- তিগ্রাই সঙ্কট: ইথিওপিয়ায় নতুন গৃহযুদ্ধের সূচনা? পর্ব ২ - December 17, 2020
- তিগ্রাই সঙ্কট: ইথিওপিয়ায় নতুন গৃহযুদ্ধের সূচনা? পর্ব ১ - December 13, 2020
- কৃষ্ণসাগরে মিসরীয় নৌবাহিনী: রুশ, মিসরীয় এবং তুর্কি ভূরাজনীতির এক ঝলক - November 1, 2020
অক্টোবর বিপ্লব বিশ্ব রাজনীতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি ঘটনা। ধারাবাহিকের প্রথম পর্বে অক্টোবর বিপ্লবের পটভূমি হিসেবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন পরিস্থিতি, ভ্লাদিমির লেনিনের দেশে ফিরে আসা এবং ব্রেস্ত–লিতোভস্ক চুক্তি স্বাক্ষর সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। আলোচ্য পর্বে থাকছে চুক্তি স্বাক্ষর পরবর্তী সময়ের ঘটনাপঞ্জী এবং কীভাবে বলশেভিক সরকার এই চুক্তি থেকে বের হয়ে আসে সে সম্পর্কিত আলোচনা।
অক্টোবর বিপ্লব সংঘটিত হওয়ার অব্যবহিত পরেই ১৯১৮ সালের মার্চে ভ্লাদিমির লেনিনের নেতৃত্বাধীন বলশেভিকরা যখন জার্মানির নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় শক্তির সঙ্গে অবমাননাকর ‘ব্রেস্ত–লিতোভস্ক চুক্তি’তে স্বাক্ষর করতে বাধ্য হয়, স্বভাবতই তখন লেনিনকে তাঁর রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীরা ‘বিশ্বাসঘাতক’, ‘জুডাস’ এবং ‘জার্মান গুপ্তচর’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন। বস্তুত রুশ রাষ্ট্রীয় স্বার্থ বিসর্জন দেয়ার দায়ে লেনিন ও তাঁর সহযোগীরা অভিযুক্ত হয়েছিলেন এবং এখন পর্যন্ত আধুনিক রাশিয়ায় অনেকেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধে রাশিয়ার পরাজয়ের জন্য লেনিন ও লেনিন-পরিচালিত অক্টোবর বিপ্লবকে দায়ী করে থাকে।
কিন্তু লেনিন কি আসলেই একজন জার্মান গুপ্তচর ছিলেন? দুনিয়া কাঁপানো অক্টোবর বিপ্লব কি আসলেই জার্মান–নিয়ন্ত্রিত একটি ‘সামরিক অভ্যুত্থান’ ছিল মাত্র? অনেকে এটা বিশ্বাস করতে চাইলেও বাস্তবে রাজনীতি এতটা সরলরৈখিক পথে চলে না।
অক্টোবর বিপ্লব: চুলচেরা বিশ্লেষণ
প্রথমত, ‘শত্রুর শত্রু আমার বন্ধু’ এটি রাজনীতিতে একটি বহুল প্রচলিত নীতি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ব্রিটিশ উপনিবেশ যুক্তরাষ্ট্রের বিপ্লবীরা ব্রিটেনের চরম শত্রু ফ্রান্সের সহায়তা গ্রহণ করেছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে পূর্ব পাকিস্তানের মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানের চরম শত্রু ভারতের সাহায্য নিতে ইতস্তত করে নি। সুতরাং রাজনৈতিক স্বার্থে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে জার্মানদের সঙ্গে জোটবদ্ধ হওয়া বলশেভিকদের পক্ষে অস্বাভাবিক ছিল না।
রাষ্ট্রের দৃষ্টিকোণ থেকে এটি অন্যায়, কিন্তু রাজনৈতিক স্বার্থের ক্ষেত্রে ন্যায়–অন্যায়ের বিবেচনা খুব কমই প্রাধান্য পায়। তাছাড়া, বলশেভিকরা বিশ্বাস করত, সাম্রাজ্যবাদী এবং অত্যাচারী রুশ সম্রাট ও পুঁজিবাদী শ্রেণীর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করাটাই ন্যায় এবং তাদের উৎখাত করার জন্য যে কোনো পন্থাই বৈধ!
দ্বিতীয়ত, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় বলশেভিকরা জার্মানদের সঙ্গে সাময়িকভাবে একজোট হলেও এর ফলে তারা জার্মানদের ‘গুপ্তচর’ ছিল এরকমটি প্রমাণ হয় না। বলশেভিকরা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বহু আগে থেকেই রুশ সাম্রাজ্যবাদের বিরোধী ছিল এবং যুদ্ধের সময় তাদের গৃহীত নীতি এজন্য নতুন কিছু ছিল না। ১৮৯৯–১৯০১ সালে রাশিয়া যখন জার্মানি ও অন্যান্য ইউরোপীয় রাষ্ট্রের সঙ্গে মিলে চীন আক্রমণ করেছিল, এবং ১৯০৪–১৯০৫ সালে রাশিয়া যখন জাপানের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত ছিল (এই যুদ্ধের সময় জার্মানি রাশিয়াকে সমর্থন করেছিল), উভয় ক্ষেত্রেই বলশেভিকরা রুশ সরকারের সাম্রাজ্যবাদী নীতির বিরোধিতা করেছিল, এবং রুশ–জাপানি যুদ্ধ চলাকালে বলশেভিকরা রুশ সরকারের বিরুদ্ধে সংঘটিত ১৯০৫–১৯০৭ সালের বিপ্লবে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিল।
তৃতীয়ত, বলশেভিকরা যখন ক্ষমতা দখল করে, তখন জার্মান সৈন্যরা পেত্রোগ্রাদের কাছাকাছি অবস্থান করছিল এবং এর জন্য বলশেভিকদের দায়ী করা যায় না। বস্তুত ১৯১৪–১৯১৭ সালের যুদ্ধে রুশ সশস্ত্রবাহিনী প্রভূত ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিল এবং এর ফলেই জার্মানরা রুশ রাজধানী পর্যন্ত অগ্রসর হওয়ার সুযোগ লাভ করেছিল।
বলশেভিকরা যদি যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিত, সেক্ষেত্রে কী ঘটত? সেক্ষেত্রে জার্মান সৈন্যদের রুশ রাজধানী পেত্রোগ্রাদ দখল করে নেয়ার সম্ভাবনা ছিল এবং এর ফলে রাশিয়ার অস্তিত্বই বিপন্ন হয়ে পড়ত। কার্যত ‘ব্রেস্ত–লিতোভস্ক চুক্তি’তে স্বাক্ষর করার ফলে একদিকে যেমন রাশিয়া বিরাট এক অঞ্চল হারিয়েছিল, অন্যদিকে এই অপমানজনক চুক্তিই রাশিয়াকে জার্মান দখলদারিত্ব থেকে রক্ষা করেছিল!
চতুর্থত, বলশেভিকরা যে জার্মানদের ‘হাতের পুতুল’ ছিল না, তার প্রমাণ পাওয়া যায় এটা থেকে যে, ১৯১৭ সালের ডিসেম্বরে জার্মানদের প্রস্তাবিত শর্তের শান্তি প্রস্তাব বলশেভিকরা প্রত্যাখ্যান করেছিল। কেবল যুদ্ধক্ষেত্রে পরাজিত হওয়ার পরই বলশেভিকরা অপমানজনক ‘ব্রেস্ত–লিতোভস্ক’ চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে বাধ্য হয়েছিল। বস্তুত, বলশেভিকদের বিপর্যয়ের জন্য জার্মানদের সঙ্গে তাদের ‘আঁতাত’ যতটা দায়ী ছিল, তার চেয়ে বেশি দায়ী ছিল তাদের আদর্শগত কারণে গৃহীত ভুল পদক্ষেপ।
পঞ্চমত, বলশেভিকরা অপমানজনক ব্রেস্ত–লিতোভস্ক চুক্তিতে স্বাক্ষর করলেও তারা এটিকে স্থায়ী হিসেবে মেনে নেয় নি, বরং একটি ‘সাময়িক যুদ্ধবিরতি’ হিসেবে বিবেচনা করেছিল। অর্থাৎ, বলশেভিকরা পরিস্থিতির চাপে এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে বাধ্য হলেও এই চুক্তির শর্তাবলি মেনে চলার কোনো ইচ্ছে তাদের ছিল না, এবং প্রথম সুযোগেই তারা এই চুক্তিকে বাতিল করতে ইচ্ছুক ছিল।
ষষ্ঠত, জার্মানদের সঙ্গে সন্ধি স্বাক্ষরের পিছনে বলশেভিকদের আরেকটি কারণ ছিল মিত্রশক্তির রাশিয়া আক্রমণ। মিত্রশক্তি (ব্রিটেন, ফ্রান্স, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও অন্যান্য রাষ্ট্র) রাশিয়ায় সংঘটিত অক্টোবর বিপ্লবকে অত্যন্ত নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখছিল। বলশেভিকরা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে রাশিয়ার অংশগ্রহণের অবসান ঘটাতে চাইছিল এবং সমগ্র বিশ্বে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংঘটনের আহ্বান জানাচ্ছিল, এটি ছিল বলশেভিকদের প্রতি মিত্রশক্তির বিদ্বেষের মূল কারণ। ব্রিটিশ রাজনীতিবিদ উইনস্টন চার্চিল তো ঘোষণাই করেছিলেন যে,
বলশেভিকবাদকে দোলনায় থাকা অবস্থাতেই গলা টিপে হত্যা করতে হবে!
আরো পড়ুন: অক্টোবর বিপ্লব: সমাজতান্ত্রিক মহাবিপ্লব না ‘জার্মান ষড়যন্ত্র’? (পর্ব ১)
অক্টোবর বিপ্লব পরবর্তী যুদ্ধবিরতি চুক্তি
১৯১৭ সালের ডিসেম্বরে বলশেভিকরা কেন্দ্রীয় শক্তির সঙ্গে একটি যুদ্ধবিরতিতে স্বাক্ষর করে, এবং যুদ্ধক্লান্ত রুশ সৈন্যরা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে বাড়ি ফিরতে শুরু করে। ঠিক এই সময়েই ১৯১৮ সালের জানুয়ারিতে মিত্রশক্তি রাশিয়া আক্রমণ করে, এবং রাশিয়ার প্রান্তিক অঞ্চলগুলোতে ব্রিটিশ, ফরাসি, মার্কিন ও জাপানি সৈন্যরা অবতরণ করে। মিত্রশক্তির উদ্দেশ্য ছিল বলশেভিক সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করা এবং রাশিয়ায় মিত্রশক্তির সমর্থিত একটি সরকারকে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করে রাশিয়া পুনরায় প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে বাধ্য করা। তাদের কার্যকলাপ সম্পর্কে বলশেভিক পররাষ্ট্রমন্ত্রী লিয়ন ত্রৎস্কি ব্যঙ্গ করে বলেছিলেন,
ইংরেজরা সর্বশেষ রক্তবিন্দু দিয়ে জার্মানদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে চায়। কিন্তু নিজেদের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে নয়, রুশদের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে!
চুক্তি পরবর্তী কর্মকাণ্ড
বলশেভিকরা যখন মিত্রশক্তির আক্রমণ প্রতিহত করার চেষ্টা করছিল, সেই সময়েই তারা জার্মানদের প্রস্তাবিত কঠোর শর্তাবলি প্রত্যাখ্যান করে এবং কেন্দ্রীয় শক্তির সঙ্গে সোভিয়েত রাশিয়ার যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। একই সঙ্গে মিত্রশক্তি ও কেন্দ্রীয় শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা বলশেভিকদের পক্ষে সম্ভব ছিল না, এবং দুই সপ্তাহের মধ্যেই তারা কেন্দ্রীয় শক্তির কাছে যুদ্ধক্ষেত্রে পরাজিত হয়। এমতাবস্থায় বলশেভিকরা কেন্দ্রীয় শক্তির সঙ্গে শান্তিচুক্তিতে স্বাক্ষর করতে বাধ্য হয়। এর ফলে তাদের বিশাল এক অঞ্চল হারাতে হলেও তারা মিত্রশক্তির আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য সংগঠিত হওয়ার সুযোগ লাভ করে।
সর্বোপরি, বলশেভিকরা ব্রেস্ত–লিতোভস্ক চুক্তির শর্তাবলি পুরোপুরি মেনে চলে নি। চুক্তি অনুযায়ী বলশেভিকরা কেন্দ্রীয় শক্তির সৈন্যদের মাঝে বলশেভিক ও যুদ্ধবিরোধী প্রচারণা চালানো থেকে বিরত থাকতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছিল। কিন্তু চুক্তির লঙ্ঘন করে তারা জার্মান ও অস্ট্রো–হাঙ্গেরীয় সৈন্যদের মধ্যে ব্যাপক হারে যুদ্ধবিরোধী প্রচারণা চালাতে শুরু করে। জার্মানদের উদ্দেশ্য ছিল যে, তারা পূর্ব রণাঙ্গন থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে পশ্চিম রণাঙ্গনে প্রেরণ করবে, কারণ সেসময় পশ্চিম রণাঙ্গনে লক্ষ লক্ষ মার্কিন সৈন্য এসে পৌঁছাচ্ছিল এবং যুদ্ধে জয়ী হওয়ার জন্য সেখানে জার্মানির প্রচুর সৈন্যের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু পূর্ব রণাঙ্গনে মোতায়েনকৃত সৈন্যদের জার্মান সামরিক কমান্ড আর বিশ্বাস করতে পারছিল না, কারণ তাদের ধারণা ছিল যে, এদের মধ্যে অনেকেই বলশেভিকদের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে এবং তাদের নতুন একটি যুদ্ধক্ষেত্রে প্রেরণ করা হলে তারা বিদ্রোহ করে বসতে পারে।
এছাড়া বলশেভিকরা কেন্দ্রীয় শক্তি কর্তৃক রাশিয়ার কাছ থেকে দখলকৃত অঞ্চলগুলোতে বিদ্রোহ ও গেরিলা যুদ্ধ উস্কে দেয়। এর ফলে দখলকৃত অঞ্চলের ওপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার জন্য জার্মানদেরকে প্রায় ১০ লক্ষ সৈন্য পূর্ব রণাঙ্গনে মোতায়েন রাখতে হয়। ফলে পশ্চিম রণাঙ্গনে তারা পরাজিত হয় এবং অবশেষে ব্রেস্ত–লিতোভস্ক চুক্তি বাতিল করতে বাধ্য হয়। বলশেভিকরা যদি সত্যিই ‘জার্মান গুপ্তচর’ হতো, তাহলে তারা জার্মানির সঙ্গে স্বাক্ষরিত চুক্তি ভঙ্গ করত না বা তাদের স্বার্থের বিরুদ্ধেও কাজ করত না।
সুতরাং, অক্টোবর বিপ্লব সংঘটিত হওয়ার আগ পর্যন্ত জার্মানদের সঙ্গে বলশেভিকদের এক ধরনের মৈত্রী ছিল, কিন্তু বিপ্লবের পর পরিস্থিতি পাল্টে যায়। তখন বলশেভিকরা নিজেরাই রাশিয়ার শাসকে পরিণত হয়, ফলে জার্মানদের সঙ্গে সহযোগিতা করার তাদের কোনো প্রয়োজন ছিল না। এজন্য লেনিনকে ‘জার্মান গুপ্তচর’ হিসেবে অভিহিত করা বা ‘অক্টোবর বিপ্লব’কে ‘জার্মান ষড়যন্ত্র’ হিসেবে চিহ্নিত করা কতটা যুক্তিযুক্ত, তা প্রশ্নসাপেক্ষ। লেনিন এবং অক্টোবর বিপ্লব ইতিহাসের একটি বিতর্কিত ঘটনা সেটি যেমন নিশ্চিত, তেমনি অক্টোবর বিপ্লব যে পৃথিবীতে আমূল পরিবর্তন নিয়ে এসেছিল সেটিও অনস্বীকার্য।
তথ্যসূত্র:
গ্রন্থসূত্র:
- Mawdsley, Evan (Sept, 2017). The Russian Civil War. ISBN: 978-1780274799. Birlinn Ltd
সম্পর্কিত নিবন্ধসমূহ: