাল স্বদেশ, স্বজাতি থেকে দূরে থেকেও ভুলে যাননি দেশীয় কৃষ্টি-কালচার। দেশীয় সংস্কৃতির প্রতি রয়ে গেছে গভীর মমত্ববোধ।
এ ব্যাপারটি ফুটে ওঠে যখন আগন্তুক দুপুরের খাবার টেবিলে উপস্থিত হন সাহেবী পোষাক ত্যাগ করে, দেশীয় পাঞ্জাবী-পাজামা পরিধান করে। আবার, খাবারে মাংসের আগে মাছ নিতেও তাঁর দুর্বলতা। মেদিনীপুরের আদিবাসী নারীদের তৈরি ডালের বড়ার প্রশংসা করা, এসব প্রমাণ করে দেয় তিনি বৈশ্বিকনাগরিক; যেখানে প্রতিটা সংস্কৃতির প্রতিই তিনি গভীর শ্রদ্ধাশীল।
দুপুরে খাবার টেবিলে বাঙালি খাবার প্রসঙ্গে কথার ছলে ও বিশেষ কৌতুহলবশত এতদিন দেশের বাহিরে থেকেও বাংলা ভাষা ভুলে না যাওয়ার কারণ সম্পর্কে অনীলা বাঙলা ভাষাটি তো ভুলেননি, দিব্যি বলেন, দিব্যি লিখেন এরকম জিজ্ঞাসা করলে, সত্যজিৎ রায় আগন্তুক মনমোহন মিত্রের জবানি থেকে যে উত্তরটি দিয়েছিলেন, সে এক বিস্ময়কর উত্তর।
ব্যাপারটা কি জানো মা, মায়ের ভাষা ভুলতে না চাইলে কেউ ভোলে না। আর যারা ভুলতে চায়, তারা তিন মাসের মধ্যে ভোলে।
সত্যজিৎ রায়ের এই অন্তিম সৃষ্টির প্রায় সবটুকুই অভ্যন্তরীণ প্রেক্ষাপটে তৈরি করা ও সংলাপনির্ভর। এর সংলাপ, ঘরের আসবারপত্র, চরিত্রদের মধ্যে ফুটে উঠেছে, সামগ্রিক পৃথিবীর অস্থিরতা, চিন্তাভাবনার বিক্ষিপ্ত রূপ। দু’টো আলাদা আলাদা বৈঠকে সত্যজিৎ রায় তার নিজস্ব দর্শন, বিশ্বাস, চিন্তাচেতনাকে শৈল্পিকভাবে তুলে ধরেছেন।
প্রচ্ছদ চিত্র: মনোমোহন মিত্র ও সাত্যকি। চিত্রসূত্র: Satyajit Roy
এই আলোচনাটি অনেক প্রাঞ্জল হয়েছে। এমন আলোচনানির্ভর মুভি রিভিউর অপেক্ষায় থাকি। <3 দ্বিতীয় পর্বের অপেক্ষায় রয়েছি।
অসামান্য টিম শীগ্রই দ্বিতীয় পর্ব প্রকাশ করবেন।
লেখকের পক্ষ থেকে আপনাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। 🖤